রাবী ইবনে খুসাইম رحمة الله عليه (মৃ. ৬৩ হিজরী : ৬৮২ খৃস্টাব্দ)

রাসূলে আকরাম ﷺ যদি তাঁকে দেখতেন তাহলে তিনি তাঁকে অবশ্যই ভালোবাসতেন। তাঁর গুঞ্জন ছিল তাসবীহ, কথায় থাকতো আলহামদুলিল্লাহ্। উঠতে-বসতে শোনা যেতো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ এবং আল্লাহু আকবার। জাগতিক প্রেরণা ও খাহেশ হৃদয়ে বিলুপ্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। ইতিহাসের কর্ণকুহরে যুহদ ও পরকালের জয়গান গেয়েছিলেন এক তরুণ। নওলি যৌবনে যিনি চলেছিলেন তাকওয়া ও আখেরাতের প্রতি অনুরাগী হয়ে। তিনি পরহেযগার ও খোদাভীরু ব্যক্তি। যুহদ ও দুনিয়াবিমুখিতার এক আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তি, তিনি আবূ যাইদ আররবী ইবনে খুসাইম আস্সূরী রহ.। কুফা নগরীর বাসিন্দা ছিলেন। বিখ্যাত মুসলিম ব্যক্তিত্ব। প্রাজ্ঞ মুসলিম মনীষী। রাসূলে আকরাম ﷺ-এর জীবনকাল পেয়েছিলেন। সুখ্যাতির আলো বিকিরণের ভয়ে বিনয়ের কাপড় পরিধান করেছিলেন। তিনি আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. এর অন্যতম শাগরিদ ও শিষ্য। সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। যিকিরে যিকিরে নড়তো দু’ঠোঁট। দুনিয়ায় সন্তুষ্টি ও অল্পতুষ্টির পোশাকে থাকতেন। বুযূর্গদের পথ ও পাথেয় হারাননি কখনও। দারিদ্য এড়াতে বুযূর্গি ও দরবেশি গ্রহণ করেননি। তাঁর দুনিয়া বিমুখিতা ছিল নিছক নিজের আবেগতাড়িত।

আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. তাঁকে বলেছিলেন, আবূ যাইদ, রাসূলে আকরাম ﷺ তোমাকে দেখলে তিনি তোমাকে ভালবাসতেন। তিনি তোমাকে পাশে বসাতেন। একবার আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. এর শিষ্যদের কথা ইমাম শা’বী এর নিকট আলোচিত হল। তখন ইমাম শা’বী রহ. বললেন, তাঁদের মধ্যে রবীই সর্বাধিক বুযূর্গ ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তি। হযরত আলকামাহ ইবনে মারসিদ রহ. বলেন, আটজন তাবেঈ গিয়ে যুহদ ও পরকালের অনুরাগ শেষ হয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে একজন আররবী ইবনে খুসাইম রহ.।

সর্বদা যিকির ও ফিকির করতেন আখেরাত নিয়ে। ঊর্ধ্ব আকাশের দ্বারে দ্বারে যাঁর হৃদয়ের আনাগোনা ছিল। হযরত আররবী ইবনে খুসাইম রহ. এর নিকট ইবনুল কাউয়্যা এসে বসলেন। বললেন, আমাকে জানিয়ে দিন এমন এক ব্যক্তির সন্ধান যিনি আপনার চেয়ে উত্তম। তিনি বললেন, আমার চেয়ে ভাল ও উত্তম ব্যক্তি হল সেই ব্যক্তি যাঁর কথায় যিকির, ধ্যানধারণায় ফিকির, চলাফেরায় চিন্তাভাবনা। সেই লোক আমার চেয়ে উত্তম। জনৈক ব্যক্তি আররবী ইবনে খুসাইম রহ.-কে জিজ্ঞেস করল, আজ সকালটা কেমন কাটালেন? আররবী ইবনে খুসাইম রহ. বললেন, গুনাহগার অবস্থায় সকাল বেলা পার করলাম। রিযিক খেয়ে যাচ্ছি আর হায়াত শেষ করছি। তিনি যিকিরকে কলবের আহার মনে করতেন। মনের জন্য জ্যোতি ভাবতেন। একবার একটি কাফেলার নিকট দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন। তাঁকে বলা হল, বসেন গল্প করি। আররবী ইবনে খুসাইম রহ. বললেন, হৃদয়ের জন্য একটা মুহূর্ত যদি মৃত্যুস্মরণ ছাড়া অতিবাহিত হয় এতে আমার হৃদয় নষ্ট হয়ে যাবে।

আররবী ইবনে খুসাইম রহ. নামায ও রোযার জন্য লালায়িত ছিলেন। আল্লাহ তাআলার দরবারে নিশীথ রাত জেগে থাকতে উদ্গ্রীব ছিলেন। অন্য কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত ও মশগুল থাকতেন না। ইবাদত-বন্দেগী করতে করতে যখন পদযুগল ফেটে গেল তখন তিনি দু’জন মানুষের উপর ভর দিয়ে মসজিদে যেতেন। কেউ কেউ বললেন, আপনি তো ঘরে নামায পড়তে পারেন। পায়ের এমন সমস্যার কারণে তো মসজিদে না যাওয়ার অনুমতি তো আছে। তিনি বললেন, আমি তো হাইয়্যা আ’লাল ফালাহ শোনেছি। (কল্যাণের দিকে আসো) এমন আহ্বান যে শোনবে তাকে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও আসা উচিৎ।
তিনি যখন সিজদা করতেন মনে হতো বিছানো কাপড়। চড়ই পাখি (গাছ মনে করে) তাঁর উপর এসে বসতো। আত্মগোপন ব্যক্তি ছিলেন। অখ্যাত ও অজ্ঞাত হয়ে বসবাস করতে ভালোবাসতেন। সুনাম ও সুখ্যাতির পাদপ্রদীপের নিচে আসতে চাইতেন না। তাঁর কাজের বুয়া বলতো,আররবী ইবনে খুসাইম রহ. এর আমল গোপনে ছিল। কখনও এমন হতো তিনি কুরআন শরীফ নিয়েছেন তেলাওয়াত করার জন্য। এমন সময় কেউ এসে গেল। তখন তিনি তা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলতেন। নিজেকে আনুগত্যের বেত্রাঘাতে মার্জিত করেছেন। পরিশীলিত এই ব্যক্তির একবার একটা ঘোড়া হারিয়ে গেল। কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন, আপনি চোরকে বদদোআ করুন। আররবী ইবনে খুসাইম রহ. বললেন, না। বরং আমি চোরের জন্য দোআ করবো। পরক্ষণে আকাশের দিকে হাত তুলে দোআ করতে লাগলেন। হে আল্লাহ, যদি সে ধনী হয় তুমি তাকে মাফ করে দাও। আর যদি সে গরীব হয়ে থাকে তুমি তাকে ধনী করে দাও। বনী তামীম গোত্রের এক লোক বলেছে, আররবী ইবনে খুসাইম রহ. এর সাথে দশ বছর চলাফেরা করেছি। জাগতিক কোন বিষয়ে কাউকে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করতে আমি শোনিনি। তবে দু’বার এমন বিষয় শোনেছি। একবার তিনি বলেছিলেন, তোমার মা কি জীবিত? দ্বিতীয়টি হল, তোমাদের মসজিদ কয়টি?

জাহান্নামের স্মরণের কারণে তাঁর শয্যা কন্টকময় ছিল। তাঁর মেয়ে তাঁকে একটি প্রশ্ন করেছিলেন, বাবা! সবাইকে দেখি ঘুমায় কিন্তু আপনি তো ঘুমান না? তখন আররবী ইবনে খুসাইম রহ. এর চেহারাজুড়ে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে যায়। পরক্ষণে তিনি বললেন, জাহান্নাম আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। যখন তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তখন তিনি বললেন, মুমিনের জন্য মৃত্যু অপেক্ষা অন্য অদৃশ্য কোন কিছুই শ্রেষ্ঠ নয়। রোগ বেড়ে গেলে তাঁর মেয়ে কাঁদল। আররবী ইবনে খুসাইম রহ. মেয়েকে বললেন, বেটি! কেঁদো না। তুমি বল, আজ কী খুশির কথা! আজ বাবা কল্যাণের সাথে দেখা করেছে। বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে লোকজন বলল, ডাক্তার নিয়ে আসবো? তিনি বললেন, (আমাদের অনেক আগে) আ’দ, সামূদ, আসহাবে রাস্সহ বহু শতাব্দীর লোকজন বিগত হয়ে গেছে। তাদের মাঝে রোগীও ছিল এবং ডাক্তারও ছিলেন। আজ চিকিৎসা প্রদানকারী ও চিকিৎসা গ্রহণকারী কেউ নেই। বিলাপকারী ও যাঁর জন্য বিলাপ করা হয়েছিল সবার জীবন লীলাখেলা সাঙ্গ হয়ে গেছে। এ কথা বলে, কুফা নগরীতে মারা যান। তখন কুফা নগরীতে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের শাসন ছিল। হযরত হুসাইন রা. এর শাহাদাতের এক বছর পর অর্থাৎ হিজরী ৬৩ সালে তিনি মারা যান।