মুসআ’ব ইবনে উমায়ির রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৩ হিজরী : ৬২৫ খৃস্টাব্দ)
তাঁর কল্পনাও ছিল না ইতিহাস প্রজন্ম থেকে বহু প্রজন্মে তাঁর গল্প-কাহিনীর পসরা সাজাবে। বংশ পরম্পরায় শোনাবে তাঁর ত্যাগের মহিমা। একজন যুবক। অমর লোকদের ফিরিস্তিতে যাঁর নামখানি লিপিবদ্ধ। হৃদয় কণ্ঠে ধ্বনিত হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা। ঈমান ও বিশ্বাসের বীর সিপাহসালার। যাঁর কথার শব্দমালা নিঃশব্দে স্থান করে নিয়েছিল আনসার সাহাবা কেরামের হৃদয়ের মণিকোঠায়। কথাগুলো চেরাগ। যে চেরাগের আলোয় তিরোহিত হয়েছিল শিরক ও কুফরের আঁধার-জুলুমাত। তিনি হলেন মুসআ’ব বিন উমায়ির রা.। বিশ্বাসের অশ্বারোহী, ঈমানের শাহসওয়ার।
আদরের দুলাল। কুরাইশ গোত্রের আদরে লালিত-পালিত ধনীর তরুণ ছেলে। সত্যিই তিনি ছিলেন আলালের ঘরের দুলাল। পরিবারের মধ্যমণি। দেখতে যেমন সুন্দর, বুদ্ধিতেও তেমন। সকালে যা খেতেন এবং যা পরিধান করতেন বিকেলে তার পুনরাবৃত্তি হতো না। ঈমানের বাণীগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছেছিল, হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়েছিল। তাই তো তিনি রাষ্ট্র করেছিলেন ইসলামের কথাগুলো। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন নিজের ইসলাম গ্রহণের সংবাদ। প্রবেশ করলেন দারুল আরকামে। গোপনে আনাগোনা করতে লাগলেন নবীজী ﷺ-এর দরবারে। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল পরিবারের লোকজনের মাঝে। তারা তাঁকে আটকে রাখলেন। অবশেষে অবমুক্ত হয়ে পাড়ি জমালেন আবিসিনিয়ায়। সাথে অন্যান্য সাহাবা কেরাম। কিছুদিন পর আবার আসলেন মক্কা নগরী। এবার হিজরত করলেন মদীনা শরীফে। কোমল ও নাদুসনুুদুস ছিলেন। মাঝারি গড়নের। লম্বাও নয় বেঁটেও নয়। ইসলামের প্রথম দূত। দূতিয়ালি করেছিলেন ওহীর বার্তার। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি মদীনা শরীফ এলাকায় জুম’আ কায়েম করেছিলেন।
জীবনের আরাম-আয়েশ আর ভোগবিলাস ছেড়ে গ্রহণ করেছিলেন সাধনা আর দারিদ্র্য-পথ। অত্যন্ত মোটা কাপড় পরিধান করতেন। যাঁর সাধনার কথা আনসার সাহাবা কেরামের মন-মানসে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। নবীজী ﷺ সাহাবা কেরামকে নিয়ে বসে আছেন। মুক্তাঝরা কথামালা দিয়ে তাঁদের আধ্যাত্মিক পুষ্টির যোগান দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তাঁদের মাঝে আসলেন মুসআ’ব ইবনে উমাইর রা.। গায়ে জীর্ণ ছেঁড়া তালি দেওয়া জামা। জামা নয় বরং মলিন ছেঁড়াখোঁড়া বস্ত্রখণ্ড। প্রয়োজনীয় সতর ঢাকা যাচ্ছে না এমন। নবীজী ﷺ তাঁর এমন করুণ অবস্থা দেখে মায়া দেখালেন। মনের আকুলতা বোধ করলেন। নবীজী ﷺ বললেন, (অনুবাদ) তোমরা চেয়ে দেখ এই লোকটাকে। যাঁর অন্তরকে আল্লাহ তাআলা কুদরতি আলোয় আলোকিত করেছেন। আমি তাঁকে দেখেছি কেমন আদরের দুলাল ছিল। মাতাপিতার পরম আদরে লালিত সন্তান। খাবার ছিল সুস্বাদু। পরিধান করতো দামি ও সুন্দর জামাকাপড়। দু’শ দিরহাম দিয়ে কেনা জামাকাপড় সে পরিধান করতো। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আজ তাঁর এই অসহায় জীবনযাপন ও জীবনযাত্রা!
আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা.-এর নিকট খাবার আনা হল। যখন সে খাবার তাঁর সামনে রাখা হল তিনি খুব কাঁদলেন। পরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, মুসআ’ব বিন উমাইর রা. উহুদ প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন। তাঁকে কাফন দেওয়ার মতো জরুরী কাপড়বস্ত্র আমরা যোগাড় করতে পারিনি। তাঁর গায়ে ছোট্ট (ডোরাকাটা) একখানা চাদর ছিল। তাই দিয়ে কাফন দিলাম। চাদরটি এতো ছোট ছিল যে, মাথা ঢাকলে পদযুগল খুলে যেতো। পা ঢাকলে মাথা খুলে যেতো। অবশেষে রাসূলে আকরাম ﷺ বললেন, মাথা ঢেকে দাও। আর পায়ের উপর ‘ইযখির’ ঘাস দিয়ে ঢেকে দাও।
মুসআ’ব বিন উমাইর রা. বীরত্ব ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বড় নিদর্শন ছিলেন। একহাতে পতাকা তুলে ধরেছিলেন আর অন্য হাতে তরবারি চালিয়েছিলেন। উহুদ প্রান্তের হকের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন ডান হাতে। সেই হাত দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করে পতাকা ধারণ করলেন বাম হাতে। সেই হাতও যখন বিলীন হয়ে যায় দ্বীনের পতাকা সমুন্নত করে তুলে ধরে রাখলেন বাহু আর বুকের উপর। এরপর তাঁর উপর হামলে পড়ে নরপিচাশ ইবনে কামীয়াহ। আঘাত করে বর্শা দিয়ে। এভাবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্তের শেষবিন্দু দিয়ে উড়িয়েছিলেন ইসলামের সুমহান পতাকা। শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করতে করতে চলে গেলেন চিরস্থায়ী বাসস্থান জান্নাতে।