মুমিনের চেষ্টার উদ্দেশ্য, স্বরূপ ও গুরুত্ব – ১
যেকোনো চেষ্টা, পার্থিব অথবা পরকালীন, যখন তা নেক হয়, নেক উদ্দেশ্যে করা হয়, আর নেক পন্থায় করা হয়, সেটি ইবাদত। চেষ্টাটি নেক হওয়া অর্থ যেসব কাজ আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন অথবা উৎসাহিত করেছেন। নেক উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। আর নেক পন্থা অর্থ আল্লাহ মনোনীত পন্থা। একজন মুমিন জানে, সেটি হল সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম, যে পথ পন্থা আমাদের প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখিয়েছেন, সেটি।
হালাল পথে আয় রোজগারও একটি নেক প্রচেষ্টা। ফরয ইবাদত সমূহের পর এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরয। এভাবে, ঘর-সংসার, সন্তান লালনপালন ও আরও যত জাগতিক কাজ, যেগুলো কিনা আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত, সবগুলো ক্ষেত্রে উন্নতি ও চেষ্টার অসংখ্য ছোট-বড় প্রচেষ্টা রয়েছে। মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে এসবকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সব মানুষই বিভিন্নভাবে জগৎ সংসারে নানারকম চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলিম আর অমুসলিমের চেষ্টায় মাঝে রয়েছে বড় ধরণের ব্যবধান!
আল্লাহ তাআলা বলছেন:
يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ
হে মানুষ, নিশ্চয়ই তুমি নিরবিচ্ছিন্ন তোমার রবের দিকে কষ্ট-ক্লেশ করে যাচ্ছ, তারপর সাক্ষাৎ ঘটবে তার (সেই কষ্ট ক্লেশের, যা করছ) অথবা দ্বিতীয় তরজমা তোমার রবের (আল্লাহ পাকের) সাক্ষাৎ ঘটবে। । [সুরা ইনশিকাক – ৮৪:৬]
চেষ্টা ও তার ফল সম্পর্কিত কিছু কুরআন মাজীদের আয়াত ও অর্থ আগে পড়ব ইনশাআল্লাহ, তারপর আলোচনা।
ঈমানদারদের চেষ্টা যে বিফলে যাবে না, সে কথায় বলা হয়েছে স্পষ্ট:
وَمَنْ أَرَادَ الآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُورًا
আর যারা পরকাল কামনা করে এবং মুমিন অবস্থায় তার জন্য যথাযথ চেষ্টা-সাধন া করে, এমন লোকদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে। [সুরা বনী-ইসরাঈল – ১৭:১৯]
আল্লাহর পথে কষ্ট-ক্লেশকারীগণের সঙ্গে আল্লাহ আছেন:
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন। [সুরা আনকাবুত – ২৯:৬৯]
ঈমানদারদের ব্যাপারে পার্থিব জীবনের সুসংবাদও সুর্স্পষ্ট:
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব যা তারা করত। [সুরা নাহল – ১৬:৯৭]
নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে তাদের ব্যাপারে, যারা মনে করে তারা দুনিয়াতে ভালো কাজ করছে। কিন্তু আখেরাতে তাদের এসব প্রচেষ্টা কোনো আসবে না! তাদের পরিচয়ও খুব স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا
বলুনঃ আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। [সুরা কা’হফ – ১৮:১০৩]
الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا
তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিবজীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে। [সুরা কা’হফ – ১৮:১০৪]
أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا
তারাই সে লোক, যারা তাদের পালনকর্তার নিদর্শনাবলী এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের বিষয় অস্বীকার করে। ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। সুতরাং কেয়ামতের দিন তাদের জন্য আমি কোন গুরুত্ব স্থির করব না। [সুরা কা’হফ – ১৮:১০৫]
যেমন কর্ম তেমনই ফল; মানুষ তার চেষ্টা ও সাধনা অনুযায়ীই বিনিময় পাবে:
وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَى
এবং মানুষ তাই পায়, যা সে করে [সুরা নাজম – ৫৩:৩৯]
বান্দার প্রচেষ্টা আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসার সাংঘর্ষিক নয়
একজন মুমিন প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন চেষ্টা করে। কিন্তু সে ঐ চেষ্টার উপর ভরসা করে না। ধরুন, একজন মুমিন কোনো একটি অবস্থার সম্মুখীন হল। ঐ অবস্থায় যেটা করণীয়, সেটা সে অবলম্বন করে থাকে।
যেকোনো প্রয়োজনেই আমরা আল্লাহ তাআলার মুখাপেক্ষী। এ কথাটি কোন্ মুমিন অস্বীকার করে?! তাই বলে সে চেষ্টাকে অস্বীকার করে না। চেষ্টার মধ্যে কোনো ক্ষমতা রয়েছে — এমন বিশ্বাসকে অস্বীকার করে।
এ কথা ভালো করে বোঝা উচিত যে, চেষ্টা করা অর্থ আল্লাহ তাআলার মুখাপেক্ষীতাকে অস্বীকার করা নয়। মুমিনের কাছে চেষ্টা করা অর্থ এমন কোনো কাজ নয় যা কিনা আল্লাহ তাআলার আদেশের বিপরীত। এ কথাটি আমরা সাধারণভাবে বুঝেও থাকি; অধিকাংশ মুসলমান বোঝে। চেষ্টা করতে হবে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে।
সমস্যা হয় যখন বান্দা “চেষ্টা করতে হবে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে” এ কথাটির অর্থ/মর্ম কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী না বুঝে নিজ বুদ্ধি বা বিবেক খাটিয়ে বোঝে! তখন চেষ্টায় সীমালঙ্ঘন হয়। অথবা কেউ হয়ত বলে বসে, “চেষ্টা করব কেন? আল্লাহ দেবেন”। এটাও ভুল।
আল্লাহ তাআলার আদেশ হল, তাঁর নির্দেশিত ও প্রদর্শিত পথে চেষ্টা করে ফলাফলের জন্য তাঁর ওপর ভরসা করা।
মুসলিম ও অমুসলিমের চেষ্টায় পার্থক্য
যে “চেষ্টা করা”টা আল্লাহ তাআলার বিধানের সীমালঙ্ঘন, সেটা তো আর মুমিনের চেষ্টা হতে পারে না। সে চেষ্টা তো আর মুমিনকে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি এনে দিতে পারে না! হতে পারে সেটা কেবল কোনো জাগতিক লাভ এনে দেবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার নিষেধকৃত বিষয়ের জন্য চেষ্টা অথবা নিষেধকৃত উপায়ে চেষ্টা — কোনোটাই আসলে মুমিনের চেষ্টা হতে পারে না। মুমিন এ জাতীয় কোনো চেষ্টা করে ফেললে, তাকে তওবা করতে হবে। অবশ্যই এমন চেষ্টা তাকে ত্যাগ করতে হবে!
অমুসলিমদের এমন হাজারো চেষ্টা আছে যেগুলো মুসলিমদের জন্য কোনোটি অহেতুক কাজ, কোনোটি বা স্পষ্ট গুনাহ। কোনো মুসলিম সেগুলোর কোনোটা করে যদি বলে, আল্লাহ চেষ্টা করতে বলেছেন, চেষ্টা করছি। এটা কেমন কথা হবে?! এটা হবে আল্লাহ তাআলার বিধানের স্পষ্ট সীমালঙ্ঘন।
অতএব, মুমিনের চেষ্টা ও চেষ্টার পন্থা/নিয়ম, উভয়ই আল্লাহ তআলার আদেশ হিসেবে পালন করে থাকে। তা না হলে, সেটা আল্লাহর পথে চেষ্টা হিসেবে গণ্য হয় না। লক্ষণীয় হল, চেষ্টা কোন্ বিষয়ে ও কোন্ পন্থায় — উভয়টি জরুরি। একটি যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে কখনো কখনো সে চেষ্টা আংশিক সঠিক হয়, কখনো পুরোই বিফলে যায়! উদাহরণস্বরূপ, পুরুষগণ সাধারণভাবে তো জামআতে নামায পড়বে। যদি এমন রোগী বাসায় থাকে যাকে দেখাশোনার অন্য কেউই নেই এক্ষেত্রে যদি ঘরের পুরুষ রোগীকে ফেলে দিয়ে জামআতে হাজির হয় তাহলে তো লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি! আল্লাহ তাআলা তো এমন অবস্থায়, রোগীর সেবাকে জামআতে হাজির হওয়া থেকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
মুমিন বান্দা যদি চেষ্টাকালীন সময়ে চিন্তান্বিত হয়, সেটাকে ঈমানের সাংঘর্ষিক মনে করা অনুচিত। মানবিক কারণে বান্দা চিন্তান্বিত হতে পারে। দুর্বলতার কারণে অস্থিরতাও আসতে পারে। দেখার বিষয় হল, সে কতটুকু আল্লাহ-মুখী আছে। সে আল্লাহকে ডাকছে কিনা। নাকি আল্লাহকে ভুলে বসে আছে। অথবা চরম মন্দ অবস্থা, আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে (নাউযুবিল্লাহ)। শেষোক্ত অবস্থায় বান্দার ঈমানের ক্ষতি হয়ে যায়। আমরা চেষ্টার বান্দা নই, আল্লাহর বান্দা। মুমিন জানে ও মানে, চেষ্টা করা আল্লাহর নির্দেশ। তাই সে চেষ্টা করে আর ডাকে আল্লাহকে, যাঁর ওপর তার পূর্ণ আস্থা!
পক্ষান্তরে, একজন অমুসলিম ডাকে গায়রুল্লাহকে (আল্লাহ ব্যতীত কোনোকিছুকে)। তার চেষ্টা যে পথেই হোক, দুনিয়াতে সেটা সফলতা আনুক বা বিফলতা, সবই ক্ষণস্থায়ী!
Last Updated on December 5, 2024 @ 7:09 pm by IslamInLife বাংলা