চির সফলতার একমাত্র পথ: মুমিনের ভরসা আল্লাহ তাআলা
ঈমানের ভিত্তিতে চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস ও প্রচেষ্টা মুমিনকে চির-সফল করে তোলে। এর বিপরীত যত পথ ও মত সব বাতিল ও বিফলতা বয়ে আনে।
মুমিনের আসবাব বা বস্তু ব্যবহার
মুমিন আসবাব (জিনিস/বস্তু) এখতিয়ার (ব্যবহার) করে। যে আসবাবই ব্যবহার করা জায়েয (অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা কর্তৃক ব্যবহারের অনুমতিপ্রাপ্ত), সেটা মুমিন আল্লাহ তাআলার দেওয়া বিধান মুতাবিক ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু মুমিনের আন্তরিক বিশ্বাস হল, আসবাবের ওপর মুসাব্বিবের (আসবাব সৃষ্টিকারীর) আদেশ-নিষেধ পূর্ণমাত্রায় বহাল রয়েছে।
তাবলীগের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন মাওলানা সাঈদ আহমাদ খান رحمة الله عليه। মদীনা মুনাওওয়ারায় দীর্ঘ সময় বসবাস করেছেন তিনি! আমাদের বিশ্বস্তসূত্রের খবর অনুযায়ী, দ্বীনের একনিষ্ঠ একজন খাদেম, এই আলেমে-দ্বীনকে তৎকালীন সৌদি সরকার বাধ্য করেছিলেন মদীনা ত্যাগ করে দেশে ফিরে আসতে। তিনি তারপর ১৯৯৬ সালে যখন মদীনাতে সফরে গিয়েছিলেন, পবিত্র মদীনাতেই তার ইন্তেকাল হয়! তাকে জান্নাতুল বাকীতেই কবরস্থ করা হয়েছে, মাশাআল্লাহ। যা আল্লাহ চান তা কেউ রধ করতে পারে না! একটু ভুমিকা দিয়ে মাওলানা সাঈদ আহমাদ খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহির একটি কথা, যা তিনি বাংলাদেশের দশ দিনের জোড়ে বলেছিলেন সেটি বলছি: “আসবাব সে হোনা, ইয়ে ইয়াকীন গুনাহ হ্যায়। অওরভি, আসবাব এখতিয়ার না কারনা — ইয়েভি গুনাহ হ্যায়।” অর্থাৎ, আসবাব/বস্তু থেকে হওয়ার বিশ্বাস গুনাহ। আর আসবাব/বস্তু ব্যবহার না করাও গুনাহ।
দেখুন! সংক্ষেপে কত সুন্দর পথনির্দেশ। একে বলে ভারসাম্যতা। এ থেকে আমরা, আজ মুসলমান কত দূরে!
আসবাবের ক্ষমতা আল্লাহ প্রদত্ত
আসবাবের নিজস্ব ক্ষমতা কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক গ্রহণ করে না, মুমিনের গ্রহণ করা তো প্রশ্নই ওঠে না! মূর্তিকে যারা পূজা করে, তারা মূর্তির শক্তি সামর্থ্যে বিশ্বাসী, যা কিনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এমনিভাবে অর্থ-কড়ি থেকে শুরু করে আগুন, পানি, বাতাস — যেকোনো আসবাব বা বস্তুর কী ক্ষমতা আছে?! কারো কোনো ক্ষমতা নেই। যে ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে সেটা তার নিজস্ব নয়! কোনো বস্তু (নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ বা জিনিস) যেমন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছাড়া ক্রিয়া করতে পারে না, কোনো জীবিত বা প্রাণবন্ত কিছুও পারে না আল্লাহ তাআলার আদেশ ছাড়া ক্রিয়া করতে। জীবিত বা প্রাণবন্ত সৃষ্টির মধ্যে অবশ্য মানুষ ও জ্বীনকে সঠিক পথ অবলম্বনের জন্য কিছু সাধ্য-সামর্থ্য ও ইচ্ছাশক্তি দেওয়া হয়েছে। যার দরুণ তাদের ওপর সাজা (শাস্তি) ও জাযা (পুরস্কার) বর্তায়।
মুমিনের ভরসাস্থল আল্লাহ তাআলা
যাহোক, আমাদের আজকের মূল আলোচনা হল, মুমিনের ভরসাস্থল আল্লাহ তাআলা। পার্থিব জগতকে সাজানো হয়েছে মানুষের পরীক্ষার জন্য। এখানে যত জিনিস বা সৃষ্টির ক্ষমতা ও শক্তি দেখা যাচ্ছে তার সবগুলোও আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি! এমন নয় যে বাতাস আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন আর বাতাসের ক্ষমতা বা কার্যাবলী অন্য কেউ সৃষ্টি করেছেন। বরং সবকিছু যেমন আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি, তাদের ক্ষমতাও আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি।
পার্থিব জগতের পরীক্ষা
পার্থিব জগতের পরীক্ষার অন্যতম হল, মানুষ তার মূল বিশ্বাসটি কোথায় স্থাপন করে, এটা দেখা। যে মানুষের দৃষ্টি সৃষ্টির ওপর এমনভাবে যে, সৃষ্টিরই নিজস্ব ক্ষমতা আছে সব করার, সে প্রকৃত মুমিন নয়। পক্ষান্তরে, যে মানুষের দৃষ্টি সৃষ্টির ওপর বাহ্যত থাকলেও, বিশ্বাসের পূর্ণ বিষয়টি আছে আল্লাহ তাআলার ওপর, সে মুমিন। বিশ্বাসের বিষয়টি বাহ্যত কারো যদি হালকাও হয়, কিন্তু সতর্ক করে দিলে সে যদি বলে, আমি আল্লাহর ক্ষমতাকেই আসল মনে করি, তার মুমিন হওয়াটিও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। যদি না স্পষ্টভাবে এমন কিছু সে প্রকাশ না করে ,যদ্দরুণ তাকে কাফের সাব্যস্ত করা যায়।
আমাদের মুমিন হিসেবেই দুনিয়াতে জীবনযাপন করতে হবে ও মুমিন হিসেবেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। তা না হলে কিন্তু আমাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন ভয়াবহ হবে! গায়রুল্লাহ, তথা আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুর ‘নিজস্ব ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার’ বিশ্বাসকে অস্বীকার করতে হবে। সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, সবকিছুর ওপর স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে পূর্ণ ক্ষমতাবান, একচ্ছত্র অধিপতি একমাত্র আল্লাহ।
মুমিনের বিশ্বাস
আল্লাহ তাআলা পুরো জগত ও তার ভেতর যাবতীয় কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর পুরো সৃষ্টিজগত তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তাই মুমিন যে বস্তু বা সৃষ্টিকেই যেকোনো কাজে ব্যবহার করবে, মুমিনের অন্তর্দৃষ্টি থাকে আল্লাহ তাআলার দিকে। এটা সহজভাবে এভাবে যে, আমি তো এই বস্তু বা পথ অবলম্বন করছি কিন্তু এসব তাদবীর বা চেষ্টার অন্তরালে আছেন আল্লাহ, বিদ্যমান রয়েছে তাঁর ইচ্ছা, তাঁর ক্ষমতা ও তাঁর হুকুম। কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহ তাআলা কোনো ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে তিনি সেই ক্ষমতাকে ছিনিয়ে নিতে পারেন, করতে পারেন অকার্যকর। তাই মুমিন কখনো চেষ্টা-তাদবীরকে ভরসাস্থল সাব্যস্ত করে না। চেষ্টা-তাদবীর যার আদেশে সে করে, সেই সত্ত্বাকে ভরসাস্থল সাব্যস্ত করে থাকে। এটিই খাঁটি মুমিনের অন্যতম পরিচয়।
বিশ্বাস ও কর্মপন্থায় মুমিন ও কাফেরের চির-দ্বন্দ্ব
এখানে এ কথাও উল্লেখ করা জরুরি যে, চেষ্টা-তাদবীরের নীতিমালাও আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন। তার সীমা-পরিসীমাও শরিয়তের মাধ্যমে আমাদেরকে জানানো হয়েছে। এ সম্পর্কিত মূল শিক্ষা আল্লাহ তাআলার রাসূল ও সাহাবায়েকেরাম বাস্তবে প্রয়োগ করে কেয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে গেছেন।
‘দারুল আসবাব’ বা আসবাবের বাড়ি এ দুনিয়া। এটি তো আল্লাহ তাআলারই ফয়সালা! মেঘ ও গাছ ছায়া দিচ্ছে, খাবার খেয়ে মানুষ শক্তি সঞ্চয় করছে — এমন যত বিষয় রয়েছে এটাকে কে অস্বীকার করছে? কিন্তু এ নীতির প্রবর্তক কে আর এ নীতির মূলকথা ও অন্তর্নিহিত বিশ্বাস কী, এ নিয়ে মুমিন ও কাফেরের দ্বন্দ্ব।
উভয়ের ঠিকানা বা গন্তব্য ভিন্ন
কাফেররা ধৃষ্টতায় এত অগ্রসর হয়েছে যে, তারা তাদের ক্ষমতা, শক্তি ও সৌর্য-বীর্যকে খোদায়ী শক্তি-তুল্য মনে করে! সৃষ্টি হয়ে সৃষ্টিকর্তার মতন হাবভাব দেখানোই যেখানে চরম ধৃষ্টতা, সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করা, তাঁর দেওয়া ক্ষমতাকে নিজস্ব বলে বিশ্বাস করা আর তাঁর অবাধ্যতার কাজে নিয়োজিত থাকা — সবই কুফরি। এর পরিণাম না দুনিয়াতে ভালো না আখেরাতে! দুনিয়াতে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকে দিব্যি এই কুফরির পথে জমে আছে। এ অবস্থায় মৃুত্যু হলে চিরকাল জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
চিন্তা করুন! একজন মুমিন আল্লাহ তাআলা ও তাঁর হুকুম-আহকামের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেই চির জান্নাতি হওয়ার উপযোগী হয়ে যায়। শর্ত হলে মৃত্যু-অবধি এ বিশ্বাস নিয়েই তাকে কবরে যেতে হবে! এই অমূল্য বিশ্বাসটিই ঈমান।
****
জানাযার দোআ ঈমানদারের জন্যই। জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ঈমানদারের জন্যই। এক কথায়, আখেরাতে মুক্তি ঈমানদারেরই! চির সফলতা তাই শুধুই ঈমানদারের।
Last Updated on March 21, 2023 @ 12:50 pm by IslamInLife বাংলা