বিলাল বিন সা’দ রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১২২ হিজরী : ৭৪০ খৃস্টাব্দ)

বসরাবাসীদের মাঝে হাসান বসরী রহ. যেমন ছিলেন সিরিয়াবাসীদের মধ্যে বিলাল বিন সা’দের অবস্থান তেমন ছিল। নবীর ভাষায় ও জবানে যিনি লোকদেরকে ওয়াজ-নসিহত করতেন। যাঁর কানে খোদাভীতির ডঙ্কা ঝঙ্কৃত হতে থাকতো। ইমামুর রাব্বানী (অর্থাৎ বুযূর্গ লোকদের ইমাম)। বুযূর্গ ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তি। ওয়ায়েয ও যাহিদ। লোকদেরকে নসীহত করতেন। দুনিয়ার প্রতি অনুরাগ পোষণ করতেন না। তিনি আবূ আমের বিলাল বিন সা’দ ইবনে তামীম ইবনে আমর আলসুকূনী রহ.। দামেস্কের অধিবাসী। বিখ্যাত তাবেঈ। দামেস্কের শাইখ। জামে মসজিদের ইমাম এবং শীর্ষস্থানীয় উলামাদের একজন।

পিতার সান্নিধ্যে থাকতেন। নিজের বাবা এবং অনেক সাহাবা কেরামের থেকে ইলম অর্জন করেছেন। সিরিয়ায় যিনি বিশুদ্ধভাষী ও বাগ্মী ছিলেন। ইতিহাসের স্মৃতিতে ঝঙ্কৃত একটি কাসীদায় তিনি তাঁর জীবন-বৃত্তান্ত লিখেছেন। তিনি লোকদেরকে উপদেশ দিতেন এবং ইমামতি করতেন। সুন্দর সুন্দর গল্প শোনাতেন।

ইমাম আওযায়ী রহ. বলেন, বিলাল বিন সা’দ অপেক্ষা এমন বাগ পটু কোন ওয়ায়েয আমি কখনও দেখিনি। এমন ওয়ায়েযের কথা শুনিনি। সাতসকালের মৃদুমন্দ ঝিরঝিরে বাতাসের ন্যায় হিকমত ও প্রজ্ঞার কথাগুলো তাঁর জবানে বয়ে বেড়াতো। কথার আওয়াজ হৃদয়ে রেখাপাত করতো। তাঁর অনেক নীতিকথা ও প্রাজ্ঞবচন রয়েছে। যেমন, গুনাহ ও পাপের ক্ষুদ্রত্বের দিকে দৃষ্টিপাত কর না। কার নাফরমানি করলে সেই সত্তার বড়ত্বের দিকে খেয়াল কর। গুনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনে সুযোগ অবারিত করে দিয়েছেন আর আমরা দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছি।

বিলাল বিন সা’দ দামেস্কের অলিগলিতে ঘুরে লোকজনকে দাওয়াত দিতেন। ওয়াজ-নসিহত করতেন। দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ত হতে বলতেন। আখেরাতের প্রতি লালায়িত করতেন। সেই জগতের জন্য সতর্ক করতেন। মনে হতো, ভয়-ভীতির ডঙ্কা তাঁর কানে ঝঙ্কৃত হতে যাচ্ছে।

তিনি বলতেন, হায় আফসোস! আমার কোন আফসোস হয় না! গর্হিত কোন কাজ দেখলে কিংবা কানে কোন শ্রুতিকটু কথা আসলে চিৎকার দিয়ে বলতেন, গুনাহের কাজ গোপনে হলে তার ক্ষতি গুনাহগার পর্যন্ত সীমিত থাকে। গুনাহের কাজ প্রকাশিত হলে এবং তার প্রতিবাদ করা না হলে তার ক্ষতি সবাইকে আক্রান্ত করে। একদিন তিনি প্রবৃত্তির অনিষ্ট রোধে লোকদের মাঝে তারস্বরে বলে উঠলেন, প্রকাশ্যে আল্লাহ তাআলার বন্ধু সেজে গোপনে তাঁর দুশমন হয়ো না।

মহান এই মনীষী ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। সেগুলো ইতিহাসের চমকপ্রদ গল্প-কাহিনীর সাথে খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ। দিবারাত্রিতে তিনি এক হাজার রাকাত নামায পড়তেন। প্রচণ্ড শীতের রাতে একবার তিনি নামাযে দাঁড়ালেন। হঠাৎ তাঁকে তন্দ্রা পেয়ে বসলো। সাথে সাথে কাপড়-চোপড় নিয়ে বাড়ির পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গেলেন। এভাবে ঘুম তাড়ালেন। পরিবারের লোকজন তাঁকে কিছুটা কড়া ভাষায় বলল, এমন করছেন কেন? তিনি বললেন, জাহান্নামের পুঁজ থেকে দুনিয়ার পুকুর অনেক উত্তম।

একবার বিলাল বিন সা’দের এক পুত্রসন্তান মারা যায়। এরপর জনৈক লোক পিতা বিলাল বিন সা’দের নিকট এসে সাতাইশ টাকা পাওনা দাবি করে। হযরত বিলাল বিন সা’দ রহ. বললেন, তোমার কাছে সেই পাওনার কোন প্রমাণপত্র আছে? লোকটি বলল, না। আমার কাছে তার কোন ডকুমেন্ট নেই। বিলাল বিন সা’দ বললেন, লিখিত কোন কিছু আছে? লোকটি বলল, তাও নেই। বিলাল বিন সা’দ বললেন, তাহলে তুমি কসম খেয়ে পাওনা দাবি কর। লোকটি বলল, ঠিক আছে আমি কসম খাচ্ছি। এ কথা বলেই লোকটি কসম খেয়ে বসল। হযরত বিলাল বিন সা’দ রহ. বাড়িতে গিয়ে সাতাইশ দিনার লোকটিকে দিলেন। এরপর লোকটির চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যিই তুমি যদি আমার ছেলের নিকট পাওনা পেয়ে থাকো তাহলে আমি তা আদায় করে দিলাম। আর যদি আমার ছেলের নিকট তোমার কোন পাওনা না থাকে তাহলে এই দিনারগুলো তোমাকে দান করে দিলাম।

হযরত আওযায়ী রহ. হযরত বিলাল বিন সা’দ রহ. এর কারামত ও অলৌকিক ঘটনা শোনাচ্ছেন। তিনি বলেন, একবার লোকজনের মাঝে পানির অভাব দেখা দিল। তারা পানি চেয়ে খোলা আকাশের নিচে দোআ করতে বেরিয়ে গেল। তাদের মাঝে বিলাল ইবনে সা’দ রহ.ও আছেন। উপস্থিত লোকদের লক্ষ করে হযরত বিলাল বিন সা’দ রহ. বললেন, তোমরা গুনাহগার নও? তোমরা গুনাহের কথা স্বীকার কর না? পাপরাশির স্বীকারোক্তি তোমরা দিবে না? সবাই বলল, হাঁ, আমরা সবাই গুনাহগার। হযরত বিলাল বিন সা’দ রহ. বললেন, হে আল্লাহ! তুমি তো তোমার কিতাব-কুরআনে ইরশাদ করেছো (অনুবাদ) ‘যারা সৎকর্মপরায়ণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন কারণ নেই।’ (সূরা তাওবা, আয়াত : ৯১)। আমরা তো আমাদের গুনাহ ও পাপের স্বীকারোক্তি তোমাকে দিচ্ছি, আমরা তোমার কাছে স্বীকার করছি যে, গুনাহগার। সুতরাং তুমি আামাদেরকে মাফ করে দাও। আমাদেরকে বৃষ্টি দিয়ে পরিতৃপ্ত কর। ইমাম আওযায়ী রহ. বলেন, ঐদিন বৃষ্টি হয়েছে। আমরা পরিতৃপ্ত হয়ে বৃষ্টির পানি পেলাম। এসব কিছু ছিল হযরত বিলাল বিন সা’দ রহ. এর বরকত ও দোআ।

বাদশাহ হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের শাসনামলে বিলাল বিন সা’দ রহ. মারা যান। একশত বাইশ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it