বিবিধ প্রবন্ধ

ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি

যেহেতু এই দুনিয়াতে থাকা যাবে না, তাই ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। তাদের জীবনটা ঈর্ষনীয়, যারা সর্বদা এ বিষয়ে সজাগ। এমন সজাগ যে, দুনিয়ার সুখ হোক বা দুঃখ, কিছুই তাদেরকে অত্যধিক প্রভাবিত করেনা; তাদেরকে প্রভাবিত করে আল্লাহ তাআলার হুকুম। সব বিষয়ে তারা এ বিষয়টিকেই সামনে রাখেন – আমার রব কী চান? কীসে তিনি খুশি? শোকর আর সবরের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয় এরকম মানুষের জীবন। জীবনের চরম ও পরম আনন্দের মুহূর্তেও সে মনে রাখে, কে তাকে সেই নেয়ামত দিয়েছে। মহামহিম আল্লাহ তাআলার কথা এভাবে সে সবসময় স্মরণ রাখে। আপন পরিজনের বিয়োগ শোকও তাকে একটা সীমা পর্যন্ত ব্যথা দেয়। মেনে নেয় আল্লাহ তাআলার ফয়সালা। এরূপ বান্দাদের অবস্থা এমন যে, আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়ানোর বিষয়টাই তাদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।

যদি আমরা প্রতিদিন পাঁচ মিনিটও বাস্তবতা ও আমাদের পরিণতি নিয়ে চিন্তা-ফিকির করি, তাহলে দেখবেন যে জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার পথে চলতে চায়, তার জন্য আল্লাহ তাআলা উপায়-উপকরণ-পথ খুলে দেন। সে ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারে — সে একা নয়। আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা আর পালনকর্তা তার সাথেই আছে। কারণ, আল্লাহ তাআলার ওয়াদা রয়েছে (অর্থ): যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে উপনীত করব (অর্থাৎ, তাকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দিব) নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন। সুরা আনকাবুত: ৬৯

যে বিষয়গুলো আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার পথে চলতে, তাঁর হুকুম পালন করতে বাঁধা দেয়, সেগুলো কোনোটিই স্থায়ী নয়। স্থায়ী জিনিস ছেড়ে দিয়ে অস্থায়ী জিনিসের দিকে ধাবিত হওয়া চরম বোকামি। ঈমান ও নেক আমল হল স্থায়ী, বরং চিরস্থায়ী। এগুলো এমন অমূল্য সম্পদ যে, পার্থিব যত ক্ষতিই হোক – ছাড়বার নয়। আমার ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠ কোনো মানুষও যদি চায় আমি ঈমান ছাড়ি, নেক আমল ত্যাগ করি – তা কখনই সম্ভব নয়। আমার যিনি সৃষ্টিকর্তা, আমার যিনি লালন-পালনকর্তা, তাঁর ইচ্ছা, তাঁর হুকুম বাদ দিয়ে আমি কিছুই করতে পারি না; আর কিছুই করব না। এরূপ চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতা যতক্ষণ অর্জিত না হবে, বুঝে নিতে হবে আমার ঈমান দুর্বল – খুবই দুর্বল। হ্যাঁ, মানুষের সাথে সুসম্পর্ক, ভালোবাসা, মহব্বত বজায় রাখতে হবে। এমনকি সবাইকে আমার থেকে ভালো জেনে আর নিজেকে সবার থেকে ছোট মনে করেই আমি আল্লাহ তাআলার পথে চেষ্টা-মেহনত অব্যাহত রাখব। কাউকে হেয় করব না; কখনই নিজেকে উত্তম মনে করব না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, কার কোন আমলকে পছন্দ করছেন, কার কোন আমল যে কবুল হয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা বলতে পারি না। তাই অহংকার করা যাবে না। আল্লাহ তাআলার পথে নিজেকে মিটিয়ে দিতে হবে । যে নিজেকে মিটিয়ে দেয় আল্লাহ তাআলা তাকে সফল করেন, সে চমকায়। তার সাফল্য পার্থিব ও পারলৌকিক – উভয় জীবনেই।

ইতিহাস বরেণ্য (আমাদের সময়ের নিকটবর্তী) বুযূর্গ, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী رحمة الله عليه -এর কাছে কোনো এক ব্যক্তি হাজির হয়ে (নিজের দাঁড়ি মুন্ডানো ইত্যাদি আমলের দিকে ইশারা করে আত্ম-সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বললেন, ‘হযরত, আমি একজন ফাসেক।’ সাথে সাথে হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী رحمة الله عليه জবাব দিলেন, ‘আপনি বাইরে ফাসেক, আর আমি ভিতরে।’ প্রিয় পাঠক, চিন্তা করুন। ইসলামের শিক্ষা মানুষকে কিরূপ বিনয়ী করে দেয়। নিজেকে বিলীন করার আর অন্যকে মাথায় তুলে রাখার কী অপূর্ব উদাহরণ! রাসূলে আকরাম ﷺ ও সাহাবা رضي الله عنهم -এর জীবনী এমন সব ঘটনাতেই পরিপূর্ণ। বীর-বাহাদুর, নবীজি ﷺ এর আপন চাচাত ভাই, ইসলাম কবুলকারীদের একেবারে প্রথম সারির মানুষ, বড় সাহাবী, তাও আবার জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ব্যক্তি, হযরত আলী رضي الله عنه। যুদ্ধের ময়দানে যার প্রতাপে প্রতিপক্ষের গলা শুকিয়ে যেত….। ঘটনা সবারই জানা। এক কাফিরকে যখন তিনি কাবুতে এনে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত, সে মুহূর্তে তার পবিত্র মুখে সেই কাফির থুথু দিল। সাথে সাথে আলী رضي الله عنه তিনি নিয়তকে যাচাই করে তলোয়ার নামিয়ে নিলেন। সেই আমলটি কাফিরকে মুসলমান হওয়ার মাধ্যম হয়ে গেল! কেয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের জন্য দৃষ্টান্ত — ইসলাম কেমন দ্বীন।

কিন্তু দ্বীন, অর্থাৎ ইসলাম কী, আজ মুসলমানই যেন তা ভুলতে চলেছে! কত বড় আফসোসের কথা। দ্বীনকে না জানার কারণে আজ আমরা এও বুঝি না যে, আমাদের শত্রু কে? আর কে আমাদের মিত্র? শয়তান খুব সজাগ। সেইত আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। কিন্তু আমাদেরকে সে বুঝিয়েছে যে, মানুষই আমাদের শত্রু। উপরন্তু, শয়তান বুঝিয়েছে যে, মুসলমান আমাদের শত্রু। চিন্তা করুন! কী সর্বনাশা কথা। এখন আমরা আমাদের মুসলমান ভাইকে শত্রু বানিয়ে পড়েছি বিপদে। চলছি বিপথে। ঘরে-বাইরে-রাস্তায় সবাইকে আমরা শত্রু ভাবছি। শান্তি আসবে কিভাবে? এর ফলেই তো গীবত, শেকায়াত, হিংসা, হানাহানির বিস্তার! কোথায় একসাথে থাকব, একযোগে কাজ করব, মিলে মিশে চলব, পরস্পরকে সাহায্য করব, অন্যকে ছাড় দিয়ে চলব, নিজের দোষ দেখব, অন্যকে ক্ষমা করব – না, সব বিপরীতমুখী। শয়তান আর আমাদের মনকে (নফস) বুঝিয়েছে যে, অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে হবে আমাকে। তা না হলে টেকা যাবে না। তো শয়তানের কথা শুনে কী লাভ হয়েছে? কতটুকু ফায়দা হয়েছে? যদি শয়তানি কাজে আমরা ফায়দা অনুভব করি – আল্লাহ তাআলার পানাহ। অচিরেই দেখব তার ভয়াবহ পরিণতি! মনের মধ্যে কুটনামি আর অন্যের বিরুদ্ধে লাগালাগির যে আগুন আমি জ্বালিয়েছি, তা আসলে অন্য কাউকে জ্বালানোর আগে আমাকেই জ্বালিয়ে দিবে। অতএব, তার আগেই আমরা তওবা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমীন।

চলুন আমরা কুরআন, হাদীস আর আমাদের পূর্বসূরীদের (সাহাবী ও বুযূর্গানে দ্বীনের) ঘটনা পড়া শুরু করি। চিন্তা ফিকির করি তার ওপর। শিক্ষা নেই তা থেকে। পৃথিবী ছেড়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি এভাবে নেওয়া শুরু করি। অহেতুক চিন্তা, কথা, আর কাজ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ তাআলার সন্তষ্টি অনুসন্ধান করি। দেখবেন দুনিয়াতেই কত শান্তি মিলবে। যেমন কিনা কেউ (তার প্রতিপক্ষকে) বলেছিল, ‘তুমি আমাকে গালির গুলি কর, আমি তার পরওয়া করি না। আমিতো এই জীবনটা সঁপে দিলাম তাঁরই আরাধনায়; আর তাঁকেই পাওয়ার বাসনায়, যিনি আমাকে-তোমাকে সৃষ্টি করে এই দুনিয়া নামক পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছেন। তাই আমার মনোযোগ তুমি কোনোভাবেই তাঁর থেকে এভাবে হটাতে পারবে না।’ অর্থাৎ, তোমার প্রতিশোধ চিন্তায় সময় নষ্ট করব না আমি। তোমার এই সব অহেতুক কথা, জ্বালাতন, নিপীড়ন আমাকে আল্লাহ তাআলার ইবাদত, যিকির, নেক আমল থেকে ফেরাতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। যাঁর হুকুমে আমি এই পৃথিবীতে এসেছি, তাঁর হুকুমেই আমাকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। যাওয়ার আগেই প্রস্তুত হতে হবে। আমি সেই কাজে ব্যস্ত।

Last Updated on August 1, 2022 @ 12:23 pm by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it