সালামাহ বিন দীনার রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৪০ হিজরী : ৭৫৭ খৃস্টাব্দ)
শাহী দবদবা এবং উলামাদের দায়িত্ব নিয়ে যিনি চলতেন। যিনি ফল দেখে এবং অতিক্রম করার সময় বলতেন, সবর, তোমার ওয়াদা জান্নাতে। যার প্রজ্ঞাময় কথাগুলো দিবালোকের বাস্তবে ধরা দিতো। যার নামটি মানুষের রেকর্ড থেকে মর্যাদা ও অমরত্বের খাতায় অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি আবূ হাযিম সালামা ইবনে দীনার মাদানী মাখযূমী। পারস্য বংশোদ্ভূত। যাহিদ ও দুনিয়াবিমুখ। বিনয়ী ও বিনীত। যার মাতৃকুল ছিল রোমান। গোরা বর্ণের কুঁজো টেরা ও খোঁড়া ছিলেন।
অতুলনীয় এক ব্যক্তিত্ব। যুগশ্রেষ্ট অনুপম ব্যক্তি। সাহাবা কেরামের কালের সূর্য তখন মধ্যগগনে। তিনি তখন দুগ্ধশিশু। তাই তার বাল্যকাল কাটে ইলমের মজলিসে ঘুরে ঘুরে। যুহদ ও তাকওয়ার ময়দানে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সুনাম-সুখ্যাতি ছুড়ে ফেলেছিলেন বহুত দূরে। বিনয়ের আঁচলে আত্মগোপন করেছিলেন। নিদ্রা ছেড়ে বিনিদ্র। তাসবীহ ও রুকু করে যিনি কাটাতেন রাতের বেলা। দুনিয়া তার নিকট তুচ্ছাতিতুচ্ছ। মৃত্যুকে পরওয়া করতেন না। দু’ঠোঁট বেয়ে প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞবচন বের হতো। ওয়ায-নসিহত করে লোকদেরকে কাঁদাতেন। যার কণ্ঠধ্বনি তাদের মনে দাগ কাটতো। এতে তারা প্রশান্তি লাভ করতো। তিনি যাবতীয় কল্যাণের আধার ছিলেন। তার ব্যাপারে আব্দুর রহমান ইবনে যায়িদ রহ. বলেন, আবূ হাযিমের চেয়ে অন্য কাউকে আমি দেখিনি যার মুখের অতি নিকটে প্রজ্ঞা অবস্থান করে।
হযরত আউন রহ. বলেন, আবূ হাযিমের ন্যায় অন্য কাউকে দুনিয়ার নিন্দা করতে দেখিনি। ইবনে খুযাইমা রহ. বলেন, তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ ছিল না। তিনি অদ্বিতীয় ব্যক্তি। আবূ হাযিম সালামাহ ইবনে দীনার রহ. বাজারে ফল-ফলাদি দেখে বলতেন, কখনও সেগুলো খাওয়ার ইচ্ছেও হতো, তোমার প্রতিশ্রুতি জান্নাতে। জনৈক ব্যক্তি তাকে বলল, আবূ হাযিম! তোমার কী অর্থসম্পদ আছে? তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলার প্রতি আস্থা আর মানুষের কাছে রক্ষিত অর্থসম্পদের ব্যাপারে আমার অনাস্থা। (এ দু’টোই আমার পুঁজি। মানুষের ধন-সম্পদের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার যত আগ্রহ ও আস্থা-ভরসা মহান আল্লাহ তাআলার দেয়া দান ও নেয়ামতের উপর)।
তিনি লোকদেরকে উপদেশ দিতেন, নিজের গুনাহ ও পাপরাশি যেভাবে গোপন করে রাখো তার চেয়ে বেশি নেকি ও পুণ্যের কাজগুলো গোপন করে রাখো। তিনি বলতেন, যে কাজের জন্য তুমি মৃত্যুকে ভয় পাও সে কাজ তুমি কর না। এমন কাজ পরিহার করে জীবন যাপন করতে থাকলে এবং মৃত্যু হলে তোমার আর কোন ক্ষতি হবে না। একদিন তিনি মসজিদে বসে কাঁদছেন। চোখের পানি মুখম-লে মুছে দিচ্ছেন। এক ব্যক্তি তাকে বলল, আবূ হাযিম, চেহারায় কেন চোখের পানি মুঝে দিচ্ছেন? তিনি বললেন, জানতে পারলাম, খোদাভীতি থেকে নিঃসৃত চোখের পানি মানুষের শরীরের যে অংশে লাগে জাহান্নামের আগুন তা সম্পর্শ করবে না।
তিনি রিযিকের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাসের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতেন। বলতেন, দুনিয়ায় দু’টি জিনিস দেখতে পেয়েছি। একটি আমার জন্য। অন্য জিনিসটি অন্যের জন্য। অন্যের জন্য যা বরাদ্দ তা যদি আমি আমার হস্তগত করতে আকাশ ও জমিনের কৌশল ও তদবির গ্রহণ করি তবুও তা আমি হাসিল করতে পারবো না। সেটি রিযিক। একজনের ভাগ্যে যা তাই কেবল সে পাবে। একজনের নিয়তি-নির্ধারিত জিনিস কোন ধরনের ছিদ্রপথ বেয়ে তা অন্যজনের কাছে আসতে পারে না। আমার রিযিক যেমন অন্যজনের নিষিদ্ধ তেমনি অন্যজনের রিযিকও আমার জন্য নিষিদ্ধ।
তিনি বলতেন, ইবলীস কী? ইবলীস হল যার নাফরমানি করে কোন ক্ষতি হয়নি। আবার যার আনুগত্যে কোন লাভ হয়নি। তিনি বলেছেন, যখন তুমি দেখবে যে, তুমি আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করা সত্ত্বেও তিনি তোমাকে ক্রমাগত নেয়ামতরাজি দিয়েই যাচ্ছেন তখন তুমি সতর্ক হয়ে যাও। (কারণ এতে তোমাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। এই নেয়ামতের মধ্যদিয়ে তোমার পরকালের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে)।
একদিন রাষ্ট্রপ্রধান সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক হজ্বের উদ্দেশ্যে হারেম শরীফ আসেন। প্রবেশ করলেন মদীনা শরীফে। এখানে এসে তিনি জানতে চাইলেন, সাহাবা কেরামকে দেখতে পেয়েছে এমন কেউ মদীনা শরীফে আছে কি না? লোকজন বলল, হাঁ। আবূ হাযিম সালামাহ ইবনে দীনার। বাদশাহ তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আসলে বাদশাহ বললেন, আবূ হাযিম, এ কেমন রূঢ়তা? আবূ হাযিম বললেন, আমীরুল মুমিনীন, আমার মাঝে কী রূঢ়তা দেখেছেন? সুলাইমান বললেন, শীর্ষ ও মাথাওয়ালা লোকজন আমার কাছে এসেছে কিন্তু তুমি তো আসনি। নেতৃবৃন্দ আসলেও তুমি কিন্তু…
আবূ হাযিম বললেন, ইতোপূর্বে আপনার আমার পরিচয় হয়নি এবং আমিও আপনাকে দেখিনি। সুতরাং কোন্ ধরনের রূঢ়তা আপনি আমার মাঝে দেখেছেন? সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক উপস্থিত লোকদের মধ্যে থাকা ইমাম যুহরীকে লক্ষ্য করে বললেন, ঠিকই বলেছে। বস্তুত আমিই সঠিক অবস্থানে নেই। এরপর বাদশাহ বললেন, আবূ হাযিম, আমরা মৃত্যুকে কেন ভয় পাই? তিনি বললেন, আপনারা আখেরাত নষ্ট করে দুনিয়া আবাদ করেছেন। তাই আবাদ থেকে অনাবাদ এলাকায় যেতে অনিচ্ছুক। তিনি বললেন, ঠিকই বলেছেন। অতঃপর সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক রহ. বললেন, আগামীতে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজিরি কোন্ অবস্থায় হবে? আবূ হাযিম রহ. বললেন, নেককার ও সৎপরায়ণ ব্যক্তি সেই অনুপস্থিত ও আগন্তুক ব্যক্তির ন্যায় যে পরিবার-পরিজনের কাছে আগমন করছে। পক্ষান্তরে গুনাহগার ও পাপী লোক পলাতক গোলামের ন্যায় যাকে মনিবের নিকট ধরে এনে হাজির করা হচ্ছে।
এ কথা শোনে সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক রহ. কাঁদলেন। ফুঁপিয়ে খুব কান্নাকাটি করেন। এরপর তিনি বললেন, হে আবূ হাযম, মানুষের মধ্যে সর্বাধিক বুদ্ধিমান কে?
তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার সৌভাগ্য হওয়া, আমল করতে পারা এবং অন্যকে আমল করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদেরকে আমলের পথ বাতলানো।
সুলাইমান বললেন, সবচেয়ে বোকা কে?
আবূ হাযিম রহ. বললেন, যে ব্যক্তি অন্যের প্রবৃত্তির তাড়নায় নিজে রেগে বেসামাল হয়ে পড়ে। সে নিজে জালিম। দুনিয়ার জন্য আখেরাত বিক্রি করেছে।
সুলাইমান বললেন, আবূ হাযিম, আপনি আমাদেরকে আপনার সাথে থাকতে দিন। এতে আপনারও লাভ হবে আবার আমাদেরও উপকার হবে।
তিনি বললেন, না। সুলাইমান বললেন, কেন? তিনি বললেন, এতে আপনার প্রতি কিছুটা হলেও ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা করছি। এতে আল্লাহ তাআলা আমাকে ইহজীবনে দ্বিগুণ ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তি আস্বাদন করাবেন; তখন তাঁর পক্ষ থেকে আমার জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না। (একথা বলে তিনি একটি আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ৭৫ দ্রষ্টব্য)।
সুলাইমান বললেন, আবূ হাযিম, আপনার কিছু প্রয়োজনের কথা বলুন। তিনি বললেন, আপনি আমাকে জান্নাতে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্ত করুন। সুলাইমান বললেন, এটা আমার ক্ষমতার বাইরে। তিনি বললেন, এই দুইটি প্রয়োজন ছাড়া আমার অন্য কোন প্রয়োজন নেই।
আমীরুল মুমিনীন হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক মদীনা শরীফে আগমন করেছেন। তিনি মদীনায় এসে আবূ হাযিম সালামা ইবনে দীনারকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আসলেন। তখন আমীরুল মুমিনীন হিশাম বললেন, আবূ হাযিম, আপনি আমাকে নসিহত করুন। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলাকে ভয় করুন। দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ত ও অনাসক্ত হোন। কারণ দুনিয়ার হালাল জিনিসের জন্য (আখেরাতে) হিসাব নেওয়া হবে আর হারামের জিনিসের জন্য আযাব হবে।
জনৈক আমীর তাকে ডেকে পাঠালেন। তখন তার কাছে ইমাম যুহরী রহ. এর মতো বড় বড় অনেক আলেম ছিলেন। আমীর তাকে বললেন, আবূ হাযিম, কথা বলুন। তিনি বললেন, যে আমীর উলামা কেরামকে ভালোবাসে তিনিই শ্রেষ্ঠ আমীর। আর যেসব আলেম আমীরকে ভালোবাসে তারা নিকৃষ্ট আলেম। সেই আমীর বললেন, আপনার কোন প্রয়োজন থাকলে বলুন। আবূ হাযিম বললেন, না। কোন প্রয়োজন নেই। আপনার দরবারে আসার আগেই আমার যাবতীয় প্রয়োজনের কথা আল্লাহ তাআলার কাছে জানিয়েছি। তিনি আমাকে যা-ই দান করেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করেন। আর তিনি কোন প্রার্থিত কোন কিছু না দিলে তার প্রতি আমরা সন্তুষ্ট থাকি। হিজরী ১৪০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। কেউ কেউ তার ইন্তেকালের কথা আরও পরে উল্লেখ করেছেন।