হক-বাতিলের সংঘর্ষ চিরন্তন: যে উপলব্ধি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে
এই ভূপৃষ্ঠে হক ও বাতিলের সংঘর্ষ প্রাচীনতম। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবুয়তের প্রথম হক ও বাতিলের সংঘাত ছিল বদরের জিহাদ। বাতিল চরমভাবে পরাজিত হয়েছিল, লাঞ্ছিত হয়েছিল। চূড়ান্ত যে সংঘাতটি হবে, সেটিও হক ও বাতিলের মধ্যেই হবে। বাতিল আবারও চরমভাবে পরাজিত হবে, লাঞ্ছিত হবে। এটি আল্লাহ তাআলার ফয়সালা! (তাই এখানে ইনশাআল্লাহ বলা জরুরি নয়)।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
وَقُلْ جَاء الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
অর্থ: বলুন, সত্য (অর্থাৎ, হক যখনই) এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল। সূরা বনী-ইসরাঈল – ১৭:৮১
যুগে ও কালে কেবল দুটি দলই বিদ্যমান ছিল ও থাকবে। একটি আল্লাহর। অপরটি শয়তানের। যখনই শ্বাশত সত্যের আহ্বানকারীগণ (নবী ও রাসূলগণ অথবা তাদের উত্তরসূরীগণ) তাদের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন, মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। মানুষের বিশ্বাস ও কাজ তাকে মৌলিকভাবে যেকোনো এক দিকে ধাবিত করেছে। হয় সত্যকে গ্রহণ করেছে অথবা সত্যকে প্রত্যাখান করেছে। লক্ষ করুন, আল্লাহ তআলা কিভাবে তাঁর ফয়সালাকে প্রকাশ করেছেন — দুই দলের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন (কুরআনুল হাকীম বলছে):
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ تَوَلَّوْا قَوْمًا غَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِم مَّا هُم مِّنكُمْ وَلَا مِنْهُمْ وَيَحْلِفُونَ عَلَى الْكَذِبِ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
অর্থ: আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেননি, যারা আল্লাহর গযবে নিপতিত সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করে? তারা মুসলমানদের দলভুক্ত নয় এবং তাদেরও দলভূক্ত নয়। তারা জেনেশুনে মিথ্যা বিষয়ে শপথ করে।
أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا إِنَّهُمْ سَاء مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
অর্থ: আল্লাহ তাদের জন্যে কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। নিশ্চয় তারা যা করে, খুবই মন্দ।
اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَن سَبِيلِ اللَّهِ فَلَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ
অর্থ: তারা তাদের শপথকে ঢাল করে রেখেছেন, অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা প্রদান করে। অতএব, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।
لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُم مِّنَ اللَّهِ شَيْئًا أُوْلَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
অর্থ: আল্লাহর কবল থেকে তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদেরকে মোটেই বাঁচাতে পারবেনা। তারাই জাহান্নামের অধিবাসী তথায় তারা চিরকাল থাকবে।
يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ جَمِيعًا فَيَحْلِفُونَ لَهُ كَمَا يَحْلِفُونَ لَكُمْ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ عَلَى شَيْءٍ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْكَاذِبُونَ
অর্থ: যেদিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। অতঃপর তারা আল্লাহর সামনে শপথ করবে, যেমন তোমাদের সামনে শপথ করে। তারা মনে করবে যে, তারা কিছু সৎপথে আছে। সাবধান, তারাই তো আসল মিথ্যাবাদী।
اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ أُوْلَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ
অর্থ: শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নিয়েছে, অতঃপর আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।
إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُوْلَئِكَ فِي الأَذَلِّينَ
অর্থ: নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তারাই লাঞ্ছিতদের দলভূক্ত।
كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
অর্থ: আল্লাহ লিখে দিয়েছেন: আমি এবং আমার রাসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।
لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءهُمْ أَوْ أَبْنَاءهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُوْلَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٍ مِّنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُوْلَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
অর্থ: যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। সূরা মুজাদালাহ – ৫৮:১৪-২২
অতএব, হক ও বাতিলের দুই দলকে আল্লাহ তাআলা এভাবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।
যারা এমনটা মনে করে, পৃথিবীতে বাতিলের সম্পূর্ণভাবে মূলোৎপাটন সম্ভব, সেটা আসলে ভুল। অবশ্য ইনসাফ তথা ন্যায়ের শাসন অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু বাতিল, মিথ্যা ও বিপথের পথিকেরা সবসময় এ পৃথিবীতে থাকবে। তারা নিজেরা বিপথে থেকে অন্যদেরকে বিপথে আহ্বান করে যাবে। অনেক মুসলমানেরা পর্যন্ত অজ্ঞতাবশতঃ এ ধরণের কথা বলেন, আল্লাহ চান একটি মানুষও যেন জাহান্নামে না যায়। এসব অজ্ঞ ভাইদের কাছে আমাদের প্রশ্ন, এমনটি আল্লাহ চেয়েছেন সেটা কিভাবে জানলেন?! আল্লাহ তাআলা এমন বলে থাকলে কি তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবে না (নাউযুবিল্লাহ)?!
বরং দেখুন আল্লাহ তাআলা কী জানিয়েছেন:
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلاَ أَوْلاَدُهُم مِّنَ اللّهِ شَيْئًا وَأُولَـئِكَ هُمْ وَقُودُ النَّارِ
অর্থ: যারা কুফুরী করে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর সামনে কখনও কাজে আসবে না। আর তারাই হচ্ছে দোযখের ইন্ধন। সূরা আলে ইমরান – ৩:১০
وَعَدَ الله الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيمٌ
অর্থ: ওয়াদা করেছেন আল্লাহ তাআলা, মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারীদের আর কাফেরদের জন্য দোযখের আগুনের — সেখানে তারা পড়ে থাকবে সর্বদা। সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব। সূরা তাওবা – ৯:৬৮
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أُوْلَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ
অর্থ: যারা কাফের — হোক আহলে-কিতাব, হোক মুশরিক — নিশ্চয় তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির সবচেয়ে অধম। সূরা বাইয়্যেনাহ – ৯৮:৬
ওপরের আয়াতগুলো থেকে এটি সুস্পষ্ট যে কাফেররা তাদের কুফর্-এর জন্য মহা-লাঞ্ছিত, চরম হতভাগ্য, ব্যর্থ ও চির-জাহান্নামী।
কোনো সন্দেহ নেই, আল্লাহ তাআলার বান্দা হিসেবে অন্য বান্দাগণের প্রতি মায়া-মমতা-দরদ থাকা খুব বড় গুণ। কিন্তু তাতে সীমারেখা থাকা চাই। এমন কথা মনে করা, উপরন্তু না জেনে এমন কথা বলা — আল্লাহ চান একটি মানুষও যেন জাহান্নামে না যায় — সম্পূর্ণ অনুচিত। এ জাতীয় কথা বলা কখনো উচিত নয় যার অর্থ স্পষ্ট নয়, যা কিনা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। আল্লাহ তাআলার শানে যেকোনো কথা বলার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা খুব জরুরি!
ইবলিস তার দলবল নিয়ে জাহান্নামে যাবে। যারা ইবলিসের অনুসরণ করবে তারা ওর দলেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। এটিই খোদায়ী ফয়সালা। সূরা ইবরাহীমে কেয়ামতের ময়দানের এ দৃশ্য স্পষ্ট তুলে ধরা হয়েছে:
وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الأَمْرُ إِنَّ اللّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدتُّكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُم مِّن سُلْطَانٍ إِلاَّ أَن دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي فَلاَ تَلُومُونِي وَلُومُواْ أَنفُسَكُم مَّا أَنَاْ بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنتُمْ بِمُصْرِخِيَّ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِن قَبْلُ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থ: যখন সব ফয়াসলা হয়ে যাবে শয়তান তখন বলবে: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি, অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোন ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এতটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি, অতঃপর তোমরা আমার কথা মেনে নিয়েছ। অতএব তোমরা আমাকে ভর্ৎসনা করো না এবং নিজেদেরকেই ভর্ৎসনা কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্যকারী নই। এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতোপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে, আমি তা অস্বীকার করি। নিশ্চয় যারা জালেম তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। সূরা ইবরাহীম – ১৪:২২
আল্লাহ তাআলা চাইলে সব পারেন, একটি কথা — অবশ্যই শতভাগ সত্য — কোনো সন্দেহ নেই । আর তাঁর চাওয়া কী-কোনটি, সেটি আরেক বিষয়, তাতে অধিকার চর্চা কার সাধ্য?! হাঁ অবশ্য যে বিষয় আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, যার কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, আয়াতে মুতাশাবিহাতও (এমন আয়াত, যাঁর অর্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট করা হয়নি) নয়, সেটি তো স্পষ্টই! ঠিক যেমন উপরে উল্লেখিত আয়াত সমূহের অর্থ দিনের আলোর মতন স্পষ্ট।
বলছিলাম, হক ও বাতিলের সংঘর্ষের কথা। এটি সবসময় ছিল ও থাকবে। কারণ হকের প্রকাশ ঘটবে, প্রচার-প্রসার হবে, হক বুলন্দ হতে থাকবে। বাতিল হকের পথে বাঁধা দিবে, সদাসর্বদা হকের বিস্তার রোধ করবে। হক বাতিলের সামনে মাথা নত করবে না। বাতিল নিজ স্বভাবে একগুঁয়েমি করে যাবে। জুলুমের পথে অনড় থাকবে, মিথ্যার প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সদা তার স্কীম বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাবে। হক বাতিলের মুকাবেলায় দৃঢ়পদ থাকবে, সব ধরণের বাতিল স্কীমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তাই সত্য ও মিথ্যার সংঘাত হবেই, এটি অনিবার্য। একে বন্ধ করা অসম্ভব। এই ভূপৃষ্ঠে হক না-হকের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী, সুনিশ্চিত, অবধারিত।
আমাদের বুঝতে হবে সত্য কী। সত্য হল, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবী-রাসূলগণ যা কিছু এনেছেন। তারপর উনাদের উপযুক্ত উত্তরসূরীগণ সেটিই বহন করেছেন, সেটির প্রচার-প্রসার করেছেন। এর বাইরে যত পথ ও মত, যারা যেকোনো উপায়ে সত্যের বিরোধিতা করে, তারা বাহ্যত যত সুন্দর হোক, সবই অসত্য ও বাতিল। এক কথায়, সত্যের বিপরীত সবই বাতিল, মিথ্যা।
আল্লাহ পাকের বিরোধিতা করে শয়তানের অনুসারীরা ভূপৃষ্ঠে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এদের প্রচার ও আধিপত্য যেহেতু শয়তানের অনুসরণে হয় তাই এদের সবকিছুর মূলে মিথ্যা, অন্যায় ও জুলুম থাকে। যে কেউ এদের সফলতার ভাগিদার হতে চায়, সেও কোনো না কোনোভাবে মিথ্যা, অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়ে পড়বে। বাতিল শুধু মিথ্যা অবলম্বনকারীদের রসদ যোগায়। আল্লাহ তাআলা এদের সম্পর্কেই বলেছেন:
ذَرْهُمْ يَأْكُلُواْ وَيَتَمَتَّعُواْ وَيُلْهِهِمُ الأَمَلُ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
অর্থ: আপনি ছেড়ে দিন তাদেরকে, খেয়ে নিক এবং ভোগ করে নিক আর আশায় ব্যাপৃত (রত) থাকুক। অতি সত্বর তারা জেনে নেবে। সূরা হিজর – ১৫:৩
অতএব বোঝা গেল, হক ও বাতিলের সংঘর্ষে কেউ যখন বাতিলের পক্ষ নেয়, যত মত, যুক্তি, মানবতার কথা তারা বলে, সবই মিথ্যা, স্বার্থপরতা, অন্যায়, জুলুম সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে। কারণ, সেখানে উদ্দেশ্যই মন্দ! যারা সত্য ও মিথ্যা মিশ্রিত করে, অথবা সত্যকেই মিথ্যা বলে আর মিথ্যাকে সত্য বলে, তাদের কাছে তো আছে কেবল নিজ মতলব — মনের চাহিদা! না তাদের আছে কোনো দ্বীন-ধর্ম, না আছে সঠিক কোনো উপলব্ধি! সত্য-মিথ্যা পৃথক করার মানদন্ড তাদের একটাই — নিজেদের মনগড়া কথা, মনগড়া তত্ত্ব। কারণ তারা স্বার্থান্বেষী ও দুনিয়ার ক্ষমতা, লোভ-লালসায় বুদ।
এই সমগ্র জগৎ যাঁর, তাঁর অধিকারেই সবকিছু। সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড একমাত্র তাঁরটি গ্রহণযোগ্য, তাঁরটিই সঠিক। সত্য বা অসত্য কী, এটি তাঁর পক্ষ থেকে সুচারুভাবে নির্ধারিত। নবী-রাসূলগণ যে এসেছিলেন, তারা নিজেরা কিছু বলেননি বা জানাননি। নিজস্ব কোনো পথ অথবা মতের দিকে উনারা কেউ আহ্বান করেননি। যে হকের কথা বলেছেন ও যে হক প্রতিষ্ঠার মিশনে উনারা এসেছেন, তা আল্লাহ প্রদত্ত। নবী রাসূলগণের উত্তরসূরীগণ একই বিষয়ের তাবলীগ ও তালীম দিয়ে থাকেন। এর বিপরীতে যে বা যারাই অবস্থান নিয়েছে সব বাতিল বলে গণ্য হয়েছে, হবে।
যুগে আর কালে বাতিল মাথাচাড়া দেয় আল্লাহ তাআলার আইন ও নিয়ম উৎপাটনের জন্য। হক ও সত্যের আহ্বানকারী ও অনুসারীদের সাথে এদের সব দ্বন্দ্ব, সবসময় দ্বন্দ্ব। কিন্তু আল্লাহ তাআলার আইন ও নিয়ম উৎপাটনের প্রচেষ্টায় এরা কেবল বাহ্যিক কিছু সফলতা দেখে। হক ও সত্যের আহ্বানকারী ও অনুসারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-যুদ্ধ করে এরা কখনো প্রকৃত বিজয় লাভ করে না। এটি প্রতিটি মুমিন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে থাকে। এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
অর্থ: আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে। সূরা আলে ইমরান – ৩:১৩৯
বর্তমানে ও আগেও যত হক ও বাতিলের সংঘর্ষ ও টক্কর লেগেছে, বাতিল খুব দাপট আর দম্ভ প্রদর্শন করছে, করে যাচ্ছে। বাস্তবতা কখনোই তা নয় যেটা আমরা কেবল বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখি আর শুনি! রক্তপাত, বোমাবর্ষণ এক জিনিস আর ফলাফল ও পরিণতি আরেক জিনিস। মুসলমানদের উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি একরকম আর কাফেরদের আরেক। মুসলমান যে জিহাদ করে তাতে শত্রুপক্ষের মহিলা, শিশু আর বৃদ্ধদের নিধনের কোনো পরিকল্পনাই থাকে না। তাই তাদের কৌশল ও সমর অমুসলিমদের মত নয়। আল্লাহর জন্য যুদ্ধ, রক্তপাত ঘটানো, শত্রুর উপর আঘাত হানা আর মন-পূজারীদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য, কৌশল, সমরনীতি কখনো এক নয়। দুইয়ের পরিণতি এক হওয়ার প্রশ্নই উঠে না!
বাতিলের তান্ডব দেখে মুমিন মর্মাহত হয়, মহাকষ্টে পতিত হয়। কিন্তু এর অর্থ এ নয়, মুমিন হত-বিহবল, হতাশ-নিরাশ! আরে আল্লাহর জমিনে তাঁর বিরুদ্ধে কে কত শক্তি প্রদর্শন করবে?! প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ তাআলার মুকাবিলায় কারো প্রয়োজন নেই। জিহাদের মতন নেক কাজ দান করে তো আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক বান্দাগণকে সম্মানিত করেছেন! দুনিয়ার অবস্থা, কাজ — এসবের এক নিয়ম রেখেছেন তিনি। কারণ, দুনিয়া পরীক্ষার জায়গা। এখানে সুযোগ ও সময় দেওয়া হয়েছে। এটিই পরীক্ষা! যারা পরীক্ষা স্থলের বাহ্যিক কিছু দৃশ্যপট দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছে, তারা বুদ্ধিমান নয়। আজ মুসলমানদের হয়েছে এ অবস্থা! আমরা বাহ্যিক দর্শনে বিচারে নেমে হিতাহিত শূণ্য হচ্ছি। নিশ্চয় মুসলমানদের জন্য দুঃখের অনেক কিছু রয়েছে।মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের ও কষ্টের হল, আজ মুসলামানেরা — আমরা গুনাহ ছাড়ছি না। আল্লাহ তাআলার নাফরমানি ত্যাগ করছি না। কাফেরদের জন্য তো দুনিয়া গুনাহ করার সুযোগের স্থান, আর মুমিনদের জন্য দুনিয়া গুনাহ ত্যাগ করে জান্নাতে যাওয়ার প্রস্তুতির স্থান। কাফেররা দুনিয়াতে গুনাহ করে দুনিয়াতেই লাঞ্ছিত হবে। আর মুমিনগণ এখানে গুনাহ ত্যাগ করে আল্লাহ তাআলার দেওয়া সম্মান দুনিয়াতেই অর্জন করবে। তারপরও দুনিয়াতে কষ্ট-মুসীবত সবার কিছু না কিছু থাকবেই। কিন্তু শেষ পরিণতি মুমিনদের জন্য সবসময় ভালো হবে আর কাফেরদের জন্য তা সবসময় খারাপ। আখেরাতের পরিণতি যে চূড়ান্ত ও চিরকালের ভালো বা মন্দ — সেটি প্রত্যেক ঈমানদারেরই দৃঢ় বিশ্বাস!
মুসলমান যদি তার নিজের পরিচয় ঠিক রেখে জেগে ওঠে, আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি তাদেরই পক্ষে আছে। ইখলাস, সবর, তাকওয়া গুণগুলো এমন যে, মানুষের ব্যক্তি জীবনে এগুলোর যেমন গুরুত্ব, রাষ্ট্র-পরিচালনা পর্যন্ত প্রতিটি কাজে এগুলোর তেমনই গুরুত্ব! কিন্তু আফসোস, আজ অধিকাংশ মুসলমানের ব্যক্তি জীবনেই এগুলোর হাহাকার।
যাহোক তারপরও ঈমানদার যেন হতাশ না হয়। মুসলমানকে পুনরুজ্জীবিত হতে হবে। কারণ খাঁটি মুসলমান সত্যের পক্ষে। আর আল্লাহ তাআলা সত্যকেই বিজয়ী করবেন। সব বাতিল নত হবে যখন মুমিন দৃঢ়পদ থাকবে। জিহাদের প্রতিটি ময়দান, দৃশ্য ও মুজাহিদগণ এ সাক্ষ্যই দেয়, আমাদের সঙ্গে আল্লাহর নুসরত আছে। এটি বাইরে থেকে দেখে বোঝা সম্ভব নয়, জরুরিও নয়। বরং এটি এমন বাস্তবতা, যে বিষয়ে সব যুগের কাফেররা পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছে (এর কারণ আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন সময়ে কাফেরদেরকেও গায়েবী বহু চিত্র দেখিয়ে দিয়েছেন, তারা নিজেরাই তা বর্ণনা করেছে)।
একদিকে মুমিনদেরকে আল্লাহ তাআলা উৎসাহ দিয়েছেন তোমরা এগিয়ে যাও। অন্যদিকে কাফেরদের ভয়াবহ পরিণতি জানানো হয়েছে। কিন্তু আজ বহু সংখ্যক মুসলমানদের মনে নানান সন্দেহের দোলা, চিন্তার লুকোচুরি, নানান দ্বিধা-দ্বন্দ্ব! কোথায় আল্লাহ তাআলার সাহায্য, সেই নুসরত, কোথায় আমাদের বিজয়?! আমরা হলাম মার খাওয়া, অপমানিত এক জাতি।
এমন অবস্থায় প্রতিটি ঈমানদারকে মনে রাখতে হবে, সত্য ও মিথ্যার সংঘাতে ইসলামের রক্তমাখা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। মুসলমান জুলুম করে না, যদিও সে জুলুমের শিকার হয়। আল্লাহ তাআলার নুসরত বা সাহায্য আসা পর্যন্ত তাঁর ওপর ভরসা করেই অপেক্ষমান থাকতে হয়। জীবন চলে যাবে, যাক। এর পরেও তো জীবন আছে! দুনিয়ার জীবনটিই শেষ নয়, বরং তারপরের জীবনইটি আসল!
আমরা ঈমানদার কীসের ভিত্তিতে? বাহ্যিক জয়-পরাজয়ের ভিত্তিতে নয়। বিজয়ী হওয়া অর্থ যদি দুনিয়াতে জীবিত থাকা আর ‘রাজ্য বিজয় করা’ মনে করা হয়, তাহলে এটি বিজয়ের খুব সংকীর্ণ অর্থ করা হল। এর চেয়ে কেবল শাহাদতের মৃত্যুকে খাঁটি বিজয় মনে করা অনেক উত্তম! (আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে শাহাদাতের মৃত্যু দান করুন! আমীন)
মুসলমানের মূল বিজয় হল আল্লাহ তাআলার হুকুম আহকামের ওপর আমরণ অটল থাকার মধ্যে। যে অঞ্চলের মুসলমানের যেটি করণীয় সেটি তাকে করতে হবে। আবার যে মুসলমানের যেমন প্রভাব, সেটি তাকে করতে হবে। এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকার দরুণ আমরা বিভ্রান্ত ও হতাশ বেশি হয়ে থাকি। আমার-আপনার অঞ্চলে কোন্ কাজে মনোযোগ দিলে নিজের ও উম্মতে-মুসলিমার সর্বাধিক উপকার হবে, সেদিকে মনোযোগী হয়ে কাজ করতে হবে আমাদের প্রত্যেকের। যে কাজ আমার এখতিয়ারে নেই, সে কাজ করার ক্ষমতাই তো আমার নেই! তাহলে সেটির জন্য দুঃখ করব, নাকি আমার এখতিয়ারভুক্ত কাজ করব? ঐসব নেক কাজ করতে পারছি না বলে আফসোস আসা ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই আফসোস ও দুঃখ যদি আমাকে হতাশা-নিরাশার দ্বারে পৌঁছে দেয়, তা কখনো ভালো নয়। আজ দুঃখের কবলে পড়ে অহেতুক চিন্তা আমাদেরকে অনধিকার চর্চায় ব্যস্ত করে তুলছে। অথচ অহেতুক চিন্তা করতে আমরা কেউ আদিষ্ট নই, বরং সেটা শরীয়তে নিষেধ। সাধ্যের বাইরের কাজ নিয়ে চিন্তা ও চেষ্টা-তদবীর আমাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতি ছাড়া আর কিছু বয়ে আনে না!
সর্বসাধারণ মুসলিম ও প্রভাবশালী মুসলিমদের নিজ নিজ দায়-দায়িত্ব জানা ও বোঝা উচিত। সে অনুযায়ী নিয়ত, আযম করে কাজে মনোযোগী হওয়া উচিত। এতে হায়াতে বরকত হবে ইনশাআল্লাহ। তখনই উম্মতে-মুসলিমার জন্য কাজের কাজ — কিছু হলে আমরা করে যেতে পারব আল্লাহ চাইলে!
সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিয়ে চলছেন উলামায়েকেরাম (আলেমগণ)। উনারা উম্মতের রাহবার (পথপ্রদর্শক)। কার-কখন-কী করণীয় — উনারা বলছেন। সর্বসাধারণ ও প্রভাবশালী মুসলিম — সবাইকে উনাদের শরণাপন্ন হতে হবে। উনাদের কাছ থেকে সবাইকে জানতে হবে, কার-কী করণীয়। আল্লাহ তাআলার মদদ (সাহায্য) সে পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাবে না যে পর্যন্ত আমাদের পক্ষ থেকে নিজ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করা না হবে। যারা সাধারণ, তাদের কারো জন্য শোভনীয় নয় যে, খুব দ্রুত নিজ থেকে মতামত আকারে এসব বড় বিষয়ে সিদ্ধান্তমূলক কিছু ব্যক্ত করা! আর যাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায়, তাদের জন্য শোভনীয় নয় নিশ্চুপ বসে থাকা! তাদের পক্ষ থেকে রাহবারী আর রাহনুমায়ী আসা স্বাভাবিক ও সময়ের দাবী। সেজন্য সবাইকে উলামায়েকেরামের শরণাপন্ন হতে হবে। নিজ দায়িত্ব জেনে কাজ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা সেজন্যই বলেছেন:
فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ
অর্থ: অতএব, জিজ্ঞেস কর যারা জানে (জ্ঞানীদেরকে) তাদেরকে, যদি তোমাদের জানা না থাকে। সূরা নাহল – ১৬:৪৩
বাস্তবে দেখবেন, এর চর্চা কত হ্রাস পেয়েছে! উম্মত সেজন্য কত বিভ্রান্ত ও দিক-ভ্রান্ত! আল্লাহ তাআলা আমাদের সুরক্ষা করুন। যার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য, সেগুলো সুন্দরভাবে পালনের জন্য আমরা সচেষ্ট হই ইনশাআল্লাহ!
পরিশেষে, এ নাজুক পরিস্থিতিতে, যখন কিনা বাতিল তার স্বভাবজাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠে উম্মতে-মুসলিমার নিরীহ মানুষের ওপর জঘন্য হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, আমরা সেই নিকৃষ্টতম কাজের নিন্দা জানাই, আল্লাহ তাআলার কাছে করজোড়ে ফরিয়াদ করি,
اللهم إنا نجعلك في نحورهم، ونعوذ بك من شرورهم
অর্থ: হে আল্লাহ! আমরা তোমাকে তাদের সামনে রাখি, আর তাদের অকল্যাণ থেকে তোমার আশ্রয় চাই! আমীন।
Last Updated on October 15, 2024 @ 4:07 pm by IslamInLife বাংলা