উহাইব ইবনুল ওরদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৫৩ হিজরী : ৭৭০ খৃস্টাব্দ)
শপথ নিয়ে যিনি প্রত্যয়দীপ্ত। মাওলা দেখতে পাবে না তারে হাস্যরত। মনোরোগ চিকিৎসার উস্তাদ। আধ্যাত্মিক চিকিৎসক। শতভাগ হালাল আহার্যের বদৌলতে আল্লাহ তাআলা যার মর্যাদা সমুন্নত করেছিলেন। যুহদ ও দুনিয়াবিমুখিতার এক মুক্তা। তাকওয়ার জগতের এক মণি। মক্কা শরীফের এক ইবাদতগুজার ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি উহাইব ইবনুল ওরদ ইবনে আবিল ওরদ মাখযূমী। আসল নাম হল আব্দুল ওহ্যাব। তাসগীর বা ক্ষুদ্রতা বুঝাতে কিংবা আদর করে উহাইব বলা হতো। ইবরবাহীম ইবনে আদহাম এবং সুফইয়ান সাওরী রহ. এর সমসাময়িক ব্যক্তি। বিশাল যাহিদ ও বুযর্গ। যাদের অন্তরে তাকওয়ার দীপ্তিমান ছিল তিনি তাদেরই একজন। হালাল আহার গ্রহণ করতেন। আল্লাহ তাআলার সাথে তার ওয়াদা ছিল, আখেরাতে নিজের অবস্থান না জেনে কখনও হাসবেন না।
হযরত বিশর ইবনুল হারিয বলেন, হালাল আহার ও আহার্যের কারণে আল্লাহ তাআলা চার ব্যক্তির মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। উহাইব ইবনুল ওরদ তাদের একজন। হযরত সুফইয়ান সাওরী রহ. যখন মসজিদে হারামে হাদীসের দরস শেষ করতেন বলতেন, চলো সৌরভের কাছে যাই। (সৌরভ বলতে উহাইবকে বুঝাতেন)।
শাইখ উহাইবের নিকট দুনিয়া ছিল বাহনের মতো। দুনিয়া তার হৃদয়কে এক মুহূর্তের জন্যও দুনিয়ামুখি করতে পারেনি। দুনিয়া তার সময় চুরি করতে পারেনি। দুনিয়া বিমুখিতা বলতে কী বুঝায় এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, হাতছাড়া কোন কিছুর জন্য আফসোস না করা এবং হস্তগত কোন কিছু নিয়ে খুশি না হওয়া। তিনি দুনিয়ার নিন্দা করতে গিয়ে বলতেন, কোন মুমিন যদি দুনিয়াকে ঘৃণা নাও করে, কিন্তু দুনিয়ায় যেহেতু নাফরমানি করা হয় সেই সুবাদে দুনিয়াকে ঘৃণা করা উচিৎ।
উহাইব রহ. মানুষের কোলাহল থেকে দূরে নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকতেন। মেলামেশা কম করতেন। তিনি বলেন, পঞ্চাশ বছর ধরে মানুষের সংস্পর্শে ছিলাম। একজন মানুষও পেলাম না যে আমার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে সম্পর্ক জোড়ার মতো কাউকে দেখলাম না। আমার দোষ আড়াল করার মতো কাউকে পেলাম না। জবরদখলের পর কাউকে আমানতদার পেলাম না। সুতরাং এদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা বড় বোকামি।
উহাইব ইবনুল ওরদের জাহির বাতেন এক ছিল। তিনি লোকদেরকে ওয়ায করতেন যেন তারা গোপন ও বাহ্য সমান রাখে এবং সকল অবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে সমানভাবে স্মরণ রাখে। তিনি বলেন, প্রকাশ্যে শয়তানকে গালি দিও না। কারণ গোপনে তুমিই শয়তানের বন্ধু ও জানি দোস্ত।
উহাইব রহ. মনে করতেন, গুনাহ একটি অশুভ লক্ষণ এবং মন্দ বিষয়। এর কারণে ইবাদতের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় এবং আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ব্যাহত হয়। এই তো আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মুবারক রহ. উহাইব রহ. এর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার গুনাহে লিপ্ত সে কি ইবাদতের স্বাদ পায়? উহাইব রহ. খোদাভীতির সুবাতাস নিয়ে বললেন, না। এমন ব্যক্তি কখনও ইবাদতের মজা আস্বাদন করতে পারবে না। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি গুনাহের ইচ্ছা পোষণ করে সেও ইবাদতের মজা চাখতে পারে না।
তাকওয়ার ছড়ি তার কাঁধেই ভর করেছিল। উহাইব রহ. এর অন্তরে তাকওয়া স্থিরকৃত হয়েছিল। তাকে একাগ্রচিত্ত করেছিল হালাল আহার গ্রহণে। তিনি বলেছেন, তুমি যদি এই খুঁটির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকো তারপরও তোমার কোন লাভ হবে না। বরং ইবাদতের আগে দেখতে হবে তোমার উদরে কী প্রবেশ করছে-হালাল না হারাম? উহাইব রহ. এর তাকওয়া এমন পর্যায় পৌঁছেছিল যে, তিনি একমাত্র নিজের মালিকানা বালতি দিয়ে যমযম কূপের পানি উঠিয়ে পান করতেন।
যখন মক্কা শরীফের আকাশ-বাতাস ইলমের সৌরভে সুরভিত তখন ফুযাইল ইবনে ইয়ায, উহাইব ইবনুল ওরদ এবং আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মুবারক রহ. একসাথে বসে গল্প করছেন। কাঁচা খেজুরের কথা উঠল। উহাইব রহ. বললেন, এখানে কী কাঁচা খেজুর আছে? ইবনুল মুবারক বললেন, আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি রহম করুন, আপনি কি তা খাননি? উহাইব রহ. মাথা নেড়ে নেতিবাচক সাড়া দিলেন। মুখে বললেন, না। ইবনুল মুবারক রহ. বললেন, কেন? তিনি বললেন, জানতে পেরেছি মক্কা শরীফ এলাকার অধিকাংশ খেজুর বাগান বেওয়ারিশ এবং জায়গিরদারির প্রথায় মালিকানাভুক্ত। সেজন্য আমার কাছে সেগুলো অপছন্দ। ইবনুল মুবারক রহ. বললেন, আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি রহম করুন, বাজার থেকেও কেনার অনুমতি নেই? মিসর থেকে যে গম আসে সেগুলোর অধিকাংশও তো এমন মালিকানাভুক্ত। তাহলে আপনি গমও খেতে পারবেন না? একথা শোন উহাইব রহ. বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। ফুযাইল রহ. বললেন, তুমি কী করলে? ইবনুল মুবারক রহ.বললেন, আমি তো জানতাম না যে, রাজ্যের খোদাভীতি তার মধ্যেই নিহিত।
উহাইবের ভয় কাটলো। আপতিত বিপদ দূর হল। বললেন, ইবনুল মুবারক, আমাকে তোমার ছাড় থেকে অবমুক্ত কর। আল্লাহ কসম, আমি গমের তৈরী কোন কিছুই খাবো না। নিরুপায় হলে ভিন্ন কথা। এভাবে না খেতে না খেতে তার শরীর কঙ্কালসার হয়ে যায়। খুব দুর্বল শীর্ণকায় হয়ে পড়েন।
একবার আসরের আযান হল। আবূ সালিহ নামায পড়তে মসজিদে প্রবেশ করলেন। কাতারে দাঁড়ালেন হযরত উহাইব রহ. এর পাশে। নামায শেষে উহাইব রহ.কে রোনাজারি করে দোআ করতে দেখলেন। তিনি বলছেন, হে আল্লাহ! আমি যদি এই নামাযের কোন কিছু বাড়াই বা হ্রাস করে থাকি মাফ করে দিন। আবূ সালিহ বলেন, (মনে হয় তিনি নামায পড়ে) মারাত্মক কোন গুনাহের কাজ করেছেন। তাই তিনি ইস্তেগফার করছেন। হিজরী ১৫৩ সালে তিনি মক্কা শরীফে মারা যান।