২৫তম তারাবীহ: ২৮তম পারার মর্মার্থ
সূরা মুজাদালা
মদীনায় অবতীর্ণ, আয়াত ২২, রুকু ৩
অন্যান্য মাদানী সূরার ন্যায় আলোচ্য সূরায় রয়েছে শরঈ বিধি-বিধানের বর্ণনা এবং রয়েছে মুনাফিকদের আলোচনা। সূরার সূচনায় সাইয়্যেদা খাওলা বিনতে সালাব رضي الله عنها এর ঘটনার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে, তিনি তার স্বামী আওস বিন সামেত رضي الله عنه এর বিচার নিয়ে দরবারে রিসালাতে এসেছিলেন। স্বামী আওস তার সাথে ‘জিহার’ করেছিলেন। বিচার দায়েরের ভঙ্গি কিছুটা এমন ছিল যেন তিনি ঝগড়া করছেন, তাই খাওলাকে ‘মুজাদিলা’(ঝগড়া কারিণী) বলা হয়েছে এবং উল্লেখিত ঘটনার আলোকে সূরার নাম ‘মুজাদালা’ রাখা হয়েছে।
জাহেলী যুগে ‘জিহার’ (স্ত্রীকে আপন মায়ের মত হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা) ছিল তালাকের হুকুম ভুক্ত, এর ফলে স্ত্রী স্বামীর জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে যেত। কুরআন এই নিষিদ্ধতার একটি সীমা বেঁধে দিয়েছে যা কাফফারা প্রদানের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়। (১-৪)
সূরা মুজাদালার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হল:
১. এই সূরা কানাকানি কথা বলার বিধান বর্ণনা করে, অর্থ্যাৎ দুই বা ততোধিক ব্যক্তি যদি অন্যান্য লোকদের সামনে একে অপরে কানাকানি কথা বলা শুরু করে দেয় তবে এর বিধান কী হবে? হাদীসের ভাষ্যমতে তিনজন ব্যক্তির উপস্থিতিতে একজনকে রেখে অপর দুজন পরস্পরে কানাকানি করা মজলিসের আদব পরিপন্থী, কেননা এমনটি করলে তৃতীয় ব্যক্তি মনে করতে পারে, হয়ত তার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র চলছে, অবশ্য এখানে যে কানা ঘুষার ব্যাপারে নিষেধ করা হচ্ছে তা হল কাউকে শুধু শুধু পেরেশানিতে ফেলার উদ্দেশ্যে কানা ঘুষা করা।
এটি ছিল মুনাফিকদের অভ্যাস, তারা মুসলমানদেরকে পেরেশানিতে ফেলার উদ্দেশ্যে কানাঘুষা করত। যখন নবীজিকে সালাম করত তখন মুখ বাঁকিয়ে ‘আসসামু আলাইকা’ (তোমার মৃত্যু হোক) বলে সালাম জানাত। এই আয়াতগুলোতে ইহুদীদের এমন মন্দ আচরণের নিন্দা করা হয়েছে। অবশ্য যে গোপন সলাপরামর্শের উদ্দেশ্য হল সৎকাজ এবং সাধুতা, পূর্ণ সাধনা এবং আল্লাহ ভীরুতা তা নিন্দনীয় তো নয়ই, বরং অনুমোদিত ও প্রশংসনীয়।
২. জনসমাবেশে এবং মজলিসে বসার আদব-ভদ্রতা শিক্ষা দিয়ে ১১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “মুলসমানগণ! কোনো মজলিসে তোমরা যখন বসবে তখন অন্যের বসার স্থানও রেখো, তোমাদেরকে সরে বসে অন্যের জন্য জায়গা করে দিতে বলা হলে তোমরা তাতে দ্বিরুক্তি করো না; এমন কি যদি তোমাদেরকে উঠে চলে যেতেও বলা হয়, তবে কিছু মনে না করে উঠে যাও, এটাই মজলিসের আদব। বলা বাহুল্য, এই বিধান শুধু নবী কারীম ﷺ এর মজলিসের সাথে সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি মজলিসের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য। অবশ্য তা মুস্তাহাব, যে ব্যক্তি আগে থেকে মসজিদে অথবা কোনো মজলিসে বসে আছে ওই জায়গায় বসার অধিক হকদার সে ব্যক্তিই। তবে তার উচিত, পরে আগত মানুষদের জন্য জায়গা করে দেয়া।
৩. এই সূরায় সে সকল মুনাফিকদের আলোচনাও রয়েছে যারা ইহুদীদের সাথে বন্ধুত্ব রাখত, আবার নিজেদের ঈমানদার হওয়ার ব্যাপারেও কসম কাটত। তাদের এত বড় বড় দাবি সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাদেরকে হিযবুশ শায়তান (শয়তানের দল) বলে আখ্যায়িত করেছেন, এই দলের সাথে কোন মতেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমিকদের বন্ধুত্ব হতে পারে না।
পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারীকে শত্রুই বিবেচনা করে চাই সে তার মা-বাবা, ভাই-বন্ধু, স্ত্রী-পরিজন এবং সন্তান-সন্তুতিই হোক না কেন, তারা হল ‘হিযবুল্লাহ’ (আল্লাহর জামাআত)। এই সৌভাগ্যবানদের জন্য আল্লাহ তাআলা চারটি নেআমতের ঘোষণা দিয়েছেন :
এক. তাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলা ঈমান সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন।
দুই. তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য ও মদদ।
তিন. তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।
চার. আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর দান ও নেআমত পেয়ে সন্তুষ্ট। (১৪-২২)
সূরা হাশর
মদীনায় অবতীর্ণ, আয়াত ২৪, রুকু ২
এ সূরার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলো হল :
১. সূরার সূচনায় বলা হয়েছে, সৃষ্টির সবকিছু আল্লাহ তাআলার তাসবীহ পড়ে, হামদ ও সানা বয়ান করে, তাঁর মহিমা, ক্ষমতা ও একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়।
২. এরপর সূরাটিতে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার কিছু বাস্তব নমুনা এবং জীবন্ত প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হল : ইহুদী জাতি দীর্ঘকাল যাবত মদীনায় বসবাস করছিল। নিজেদের জান-মালের হেফাজতের জন্য তারা বড় বড় মজবুত দূর্গ নির্মাণ করে রেখেছিল। মদীনার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জীবনোপকরণের একটা বিরাট অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মদীনাবাসীকে তারা সুদের উপর ঋণ দিয়ে শক্তভাবে সুদী লেনদেনের শিকলে বেঁধে ফেলেছিল। তাদের ধারণা ছিল, আমাদেরকে কেউ এখান থেকে বের করতে পারবে না। কিন্তু তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণেই তাদের উপর আল্লাহর আযাব গযব নেমে আসে । আর এভাবে তাদেরকে দুই দুই বার ‘হাশরের’ মুখোমুখী হতে হয়। (এখানে ‘হাশর’ অর্থ একত্র করে বের করে দেয়া, নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া।)
প্রথমবারে তাদেরকে মদীনা মুনাওয়ারা থেকে বের করে খায়বারে পাঠানো হয় আর দ্বিতীয়বারে তাদেরকে সাইয়্যেদুনা উমর رضي الله عنه এর খেলাফতকালে খায়বার থেকেও বের করে দেয়া হয়। ইহুদীদের নির্বাসনের বিষয়টি স্বয়ং ইহুদীদের কাছে এমনকি মুসলমানদের কাছেও অসম্ভব ঠেকছিল। ইহুদীদের সুন্দর জীবন ব্যবস্থা, আত্মরক্ষার পূর্ণ আয়োজন এবং ঐক্য ও সংঘবদ্ধতার মজবুত ব্যবস্থাপনার কারণে কেউ কল্পনা করতেও সাহস পেত না যে, ইহুদীদেরকে লাঞ্চিত ও অপদস্থ হয়ে মদীনা মুনাওয়ারা এবং খায়বার থেকে বের হয়ে যেতে হবে। কিন্তু তাদের প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ, অস্বীকার, মিথ্যাচারিতা, অহংকার ও অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাআলা যখন তাদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত করে দিলেন তখন বাহ্যিক কোনো উপকরণই তাদের আর কোন কাজে এল না। আর শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে রইল। (২-৫)
৩. ইহুদী গোত্র বনু নযীরকে মদীনা মুনাওয়ারা থেকে বের করে দেয়া হলে গনীমতের বহু সম্পত্তি মুসলমানদের হস্তগত হয়। লড়াই ছাড়া যে সম্পদ হস্তগত হয় পরিভাষায় তাকে ‘ফাইয়ের সম্পদ’ বলা হয়।
ফাইয়ের সম্পদের বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাতে মুজাহিদদের কোনো অধিকার নেই, বরং তা বণ্টনের পরিপূর্ণ দায়িত্ব আল্লাহর নবীর (সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। তিনি সে সম্পদ দুর্বল, দরিদ্র, মিসকীন, প্রয়োজন গ্রস্ত এবং নিকটাত্মীয়দের মাঝে বণ্টন করবেন। এখানে যদিও ফাইয়ের সম্পদ বণ্টননীতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে, কিন্তু এর অধীনে ইসলামী অর্থনীতির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনও বলে দেয়া হয়েছে। তা হল, ইসলাম কখনো এটা চায় না যে, “সম্পদ শুধু ধনবানদের হাতেই ঘুরতে থাকবে।” বরং ইসলাম চায়, সম্পদ যেন সকলের হাতেই সম্প্রসারিত থাকে, সোসাইটির কোন সদস্য কিংবা কোন শ্রেণীই যেন বঞ্চিত না থাকে। যাকাত, সদকা, মীরাস এবং গনীমতের সম্পদের এক পঞ্চমাংশ ইত্যাদি বণ্টনের ক্ষেত্রে এই নীতিই অবলম্বন করা হয়েছে।
অর্থনীতির এই বিরাট দর্শন বর্ণনার পাশাপাশি আইনের উৎস সম্পর্কেও সুস্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে যে, যা কিছু রাসূল ﷺ তোমাদেরকে দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। (৭)
পুরো পড়তে ক্লিক করুন: ২৮তম পারা
Last Updated on February 1, 2023 @ 3:11 pm by IslamInLife বাংলা