হারিম ইবনে হাইয়্যান রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ২৬ হিজরী : ৬৪৭ খৃস্টাব্দের পর)

যাঁর সমাধিতে আকাশ কেঁদেছিল। মনেপ্রাণে যিনি আল্লাহ প্রতি মনোনিবেশী ছিলেন। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা যাঁর ভালোবাসা মুমিনদের হৃদয়ে রেখাপাত করে দেন। যাঁর শিরা-উপশিরায় নবী ও রাসূলদের যুহদ ও আখেরাত-অনুরাগ সদা বিরাজমান ছিল। জীবিত থেকেও যিনি ধারণ করেছিলেন মৃতের রূপ ও হালত। আগেকার এবং অগ্রগামী সাধক ও মনীষীগণ যাঁকে নিয়ে ঈর্ষা করেন। নিজের রক্ত ও অশ্রু দিয়ে যিনি পৃথিবীকে সিঞ্চিত করেছিলেন। তিনি একাধারে বুযূর্গ, দরবেশ, পরকাল অনুরাগী, আখেরাত নিয়ে যিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিশ্বখ্যাত আটজন দরবেশদের তিনি একজন, তিনি হারিম ইবনে হাইয়্যান আল্আব্দী আল্আয্দী। বনী আবদিল কায়েস গোত্রের মুসলিম সেনাপতি। তাবেঈদী প্রধান প্রধান মনীষী ও সাধকদের একজন। তাঁকে হারিম (বুড়ো) এজন্য বলা হয় যে, তিনি তাঁর মায়ের পেটে দুই বছর ছিলেন। গর্ভকালীন সময়ে তাঁর দাঁত উঠেছিল। তিনি বনী আবদিল কায়েস গোত্রের সমর অধিনায়ক ছিলেন। দুনিয়ার ভালোবাসা তাঁর অন্তর থেকে দূরীভূত করেছিলেন। সেখানে বদ্ধমূল করেছিলেন আখেরাতের ভালোবাসা। হৃদয়গ্রাহী কথামালা তিনি বলতেন। তাঁর কথা মনে দাগ কাটতো। তিনি বলতেন, (অনুবাদ) পরকাল বাদ দিয়ে দুনিয়ার প্রতি কোন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি অধিক অনুরাগ দেখায় না। আর কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করে না।

একদিন তিনি লোকদেরকে ওয়াজে বললেন, তোমরা গুণাহগার আলেম পরিহার করে চলো। ফাসেক আলেমের সাহচর্য ত্যাগ কর। কথাটি শ্রোতাম-লীর কানে বাজল। কথায় কথায় সেটি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর কানে পৌঁছল। শোনে তিনি শঙ্কায় কেঁপে ওঠলেন। পত্র লিখলেন, ফাসেক আলেম কে? হযরত উমর রা. এর চিঠির উত্তরে হারিম ইবনে হাইয়্যান লিখলেন, আল্লাহ’র কসম! আমীরুল মুমিনীন, আমি এ কথা বলে ভাল কিছু আমার নিয়ত ছিল। হতে পারে এমন কোন রাষ্ট্রপ্রধান ইলমের ব্যাপারে কথা বলে কিন্তু কাজের বেলায় অনুরূপ করে না। এতে মানুষের মাঝে গোমরাহি ছড়াবে।
জাহান্নামের স্মরণে অজানা আতঙ্কে নিজের কলিজাটা দগ্ধ হয়েছিল। গুণাহ থেকে নিষ্কৃতি পেতে জীবন ঢেউয়ের সাথে মল্লযুদ্ধ করেছেন সবসময়। একবার আল্লাহ রাসূলের সাহাবী হযরত হুমামা আদ্দাওসী রা. দেখতে গেলেন হারিম ইবনে হাইয়্যানকে। রাতের বেলায় হারিম ইবনে হাইয়্যান কাঁদতে লাগলেন। বিলাপ করতে লাগলেন। সকাল পর্যন্ত গণ্ডদেশ ভাসিয়ে অশ্রুপাত করলেন। হযরত হুমামা আদ্দাওসী রা. বললেন, রাতভর কেন কাঁদলেন? হারিম ইবনে হাইয়্যান বললেন, স্মরণ করলাম এমন একটি রাতের, যে রাতের সকাল বেলায় আকাশের নক্ষত্রগুলো খসে পড়তে থাকবে (অর্থাৎ কেয়ামত দিবসের কথা)। এতে রাতব্যাপী মনে কান্না পেয়ে বসল। এ দু’জন এক সঙ্গে থাকতেন। কখনও চলে যেতেন বাগানের মালির কাছে। আল্লাহ তাআলার কাছে জান্নাত চাইতেন। আবার কখনও যেতেন কর্মকারের কাছে। পানাহ ও আশ্রয় চাইতেন জাহান্নাম থেকে।

হারিম ইবনে হাইয়্যান ভবঘুরে ছিলেন। রাতের বেলায় গন্তব্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকতেন। বলতেন, জাহান্নামের মতো কোন কিছু দেখিনি যা থেকে পলায়নপর ব্যক্তি না পালিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। আবার জান্নাতের মতো কোন কিছু দেখিনি যার লালায়িত ব্যক্তি আলস্যে ঘুমিয়ে রয়েছে। তিনি বলতেন, যদি বলা হয় তুমি জাহান্নামী। তারপরও আমি আমার কোন আমল ছাড়বো না। পাছে না পস্তাতে হয়। যখন হারিম নেতৃত্বের ভার নিলেন মনে করলেন যে, তাঁর গোত্রের লোকজন তাঁর কাছে আসবে। তিনি আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন। তাঁর ও গোত্রের লোকদের মাঝে আগুন প্রজ্বলিত করা হল। লোকজন জড়ো হল। তারা তাঁকে দূর থেকে সালাম দিল। তিনি বললেন, আমার কওমের লোকেরা তোমাদেরকে স্বাগতম। তোমরা আমার কাছে ঘনিয়ে আসো। তারা বলল, আমরা তো আপনার কাছে ঘনিষ্ঠ হতে পারছি না। আমাদের এবং আপনার মাঝে আগুনের অন্তরায়। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে এর চেয়ে বড় আগুন জাহান্নামের আগুনে ফেলতে চাও। এ কথা শোনে গোত্রের লোকেরা চলে গেল।

এক যুদ্ধে হযরত হারিম ইবনে হাইয়্যান জখম হলেন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে তুলে আনা হল। একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় লোকজন তাঁর কাছে হাজির হল। তারা তাকে বলতে লাগলো, আপনি ওসিয়ত করুন। তিনি ক্ষীণ আওয়াজে বললেন, তোমরা আমার লৌহবর্ম বিক্রি করে আমার ঋণ পরিশোধ কর। এতে ঋণ পরিশোধ না হলে আমার ক্রীতদাস বিক্রি করে দাও। তোমাদেরকে সূরা নাহলের শেষের আয়াতগুলো আমল করার ওসিয়ত করছি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

ادْعُإِلَىسَبِيلِرَبِّكَبِالْحِكْمَةِوَالْمَوْعِظَةِالْحَسَنَةِوَجَادِلْهُمْبِالَّتِيهِيَأَحْسَنُإِنَّرَبَّكَهُوَأَعْلَمُبِمَنْضَلَّعَنْسَبِيلِهِوَهُوَأَعْلَمُبِالْمُهْتَدِينَ () وَإِنْعَاقَبْتُمْفَعَاقِبُوابِمِثْلِمَاعُوقِبْتُمْبِهِوَلَئِنْصَبَرْتُمْلَهُوَخَيْرٌلِلصَّابِرِينَ ()
‘আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করেন হেকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়। আপনার প্রতিপালক, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়, সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি সবিশেষ অবহিত। যদি তোমরা শাস্তি দাওই, তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দিবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্যধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য তাই উত্তম।’ (সূরা নাহল, আয়াত : ১২৫-১২৬)

গ্রীষ্মের এক দিনে তিনি চলে গেলেন আল্লাহ তাআলার দরবারে। পাড়ি জমালেন পরলোকে। দাফন শেষে এক টুকরা মেঘ এসে তাঁর সমাধি বরাবর অবস্থান করে বৃষ্টি বর্ষণ করে ফোঁটায় ফোঁটায়। এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও সমাধি অতিক্রম করলো না। বৃষ্টির পানি তাঁর সমাধিতে ঘাস গজালো।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it