সুলাইমান তাইমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৪৩ হিজরী : ৭৬০ খৃস্টাব্দ)
একটি নক্ষত্র। যার দীপ্তমান আলো দুনিয়াবিরাগীদের আকাশে ঠিকরে পড়েছে। দুনিয়ার ফিরিশতাদের একজন। আনুগত্য আর ইবাদতের আলোয় যাঁর হৃদয় আলোকসজ্জিত। আমল আর ধর্মকর্ম করে যিনি গুনাহের চারণভূমি এড়িয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন মহান আল্লাহ তাআলার নৈকট্যের খোঁজে। তিনি শাইখুল ইসলাম আবুল মু’তামির সুলাইমান ইবনে তিরখান তাইমী। বসরা নগরী অধিবাসী। বিশিষ্ট বুযর্গ ও ইবাদতগুজার। বনী তামীম গোত্রের সাথে মিত্রতার সুবাদে তাইমী নামে খ্যাতি লাভ করেন। বিখ্যাত গবেষক ও মুজতাহিদ। অলৌকিক ও লোকাতীত ঘটনাসম্পন্ন ব্যক্তি। বিছানায় বিশ্রাম নিতেন না। হাদীস বিশারদ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু কাউকে পাঁচের অধিক হাদীস শোনাতেন না। ‘কাদরিয়া’ সম্প্রদায়কে বেজায় অপছন্দ করতেন। তাদের নিকটি হাদীস বর্ণনা করতেন।
যুহদ ও দুনিয়াবিরাগ সম্পর্কে যাদুময় কথা পাওয়া যায়। শ্রোতাম-লী সেগুলো অশ্রু ধরে রাখতে পারেন না। গুনাহের আঁধার থেকে আনুগত্য ও বন্দেগীর কোলে থাকতে পছন্দ করতেন। লোকদেরকে অনুপ্রাণিত করতেন এই বলে, মানুষ গুনাহ ও পাপ করে নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারে। নেকি ও পুণ্যের কাজ হৃদয়পটে আলো ও জ্যোতি সৃষ্টি করে এবং আমলে শক্তি যোগায়। পক্ষান্তরে গুনাহ হৃদয়ে অন্ধকার ও আচ্ছন্নতা সৃষ্টি করে এবং আমলের স্পৃহা নষ্ট করে।
গোটাজীবন মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি ভীতি ও লাজুকতা নিয়ে ছিলেন। বিবেকের দংশনে সবসময় দংশিত হতে থাকতেন। কাঁতরাতেন সেই তাড়নায়। হযরত ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ রহ. বলেন, সুলাইমান তাইমীর মতো খোদাভীতিতে এত বেশি সন্ত্রস্ত ব্যক্তি অন্য কাউকে আমি দেখিনি।
বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম শা’বী রহ. বলেন, সুলাইমান তাইমীর চেয়ে অধিক সত্যবাদী আমি আর দেখিনি। তিনি কোন হাদীস সরাসরি নবীজীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সূত্রে বর্ণনা করলে তার মুখম-ল রক্তিম হয়ে যেতো। এক ধরনের ভয়-ভীতির ছাপ চেহারায় ভর করতো।
ইবাদত-বন্দেগীতে তার বেশ জোরকদম ছিল। ইবাদতগুজার হিসেবে তার সুখ্যাতি মুখে মুখে। এখনও ইতিহাসের পাতায় পাতায় সেই অধ্যায় আলোকোজ্জ্বল। যার ইবাদত-তৎপরতা এখনও ইতিহাসে ধ্বনিত হয়। তার ছেলে পিতার সীরাত ও ইবাদত সম্পর্কে সামান্য বর্ণনা দিচ্ছেন, চল্লিশ ধরে আব্বাজান একদিন পরপর রোযা রাখতেন। ইশার উযূ দিয়ে ফজরের নামায পড়তেন।
কারামাত ও অলৌকিক ঘটনাবলীর জনক। কানে কানে সেগুলো এখনও তাজা। মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সেগুলো। বর্ণনায় জনশ্রুতি রয়েছে যে, একবার তিনি তার এক বন্ধু থেকে পরিধানের উদ্দেশ্যে পশমওয়ালা একটি পাকা চামড়া ধার নিয়েছিলেন। প্রয়োজন সেরে তিনি সেটা ফিরিয়ে দিলেন। মালিক বলেছেন যে, আমি সর্বদা সেই চামড়া থেকে কস্তুরির ঘ্রাণ পেতাম।
ইবনে সালামা বলেন, সুলাইমান তাইমী বিশ বছর ধরে বিছানায় পিঠ (বা পার্শ্বদেশ) লাগাননি। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজের জীবন ও জীবনকাল বিক্রি করেছিলেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি ইবাদতের মধুরতায় আছেন। আল্লাহ তাআলার নৈকট্যের চাদর পরিহিত এক সফল ব্যক্তি। মহান এই সাধকের কথা তারই এক বন্ধু বর্ণনায় বলছেন, সুলাইমান তাইমী প্রতিটি ঘন্টায় ঘন্টায় দান করতেন। দান করার মতো কোন কিছু না থাকলে দু’রাকাত নামায পড়তেন।
হাম্মাদ ইবনে সালামা রহ. বলেন, সুলাইমান তাইমী রহ. এর নিকট যখনই এসেছি তখনই তাকে আল্লাহ তাআলার সেই মুহূর্তের আমলে নিমগ্ন থাকতে দেখিছি। নামাযের সময় হলে নামাযে মশগুল দেখিছি। নামাযের সময় না হলে উযূতে ব্যস্ত, রোগী দেখে আসছেন, জানাযায় চলছেন কিংবা মসজিদে বসে তাসবীহ পাঠ করতে দেখিছি। এক লোকটি গুনাহের ভয়ে হৃদয়কে দগ্ধ করেছিলেন। তাই সর্বদা ইস্তেগফার পড়তেন।
সুলাইমান তাইমী ঋণে জর্জরিত এক ব্যক্তি। তাই সর্বদা ইস্তেগফার নিয়ে ব্যস্ত। জনৈক ব্যক্তি বললো, আল্লাহ তাআলার কাছে ঋণের পরিশোধের দোআ করুন। তিনি বললেন, আগে তিনি আমার গুনাহ মাফ করে দিন। দুনিয়ার কোন ইমারত বানাননি। দুনিয়া সঞ্চয় করেননি। একদিন থাকার ঘরটির ছাদ ভেঙে পড়ে যায়। কেউ কেউ বলল, নির্মাণ করে নিন। তিনি বললেন, আগামী দিনের মৃত্যুর বিষয়টা আরও দ্রুত। একথা বলে তাঁবু বানিয়ে আমৃত্যু সেখানেই কাটিয়ে দেন।
সুলাইমান তাইমী রহ. অসুস্থ। মৃত্যুশয্যায় তিনি শায়িত। প্রাণ ওষ্ঠাগত। মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি কাঁদলেন। চোখের পানিতে কাপড় ভিজালেন। জিজ্ঞাসিত হলেন, কেন কাঁদেন? মৃত্যুর ভয়ে? অশ্রু মুছে বললেন, না। এজন্য কাঁদিনি। তবে একবার এক ‘কাদরিয়া’ মতাদর্শের লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে (ভুলে) সালাম দিয়েছিলাম। ভয় হচ্ছে, না জানি মাওলা (প্রভু) সেটার হিসাব চেয়ে বসেন।
এ কথা বলে নিজের ছেলেকে ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন। মু’তামির! রহমতের হাদীসগুলো আমাকে শোনাও। এভাবে মৃত্যুকালে এবং মৃত্যুর পর মাওলার সাথে রহমতের আশা নিয়ে দেখা করতে পারি। মুসলিম ইতিহাসের স্মরণীয় ও বরণীয় এই মহান মনীষী হিজরী ১৪৩ সালে বসরা নগরীতে মারা যান।