ইউনুস ইবনে উবাইদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৩৯ হিজরী : ৭৫৬ হিজরী)

নবী ও রাসূলের মেধা ও মনন নিয়ে যিনি আল্লাহ তাআলার সাথে দেখা করার উপক্রম হয়েছিলেন। যার নামটি আকাশের সবকটি দোআরে নাড়া দিয়েছিল। পৃথিবীতে যিনি ছিলেন যুহদ পাঠশালার অন্যতম পথিকৃৎ। দেখলে মনে হতো রাজা-বাদশাহদের জাঁকজমক নিয়ে প্রতাপশালী আবার নবী ও রাসূলদের মতোই বিনয়ী। যাহিদ, দুনিয়াবিমুখ। দুনিয়ার সিংহাসন যিনি মাটি দিয়ে ধূলিসাৎ করেছিলেন। তিনি আবূ আব্দুল্লাহ্ ইউনুস ইবনে উবাইদ ইবনে দীনার বসরী। বসরা নগরীর অধিবাসী। মনীবের বংশসূত্রে তিনি ছিলেন আবদী।
নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী। হাফিযে হাদীস। হযরত হাসান বসরীর সংশ্রবপ্রাপ্ত। কাপড় বিক্রি করতেন। যাঁর যুহদ ও তাকওয়া ছিল অতুলনীয়। বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়তেন। সত্য ও হকের জন্য যাঁর সাহায্যের হাত সবসময় সম্প্রসারিত ছিল। তীব্র লড়াইয়ের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনী তার নাম আলোচনা করে সাহায্য লাভ করতেন।
হযরত ইউনুস ইবনে উবাইদ রহ. খুব বিনয়ী ছিলেন। স্তুতি-স্তাবকতা পছন্দ করতেন না। খোদাভীতি ও দুঃখ-মনস্তাপের শেকল দিয়ে বেঁধেছিলেন আত্মগরিমা। একদিন একলোক তার তারিফ করে বসে। তার মর্যাদা ও গুণাবলীর কথা বারবার আওড়াতে থাকে। শাইখ ইউনুস ইবনে উবাইদ রহ. নিজের মানহানি করার জন্য বললেন, আমি একশত ভালো গুণের কথা জানি। সেগুলোর কোন একটিও আমার মাঝে নেই।
জনৈক ব্যক্তি তার কাছে নসিহতের আবেদন করে। তিনি তাকে বললেন, আমার থেকে তিনটি উপদেশ গ্রহণ কর। কুরআন শেখানোর জন্য হলেও রাজা-বাদশাহ’র দরবারে নিকট কেউ যাবে না। কোন নারীর সাথে একান্তে মিলিত হবে না তাকে কুরআন হিফয করানোর উদ্দেশ্যে হলেও। প্রবৃত্তিপূজারীদের কোন কথা শোনবে না।
অবিরামভাবে তিনি লোকদেরকে হালাল রিযিকের ব্যাপারে নসিহত করে বেড়াতেন। তিনি তাদেরকে বৈধ উপার্জনের অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি বলতেন, ধরুন, এখানে দুটি দিরহাম রয়েছে। একটি দিরহাম তুমি নিলে। বৈধ হলে তোমার জন্য নেওয়া হালাল। আরেকটি দিরহাম, এটি তোমাকে আদায় করতে হবে, এটি খোদার বিধান। তুমি আদায় করে দিলে। বেশি অর্থকড়ি তো এ জন্যই।
তিনি বলতেন, দুটি জিনিস যদি কারও ঠিক হয়ে যায় অন্য সবকিছুও ঠিক হয়ে যাবে। একটি তার নামায দ্বিতীয়টি তার জবান। ইউনুস বিন উবাইদের তাকওয়া গৌরবের বিষয় ছিল। তিনি আদর্শ অনুকরণীয় মুত্তাকী ছিলেন। তিনি বলতেন, মানুষের তাকওয়ার তার কথায় চেনা যায়। তিনি কাপড় বিক্রি করতেন। একবার একলোক তার কাছে একটি কাপড়ের সন্ধানে আসে। কাজের লোক কাপড় দেখায়। ইউনুস তাকে বললেন, কাপড়টি খোল। কাজের লোকটি কাপড় খোলল। কাজের ছেলেটি হাতের মধ্যে হাত মেরে প্রশংসারছলে বলল, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইউনুস তাকওয়ার তাগিদে বললেন, কাপড় তুলে নাও। বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানালেন। কারণ এরই মধ্যে কাপড়ের প্রশংসা হয়ে গেছে। (অর্থাৎ কাজের লোকটি কাপড়টি খোলার সময় দরূদ শরীফ পাঠ করেছে যা গ্রাহককে বিশ্বস্ততার প্রতি আমন্ত্রণ করার নামান্তর)।
একবার ইউনুস রহ. নিজের একটি বকরী নিয়ে ছাগল পালের মালিকের নিকট গেলেন। লোকটি বলল, বকরীটি আমার কাছে বিক্রি করুন। তিনি বিক্রি করার আগে বকরী আয়েব ও দোষত্রুটি জানিয়ে দিলেন।
দ্বিপ্রহরের প্রাক্কালে সিরীয় একলোক কাপড়িয়া পট্টিতে আসে। এক পর্যায়ে সে শাইখ ইউনুস রহ. এর দোকানে এসে যায়। সিরীয় লোকটি বলল, চারশ’ দেরহাম মূল্যমানের কোন কাপড় আপনার কাছে আছে? শাইখ ইউনুস রহ. বললেন, না। বরং দুইশ’ দিরহামের কাপড় আছে। এরই মধ্যে আযান শুরু হয়ে যায়। আযান শোনে তিনি মসজিদে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে ইমামতি করলেন। নামায শেষ করে এসে দেখেন (দুইশত দিরহামের) সেই কাপড়টিই তার ভাগিনা চারশত দিরহামে বিক্রি করেছে। নামায শেষে এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই চারশত দিনার কীসের? সিরীয় লোকটি বলল, সেই কাপড়ের মূল্য!! শাইখ ইউনুস রহ. বললেন, আল্লাহ’র বান্দা! যে কাপড়টি আমি তোমাকে দেখিয়েছি সেটার মূল্য দুইশত দিনার। সেটা নিলে দুইশত দিনারে নাও। আর বাকি দুইশত দিনার ফেরত নাও। আর না নিলে কাপড় রেখে তোমার দেরহাম তুমি নিতে পার।
সিরীয় লোকটি বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল, তুমি কে? শাইখ ইউনুস রহ. বললেন, আমি একজন মুসলমান। লোকটি বলল, খোদার দোহাই লাগে তুমি কে এবং তোমার নাম কী?
শাইখ ইউনুস রহ. বললেন, আমার নাম ইউনুস ইবনে উবাইদ। সিরীয় লোকটি আনন্দ ও খুশির স্ফূর্তি ছড়িয়ে বলল, আল্লাহ’র কসম! আমরা দুশমনের বেড়াজালে আটকে ছিলাম। বিপদসঙ্কুল অবস্থায় আমরা এভাবে দোআ করতাম, ‘হে আল্লাহ! হে ইউনুসের প্রতিপালক! আমার বিপদ দূর কর। বিপদসঙ্কুল থেকে আমাদেরকে উদ্ধার কর।’ ঠিকই এভাবে আমাদের সমস্যা ও বিপদ দূর হয়ে যেতো।
ইউনুস ইবনে উবাইদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পীড়িত হয়ে শয্যাশায়িত। লোকজন তাঁকে দেখতে আসতে থাকে। আইয়্যূব সিখতিয়ানী রহ. তাঁকে বললেন, আপনি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর (আমাদের) বেঁচে থাকায় কোন কল্যাণও নেই। এরপর ইউনুস ইবনে উবাইদ রহ. নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। কাঁদলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আবূ আব্দুল্লাহ্! কাঁদেন কেন? ইউনুস রহ. বললেন, আমাদের পদযুগল আল্লাহ’র পথে ধূলাময় হয়নি। জিহাদে গিয়ে ধূলিলিপ্ত হয়নি আমাদের পদযুগল। এরপর বলতে লাগলেন, যে ব্যক্তি জাহান্নামী হওয়ার আশঙ্কা না করবে সে প্রতারিত। তার ব্যাপারে আল্লাহর কৌশল নিরাপদ। (বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ব্যতীত কেউই আল্লাহ’র কৌশল হতে নিরাপদ মনে করে না। সূরা আরাফ, আয়াত : ৯৯)। একথা বলে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। হিজরী ১৩৯ সালে তিনি মারা যান।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it