সিলাতুবনু আশ্ইয়াম رحمة الله عليه (মৃ. ৭৬ হিজরী : ৬৯৫ খৃস্টাব্দ)
যাহিদ। দুনিয়াত্যাগী। জগতবিরাগী ব্যক্তি। নামায পড়ার সময় সিংহ যাঁর প্রহরী। যাঁর কথায় সাড়া দেয় সিংহ। যাঁর নিষেধাজ্ঞায় সিংহ শিকার করা থেকে বিরত থাকে। হাসিমুখে যিনি শাহাদাত গ্রহণ করে নিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় সময়ের ঘন্টা বেজে উঠল। ইসলাম যাকে শহীদদের সাথে নিয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দান করে। শহীদের মিছিলে যিনি আছেন। তিনি আবুস্ সাহ্বা সিলাতুবনু আশইয়াম আদওভী ওয়ালবসরী। যুহদ ও দুনিয়াত্যাগের এক জীবন্ত বাগান। তিমির রাতের ইবাদতগুজার। দিনের বেলায় অশ্বারোহী। অতুলনীয় ও অনুপম এক ব্যক্তি। সেরা তাবেঈদের একজন প্রথিতযশা ব্যক্তি। তাঁর গুণাবলী অবর্ণনীয়। বর্ণনাতীত বিশেষণে তিনি বিশেষিত। দুনিয়ার মূল্যে তিনি জান্নাতী রমণীকে গ্রহণ করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ঈমানে যাঁর হৃদয়টা কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। মাবুদের কাছে যা আছে সেগুলোর প্রতি তিনি বেশি আস্থাশীল। খোদাভীতির লেলিহান আগুনে যাঁর হৃদয় দগ্ধ হতে থাকতো সর্বদা। সন্তুষ্টির সূর্যালোক ছড়িয়ে যাঁর দুনিয়া আলোকিত। সর্বত্র কেঁপে উঠল শোক সংবাদে। এক লোক আসল। ইবনে আশইয়ামের কর্ণকুহরে দিল কঠিন এক সংবাদ। বলল, ইবনে আশইয়াম, তোমার ভাই মারা গেছে। ইবনে আশাইয়াম (নিয়তি-বিশ্বাস অনুযায়ী) সন্তুষ্টি-ভাষায় ইন্নালিল্লাহি….পড়ে বললেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ তো আমি আগেই পেয়েছি। আল্লাহ তাআলা তো আগেই বলেছেন, (আপনি তো মরণশীল এবং তারাও মরণশীল।) (সূরা যুমার, আয়াত: ৩০)
রাতের বেলায় অন্ধকার ছেয়ে যায়। জগতে আঁধারের পর্দা পড়ে যায়। লোকজন বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন তিনি দুনিয়ার টেনশন থেকে বাঁচতে নামাযে মশগুল হয়ে পড়েন। কখনও শয্যায় বিশ্রাম নিতে এলেও তিনি চুপিসারে আসেন।
জাফর ইবনে যায়েদ বর্ণনা দিচ্ছেন, মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীর সাথে আমরা আফগানিস্তানের কাবুল অভিযানে বের হলাম। সেই কাফেলার সাথে সিলাতুবনু আশইয়ামও ছিলেন। রাতের বেলায় যখন অন্ধকার ছেয়ে যায়, আমরা পথিমধ্যে, ইতোমধ্যে যাত্রাবিরতির ঘোষণা হয়ে যায়, মুজাহিদ বাহিনী সামান্য আহারও গ্রহণ করে নেয় এবং এসার নামায পড়ে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যার যার হাওদায় চলে যায় তখন সিলাতুবনু আশইয়ামকে দেখলাম, তিনি অন্যদের ন্যায় হাওদায় গেলেন। অন্যরা যেভাবে গা এলিয়ে দিলেন তিনি সেভাবে গা এলিয়ে শোয়ে পড়লেন। আমি এ অবস্থা দেখে মনে মনে বললাম, কোথায় তাঁর ইবাদত-বন্দেগী? যার কথা মানুষের মুখে মুখে? জনশ্রুতি রয়েছে যে, রাত জেগে নামায পড়তে পড়তে তাঁর পদযুগল নাকি ফুলে যায় (!) পরে মনে মনে বললাম, আজ আমি সারা রাত লক্ষ্য রাখবো আসলে তিনি আবেদ কিনা। জনরবের হকিকত আজ আমি দেখে নেবো।
কী বিস্ময়!! মুসলিম সৈন্যবাহিনী ঘুমের কোলে ঢলে পড়তে না পড়তেই তিনি শয্যা ত্যাগ করলেন। সৈন্যবাহিনীর অস্থায়ী লোকালয় ছেড়ে চলে গেলেন পার্শ্ববর্তী একটি বনজঙ্গলে। আমিও তাঁর পেছনে চললাম। লক্ষ্য করলাম, ঝোপটিতে মানুষের আনাগোনা হয়নি বহু বছর ধরে। পথ-ঘাট নেই। মানুষের পদচিহ্নের লেশমাত্র নেই। ঝোপের অনেক ভেতরে গিয়ে কিবলা ঠিক করলেন। নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। একদম স্তব্ধ ও নিথর শরীর নিয়ে তিনি তখন নামাযে দণ্ডায়মান। মনে বড় প্রশান্তি তাঁর। বুনো পরিবেশে তিনি যেন পরিচয়ের স্বাদ অনুভব করছেন।
তিনি নামাযে ব্যস্ত। এমন সময় বনের পূর্বপ্রান্ত হতে উদয় হল এক সিংহ। সিংহ নেমে আসছে এ কথা নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে ভয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। সিংহের থাবা থেকে বাঁচতে আমি একটি উঁচু গাছে চড়ে গেলাম। সিংহ ধীরে ধীরে সিলাতুবনু আশইয়ামের কাছে ঘনিয়ে আসল। সকাল পর্যন্ত তিনি নামাযেই মশগুল। সিংহ তাঁর পাশেই রয়েছে। তিনি সে দিকে তাকিয়েও দেখেননি। সিংহ নিয়ে সামান্য মাথা ব্যথা নেই। কোন পাত্তাই দিলেন না সিংহকে। যখন তিনি সেজদায় গেলেন আমার মনে হল, এই বুঝি তিনি সিংহের শিকার হতে চলেছেন!
তিনি সিজদা হতে উঠলেন। সিংহ তাঁর সামনে আছে। কেমন যেন সিংহ ইতস্তত করছে। সালাম ফিরিয়ে সিংহ দেখে ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, হে হিংস্র প্রাণী! অন্যত্র রিযিক খোঁজ করো। সিংহ ঠোঁট নেড়ে কি যেন বলল। আমি তা শোনতে পাইনি। পরে দেখলাম, সিংহটি ধীরসুস্থে চলে গেল। যে পথ ধরে এসেছিল ঠিক সেই পথ ধরেই চলে গেল।
ইতিহাসের স্মরণশক্তি কখনও ভুলতে পারবে না ইবনে আশইয়াম পরিবেষ্টিত যুহদ ও তাকওয়ার বৃত্তকে। মহান এই ব্যক্তিত্বের বীরত্ব ও সাহসিকতায় শত্রুবাহিনীর মনোবল মাঠে মারা যায়। মেষ-ছাগলের পালে সিংহের গর্জনে যে অবস্থা সৃষ্টি হয় ইবনে আশইয়ামের রণহুঙ্কারও শত্রুবাহিনীর মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো। মুসলিম সেনাপতিরা তাঁকে নিজেদের সৈন্যসামন্তে যোগ করতে উদ্-গ্রীব ছিলেন।
একবার তিনি এক জিহাদে বের হলেন। যখন মুসলিম ও কাফের বাহিনী মুখোমখি হল এবং প্রতিপক্ষ বাহিনীর ঝাণ্ডা নজরে এলো তখন তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। মুসলিম সৈন্যবাহিনী থেকে বের হয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন শত্রুবাহিনীর মধ্যে। বর্শা আর তরবারির আঘাতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে করতে এগিয়ে চললেন। এক পর্যায়ে শত্রুবাহিনীর অগ্রভাগ পিছু হটে। ইতোমধ্যে বহু কাফের হতাহত হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে শত্রুবাহিনীর কমান্ডার হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং মনোবলও ভেঙে যায়। বলল, মাত্র দু’জন মুসলিম সৈনিক আমাদেরকে এমন নাকানি চুবানি খাওয়ালো! সকল মুজাহিদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলে তখন কী অবস্থা হবে? চলো মুসলিম বাহিনীর সাথে সন্ধি করি। তাঁদের কথা মেনে নিয়ে সমাধানে পৌঁছাই।
ট্রান্সঅক্সিয়ানা অঞ্চলে মুসলিম যোদ্ধাদেরকে সমর অভিযানে প্রেরণ করা হয়। যাঁদের শীর্ষভাগে ইবনে আশইয়ামও ছিলেন। সাথে তাঁর ছেলে। তরবারির ঝনঝনানি, শিরচ্ছেদের হিড়িক, যুদ্ধের তীব্রতা শুরু হলে ইবনে আশইয়াম অন্তরের অন্তস্তল থেকে আওয়াজ দিলেন, বৎস, এগিয়ে যাও। আল্লাহ’র দুশমনদের সাথে জিহাদে অবতীর্ণ হও। ঐ সত্তার কাছে সওয়াবের আশা করো যাঁর কাছে কোন গচ্ছিত সম্পদ খোয়া যায় না। এই তরুণ বাপের কথায় সাড়া দিতে গিয়ে তীরের ন্যায় এগিয়ে গেল। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে শত্রুবাহিনীকে দু’ভাগ করে লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গেল। বাবার কাছে যখন ছেলের মৃত্যুর সংবাদ এলো তিনি তাঁর সাথে যোগ দিতে ছুটে গেলেন। অবশেষে লড়াই করতে করতে ঘোড়ার খুরের আঘাতে পদদলিত হয়ে ছেলের ন্যায় বাবাও শাহাদাতের সুধা পান করলেন।
পিতা-পুত্রের শাহাদাতের সংবাদ বসরা নগরীতে এলো, মহিলাগণ বোরকা পরিধান করে ইবনে আশইয়ামের স্ত্রীকে সান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে গেল তিনি ঈমানের দৃঢ়তা নিয়ে বললেন, আপনারা যদি আমাকে মোবারকবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এসে থাকেন তাহলে আপনাদেরকে স্বাগতম জানাই। আর যদি আমাকে সান্তনা বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসে থাকেন তাহলে আপনারা ফিরে যান এবং কষ্ট করে আসার জন্য উত্তম প্রতিদানে ধন্য হোন এটাই আমার আশা। হিজরী ৭৬ সালে ইবনে আশইয়াম ও তাঁর পুত্র শাহাদাত লাভ করেন।