আল্লাহর পথে ক্রমোন্নতির প্রচেষ্টা
বান্দা ঈমানে-আমলে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে সদা সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। তার গতকালের চেয়ে আজ, আজকের চেয়ে আগামীকাল ও আগামীকালের চেয়ে পরশু দিনটি যেন আরও উন্নত হয়, আরও সমৃদ্ধ হয় – এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। মুসলমান হতে পেরেছি বলে ক্ষান্ত হয়ে পড়বে না। যদি ঈমান ও ইসলামের উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা থেমে যায়, তাহলে কেমন আল্লাহর বান্দা হলাম আমরা?!
ব্যবসায় একবার, দু’বার ক্ষতির সম্মুখীন ব্যক্তি ক্ষান্ত হয়না। মুমিন আল্লাহর পথে চলার বিষয়ে ক্ষান্ত হবে কেন?! মুমিন বরং তওবা-ইস্তেগফার, নিয়তের সংশোধন, নেক-আমল বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকবে। নিজের ও উম্মতের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণকামী হবে।
দ্বীনের পথে ক্রমোন্নতিই হল মুমিনের ইহ-পারলৌকিক যাবতীয় কল্যাণের মূল।
মুমিনের দ্বীনী উন্নতি তার দুনিয়া ও আখেরাতের (পূর্ণ) সফলতা বয়ে আনবে। এমনকি মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির ওপর এ প্রভাব পড়বে। মুসলিম উম্মাহর ওপর তো পড়বেই, বিজাতীয়রা পর্যন্ত এ প্রভাব থেকে বঞ্চিত হবে না।
পার্থিব অবস্থা ও আখেরাতের অবস্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইহ-লৌকিক জীবন সসীম; পারলৌকিক জীবন হল অসীম।
পার্থিব জীবনে সুখ-শান্তি, দুঃখ-কষ্ট মিলেমিশে আছে। এই জীবনে কেউ পূর্ণমাত্রায় শান্তিতে নেই, কেউ পূর্ণমাত্রায় কষ্টেও নেই। এখানের ঘটনা-প্রবাহ বড় বৈচিত্র্যময়! যেমন ধরুন: কাল-বৈশাখীর মত জীবনে ঝড় আছে, হঠাৎ ঝড় থেমে পরিবেশ একদম শান্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার বাতাস বইছে, মেঘ জমছে, বৃষ্টি হচ্ছে, আবার মেঘ কেটে গিয়ে বৃষ্টি থেমে রোদ উঠছে। এভাবে মানবজীবনে মরুর শুষ্কতা-রুক্ষতা আছে, আছে মেরু অঞ্চলের প্রচন্ড শীত-তুষারপাত। বৈশাখের মত ঝড়ও হাওয়া আছে, এর বিপরীতে আছে বসন্তের মৃদু বাতাস ও স্নিগ্ধতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরকম পরিবর্তন আসতেই থাকে।
সুস্থতা-অসুস্থতা, দুঃখ-কষ্ট-ক্লেশ, সুখময় সময়, বিপদাপদ ঘূর্ণিবাত্যার মত আসে আর যায়। এই মানুষ স্বপ্ন দেখছে, কখনো তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই কিছু অর্জন করতে যাচ্ছে – হঠাৎ সব হয়ত হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মানুষের চিন্তা-চেতনার মধ্যে আজ এক অবস্থা, তো কাল আরেক। এসবের মাঝে মানুষের ছুটোছুটিও চলছে অনবরত! শরীর তো শরীর, মন পর্যন্ত কখনো দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। কত রকম চিন্তা, চেষ্টা, স্বপ্ন, কল্পনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা! অথচ সব বাস্তবায়িত হচ্ছে, এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষ কত কিছু চায়, কিন্তু পায় কতটুকু? কত কিছু না চাইতেও আবার পেয়ে যায়! একটু চিন্তা করলে বুঝে আসে, আসলে খুব এবং খুবই কম জিনিস মানুষের নিয়ন্ত্রণে।
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কীসে – এটা না বুঝলে জীবনটি* এই ঘূর্ণিবাত্যার মধ্যে একদিন শেষও হয়ে যাবে। মহামূল্যবান জীবন নামক সম্পদ একেবারে বিনষ্ট হয়ে খড়কুটার চেয়েও বেদামী হয়ে বিলীন হয়ে যাবে!
দেখুন আল্লাহর সত্যবাদী রাসূল ﷺ যথার্থই বলেছেন (হাদীসের মর্মার্থ), বুদ্ধিমান হল সে যে কিনা মৃত্যুর আগেই তার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই মাপকাঠিতে বর্তমানে দুনিয়াতে সবচেয়ে ধনী, শিক্ষিত, ক্ষমতাবান জাঁদরেলদের বেশিরভাগই বোকা সাব্যস্ত হবে। এবং সত্য এটাই! এ মাপকাঠি অনুযায়ী আমরা মুমিনরাও কয়জন বলতে পারব, আমি সত্যিই খুব বুদ্ধিমান, একদমই বোকা নাই? বুদ্ধিমান তো সেই মুমিন যে মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর প্রস্ততি গ্রহণে তৎপর। কবি বলেছেন:
সারাদিনই যবানে যিকির
শরীর ওয়াক্তমত নামাযে;
অন্তরটাই দোকানপাটে
ব্যবসায়-পথে-ঘাটে,
হায়! কেমন মুসলমান আমি,
অন্তরটা ঠিক হলেই তো
হতাম জুনায়েদ বা
বায়েজীদ বোস্তামী!
কবি আফসোস করে নিজের অবস্থা বলেছেন। যেন বলেছেন আমাদের অধিকাংশের অবস্থাই। কারণ আমরা যিকির করি, নামায পড়ি ঠিক। কিন্তু এগুলো, আর আরও যত নেক কাজ রয়েছে — সবগুলোতে আমাদের আসল জায়গা “অন্তর” — আল্লাহ-বিমুখ(!) কেমন হল ব্যাপারটি?! অথচ মুমিনের দৈনিক চব্বিশটি ঘন্টা আল্লাহর পথে ব্যয় হওয়ার কথা। আর এর উপায়ও সহজ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-কে পরিপূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে হবে। চিন্তা, কথা ও কাজে আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। আখেরাতকে প্রাধান্য দিলে পার্থিব জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মুমিন এটা খুব ভাল করে জানে যে, তকদীরে যা আছে সেটা কেউ রদ করতে পারবে না। যে ব্যক্তি যত যত্ন সহকারে আখেরাতের চিন্তা করে তার জন্য দুনিয়ার অপ্রয়োজনীয় বস্তু পরিত্যাগ করা তত সহজ, তার আমল তত সুন্দর, সে তত বেশি দ্বীনের পথে অগ্রগামী। তার অবস্থা আসলেই এমন যে, হাত-পা দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত হলেও অন্তর আল্লাহর সঙ্গেই লেগে থাকে। এমন ব্যক্তির জাগতিক কাজগুলোও দ্বীনি কাজ। আযান হলে সেটা বোঝা যায়, গুনাহর আহ্বান সামনে আসলে সেটা ফুটে উঠে। কারণ আযানের ধ্বণি মুমিনকে দুনিয়া থেকে সহজে পৃথক করে। গুনাহর কাজে তাকে আহ্বান করা হলে সে আল্লাহর স্মরণে তা থেকে বিরত হয়ে যায়।
আমাদের মধ্যে, দুনিয়ার ক্রমোন্নতির চেষ্টা কার নেই? সবারই আছে। কিন্তু দ্বীনি ক্রমোন্নতির চেষ্টা..? আমরা বলছি না, অধিকাংশের নেই, কিন্তু এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, যেভাবে আমরা পার্থিব উন্নতির চেষ্টা অব্যাহত রাখি। উন্নতি না হলে চিন্তিত হয়ে কারণ অনুসন্ধান করি, নিয়মতি উন্নতি-অবনতির হিসাব-নিকাশ করি, সেভাবে কি আমরা আমাদের দ্বীনি উন্নতির চিন্তা, প্রচেষ্টা ও লাভ-ক্ষতির হিসাব করি?
আসুন, একটি সহজ-সরল পদক্ষেপ নিই আজ!
প্রতিদিন সকাল হলে আমি দু-তিন মিনিট চিন্তা করব, আজ আমি সুন্দর করে, যত্নসহকারে নামাযগুলো আদায় করব। যেকোনো মানুষ কিংবা আল্লাহর কোনো সৃষ্টির সঙ্গে ভালো আচরণ করব ইনশাআল্লাহ, জেনে-বুঝে আমি কারুর ক্ষতি করব না। রাতে ঘুমানোর আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করব এভাবে, “তুমি সকালের নিয়ত ও দৃঢ় ইচ্ছা অনুযায়ী নামায পড়েছ তো? আল্লাহর সব সৃষ্টির সঙ্গে তোমার আচরণ উত্তম ছিল তো?” আর আল্লাহকে এ কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নিই: হে আল্লাহ! আসলে আমি যথাযথ পারিনি। তুমি আমাকে মাফ কর। আর যে যে অপরাধ করেছি সে ক্ষতিপূরণ যথাযথ নেব — পাকাপোক্ত ওয়াদা করছি। তুমি তাওফীক দিও। আমীন।
কোন্ মুসলমানের কাছে নামাযের গুরুত্ব নেই, কোন্ মুসলমানের কাছে উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব নেই — এক বাক্যে স্বীকার করতে হবে সবাইকে, প্রতিটি মুসলমান ইবাদত শ্রেষ্ঠ “নামায” আর উত্তম চরিত্রের তাগিদ সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। প্রতি ওয়াক্ত নামাযে যত্নবান হওয়া আর সবার সঙ্গে আচরণে উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করা — আজ থেকে এ দুটি কাজে যত্নবান হব আর কেবলই আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার নিয়তেই তা করব ইনশাআল্লাহ! দেখবেন, আল্লাহর পথে ক্রমোন্নতি শুরু হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। হে আল্লাহ আমাকে ও সবাই তাওফীক দান কর — আমীন।
———————————————————–
* পৃথিবীতে একবারই জন্ম, একবারই মৃত্যু। একটিই জীবন, একটিই সুযোগ।
Last Updated on September 12, 2024 @ 11:04 pm by IslamInLife বাংলা