হজ্জ হোক মকবুল ও প্রভাব সৃষ্টিকারী
وَلِلّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
আর আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য এ ঘরের হজ্জ করা মানুষের উপর ফরয; (অর্থাৎ তার জন্য) যে ব্যক্তির সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে কিনা তা মানে না, আল্লাহ তাআলা তো সমগ্র জগতবাসী থেকে অমুখাপেক্ষী! সুরা আলে-ইমরান:৯৭
চিন্তা করার ও বোঝার বিষয়
হজ্জ পালন সৌভাগ্যের কাজ! কিন্তু আমরা জানি, যেকোনো ইবাদত যদি সঠিক পন্থায় না করা হয় সেটির লাভ আশা করা যায় না। কখনো তো এমন হয় যে, ভুল পন্থায় ইবাদতের মাধ্যমে আমরা নিজের ক্ষতিসাধন করে ফেলি। কেউ তো সারাজীবন খবর রাখি না যে, আমলটি সঠিক নিয়মেই করা হয়নি। কেউ বা পরোয়াই করি না! এমন হওয়া কত দুঃখজনক যে, আল্লাহ তাআলার ইবাদতের সঠিক পন্থা না জেনে সম্পাদন করা হয় আর তারপর আত্মতুষ্টিতে জীবন অতিবাহিত হয় আমি অমুক ইবাদত করি বা করেছি! আজকাল তো প্রেস ও মিডিয়ার উন্নতির কারণে সাধারণ মুসলমানগণ আলেমগণের থেকে জানাকে প্রায় ত্যাগ করতে বসেছে! হজ্জের মাসআলা ও নির্দেশনাগুলো বই পড়ে বা ভিডিও দেখে সন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছি আমরা অনেকে। এতে ক্ষতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সবার আগে খুব ভালো করে মনে রাখুন যে, হজ্জ বা যেকোনো ইবাদত করব, আলেমগণ থেকে সঠিক নির্দেশনা ও মাসআলা জেনে করব। ইনশাআল্লাহ তাহলেই ইবাদত কবুলের আশা করা যায়। তখন এ কথা বলা যাবে, আমি তো চেষ্টা করেছি, কবুলের মালিক আল্লাহ তাআলা।
হজ্জ কী শেখায়
হজ্জের মূল শিক্ষা হল তাওহীদ, আল্লাহ তাআলার একত্ববাদে পূর্ণ বিশ্বাস রেখে তদনুযায়ী জীবন গড়ার প্রত্যয় করা। যখন বান্দার দ্বারা আল্লাহ তাআলার পূর্ণ আনুগত্য হবে তখনই বান্দার জীবনে তাওহীদ পরিপূর্ণরূপে পরিস্ফুট হবে। আর পূর্ণ আনুগত্য সবকিছুকে আল্লাহর জন্য ‘ত্যাগ’ ব্যতিত সুপ্রমাণিত হয় না। আল্লাহ তাআলার জন্য ত্যাগ প্রমাণ করে যে, আনুগত্যটি নির্ভেজাল বা খাঁটি। এমন খাঁটি আনুগত্য আল্লাহ পাকের ভালোবাসাকে অবধারিত করে। বান্দা সুমহান রবের সান্নিধ্য লাভ করে দুনিয়া ও আখেরাতের চরম সফলতা লাভ করে!
নবী ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর একত্ববাদ ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী
নবী ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের জীবন তাওহীদ, আনুগত্য ও ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি আল্লাহ তাআলার ‘খালীল’ — নিকট বন্ধু; সেটি তিনি আমলীভাবে (অর্থাৎ কর্মগতভাবে) প্রমাণ করেছেন। কিভাবে আল্লাহ তাআলার সত্যিকার ‘কুরব্’ বা নৈকট্য অর্জন করা যায়, কথা ও কাজে তিনি তা দেখিয়েছেন। উনার আল্লাহ-প্রেম কতটা খাঁটি ছিল আর ঐ একই পথে যারা হাঁটবে, তাদের ফল কত সুমিষ্ট ও কল্যাণকর হবে, আল্লাহ তাআলা হজ্জের আহকামগুলো এ উম্মতকে প্রদানের মাধ্যমে আমাদের জন্য তা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছেনে! আলহামদুলিল্লাহ। এ নেয়ামত নিঃসন্দেহে অতুলনীয়!
নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বেনিয়ায, তিনি কোনো ব্যাপারেই কারো মুখাপেক্ষী নন; তাঁর হুকুমের কারণে এত বড় সৌভাগ্য আমরা অর্জন করেছি। শত-কোটি বার শোকর করলেও তা হবে খুব কম!
সর্বশেষ নবী ﷺ ও তার উম্মত হজ্জের আহকাম পেয়ে আরও বেশি ধন্য
নবী ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশেই রহমাতুল্লিল আলামীন অর্থাৎ আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়ে আল্লাহ তাআলা একদিকে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের দোআ কবুল করেছেন (ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম উনার নসল্ বা বংশে এমন নবীর প্রেরণের আবেদন করেছেন, আর এমন উম্মতের জন্যও আবেদন করেছেন!)। অন্যদিকে, আল্লাহ পাক তাওহীদ, তাওহীদি জীবন, (কুরবানি বা) ত্যাগের ধারাবাহিকতা শ্রেষ্ঠ রাসূল ও তার বৈশিষ্ট্যমন্ডিত উম্মতের মাধ্যমে জারি রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ!
হজ্জ ও কুরবানির মাধ্যমে সর্বশেষ উম্মত আল্লাহ পাকের বন্দেগি ও ভালোবাসাকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মতাদর্শে প্রকাশ করে থাকে — সেটি হল ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের মতাদর্শ। এ মতাদর্শকে কেয়ামত পর্যন্ত জারি রাখতেই আমাদের প্রিয় নবীজি ﷺ কে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। দ্বীনকে আল্লাহ তাআলা তার (ﷺ -এর) মাধ্যমে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। ঈমান তথা বিশ্বাস, আনুগত্য, ত্যাগ ও কষ্ট শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার রাহে, তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য, আর কারো জন্য নয় — এ আকীদা (মৌলিক বিশ্বাস) হজ্জ নামক ইবাদত পালনের মাধ্যমে আন্তরিকতার সঙ্গে দৃশ্যতও পূর্ণতা পাবে, সামর্থ্যবানদের জন্য তাই হজ্জ ফরয্ করা হয়েছে।
হজ্জের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার ঘনিষ্ঠতর হয়
হজ্জের আহকাম (অর্থাৎ হুকুমসমূহ) গুলো বান্দাকে আল্লাহ তাআলার প্রতি এমন বিশ্বাস ও ইবাদতের শিক্ষা দেয় যা চূড়ান্ত। বান্দা আল্লাহ তাআলার আনুগত্য তো সারাজীবন করবে, কিন্তু কোন্ শিক্ষার আলোকে ও কেন — হজ্জ বান্দা-জীবনে সেটি আরও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে ও প্রতিষ্ঠা করে। হজ্জ আল্লাহ তাআলার নিকটে পৌঁছানোর, অর্থাৎ তাঁর ভালোবাসাকে আকর্ষণ করে। এর থেকে বড় পাওয়া মুমিন জীবনে কিছুই নেই।
নবী ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম জীবনকে কিভাবে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন, তার আল্লাহ-প্রেম কত গভীর ও ত্যাগের ছিল — স্ত্রী-সন্তান ও নিজের জীবন আল্লাহর জন্য কত তুচ্ছ হতে পারে — হজ্জ কেমন যেন এ সত্যটি বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়! হজ্জের আহকামগুলো একদমই ভিন্ন ধরণের। একটি সফর শুধু আল্লাহকে পাওয়ার জন্য করা হবে, আল্লাহকে মানার জন্য মুমিন কেমন পাগল বা অস্থির হবে, হজ্জ তারই প্রতিচ্ছবি!
আমাদের হজ্জ কেমন হচ্ছে, কেন আমরা হজ্জ করেও আল্লাহ থেকে দূরে
বড় চিন্তার বিষয় এটাই যে, হজ্জের মাধ্যমে এখন আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে পৌঁছানোর পরিবর্তে আরও দূরে সরে যাচ্ছি! এমন হওয়ার মূল কারণ দুনিয়ার ভালোবাসা, মূর্খতা, আল্লাহ তাআলার পরিচয় সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা।
চিন্তা করুন! ছোট্ট এক জীবন এ দুনিয়ার। যে জীবনের মূল লক্ষ্যই হল: আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। যখন তিনি আমাকে এমন সুযোগ দিলেন: বান্দা আস, আমার ঘর নামে এই কাবায় তুমি চলে আস। আস দু টুকরো কাপড় পরিধান করে — লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলতে বলতে, একদিন যেভাবে আসলেই তুমি দুনিয়া ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবে, সেই প্রস্তুতি তুমি এখনই নিয়ে নাও।
আমরা আল্লাহ তাআলার তাওফীকে হজ্জের তাওফীক পেয়ে যাই। কিন্তু আফসোস, শত আফসোস! আমরা অধিকাংশই সেই পবিত্র কাবায়, মীনা, আরাফা, মুজদালিফায় সেই মহামহিম আল্লাহকেই ভুলে যাই!! এখন ডিজিটাল যুগের কারণে এ চিত্রটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সে আলোচনা করতেও অন্তর কেঁপে উঠে..
হজ্জে যাওয়ার আসল প্রস্তুতি
আসুন, পবিত্র হজ্জ-উমরায় গিয়ে, আল্লাহর ঘর, পবিত্র জায়গাগুলোতে অবস্থান করে আমরা জীবনকে পবিত্র করে আসি! যাওয়ার আগেই পাপ-পঙ্কিলতা থেকে খাঁটি তওবা করে পাক-সাফ হয়ে সেখানে যাই। সবরকম অহেতুক কাজ আর গুনাহ থেকে সেখানে বিরত থাকার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যাই সেখানে, ইনশাআল্লাহ।
একটুখানি চিন্তা থাকলে, নিজেকে শোধরানোর বিশুদ্ধ নিয়ত করলে কী না সম্ভব!?
কোনো আলেম, বা অন্তত কোনো দ্বীনদার এমন মুসলমান ভাই — যাদের কাউকে আপনি শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসেন আর তাকে দেখলে আপনার আল্লাহর কথা মনে হয়, আখেরাতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, এমন কারো সঙ্গে আপনি হজ্জে ও উমরায় যাবেন। নিজেকে এমন কারো সঙ্গী বানাবেন। ইনশাআল্লাহ তাহলে কিছুটা হলেও আল্লাহর ঘরের রহমত-বরকত উপলব্ধি করতে পারবেন! পুরো জীবনে সে পবিত্র সফরটির ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ইনশাআল্লাহ।
যদি আমরা হজ্জ করে জীবন পরিবর্তন করতে পারি, অর্থাৎ নিজের বিশ্বাস ও আমলকে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যে চালিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করি, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের হজ্জ ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সে সুমহান ত্যাগ না হলেও সেটির একটি নকল-হরকত হল! আল্লাহ তাআলা আমাদের পিপাসা, লক্ষ্য, চেষ্টাটিই দেখেন। তিনি কোনো বাহানায় আমাদেরকে ক্ষমা করতে চান! হে আল্লাহ, আমাদের সবাইকে অন্তত তেমনই একটি হজ্জ করার তাওফীক দাও, যা আমাদেরকে তোমার সন্তুষ্টি পাইয়ে দেয়। (আমীন)
শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার সুযোগ
আমরা হলাম সাইয়্যেদুল মুরসালীন, সব রাসূলগণের নেতা মুহাম্মাদ ﷺ -এর উম্মত। রাসূলশ্রেষ্ঠ যিনি (ﷺ), তার উম্মতও শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ কাজ করতে হবে! পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ উত্তম সব কাজের সূচনা করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী ﷺ-এর মাধ্যমে সেই কাজগুলো একদিকে পূর্ণতা লাভ করেছে, আরেক দিকে সেগুলো পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে, কেয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে। রাসূল ﷺ পূর্ণাঙ্গ সে শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর হাতেখড়ি শিক্ষা তার উম্মতকে দান করে দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। এখন সে পথ ধরে যে চলবে সে সফল হবে, সে-ই শ্রেষ্ঠ উম্মতের পদে সমাসীন হয়ে সুমহান সৌভাগ্য লাভ করতে পারবে।
হজ্জের আহকামে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের মতাদর্শগুলোর অনুসরণ, যেটি প্রিয় নবীজি ﷺ থেকে আমরা অকাট্য বিধান বা ইসলামী শরীয়ত হিসেবে পেয়েছি, প্রিয় নবীজি নিজে হজ্জ করে দেখিয়ে গেছেন। সেটির কদর করতে হবে। তদনুযায়ী হজ্জ করার চেষ্টা করলে না এ নেয়ামতের কদর হবে! যদি হজ্জ হয় অন্যান্য সফরের মতন খাওয়া-দাওয়া, ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তোলার মতন একটি সফর, তাহলে একজন ঈমানদার তার অন্তরকেই জিজ্ঞেস করুক, “এ কেমন হজ্জ?!”
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হজ্জে মাবরূর (কবুল হজ্জ) নসীব করুন! আমীন।
Last Updated on July 3, 2024 @ 5:47 pm by IslamInLife বাংলা