আবূ মুসলিম খাউলানী رحمة الله عليه (মৃ. ৬২ হিজরী : ৬৮১ খৃস্টাব্দ)

হযরত ঈসা তনয় মারইয়াম আলাইহিস সালামের জান্নাত-সঙ্গী। মুহাম্মাদ ﷺ-এর অনুসরণের পাশাপাশি হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের মু’জিযা যাঁর মাঝে সমাহার হয়েছিল। সিরিয়া ভূণ্ডখণ্ডের ফুল এবং যাহিদ লোকদের প্রধান ব্যক্তি। ভালো ও কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন। মর্যাদার কোন কিছু নজরে পড়ামাত্রই তা নিজে আপ্ত করেছিলেন। রণ-হুঙ্কার সানাই-ধ্বনির চেয়ে বেশি ছিল। তিনি হাকীমুল ইসলাম আব্দুল্লাহ্ ইবনে সুওয়াব আলখাউলানী রহ.। তাবেঈ, নির্ভরযোগ্য ফকীহ, আবেদ ও পরহেযগার। ইয়েমেন বংশোদ্ভূত। জাহিলী ও ইসলামী উভয় যুগের তিনি মুখাযরিম বা কালের সাক্ষী। মহানবী ﷺ-এর পরলোকগমনের পূর্বে মুসলমান হয়েছিলেন। হযরত আবূ বকর রা. এর শাসনামলে মদীনায় আগমন করেছিলেন। এরপর সিরিয়া হিজরত করে চলে যান। যাঁর সীরাত ও জীবন লোকাতীত ঘটনা বা মু’জিযার সাথে মিলে যায়। যেখানে যেতেন সেখানেই কারামাত তাঁকে ঘিরে রাখতো। সর্বত্র বিরাজমান ছিল তাঁর অলৌকিক ঘটনাবলী। নিত্যসঙ্গী ছিল তাঁর সংগ্রাম-সাধনা।

ইয়েমেন দেশে উৎপন্ন নব্য ভণ্ড আসওয়াদে আনাসী নবুওতীর দাবি করে বসে। এতে তিনি ভীষণভাবে চটে যান। তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় আবূ মুসলিম আলখাউলানীকে আগুনে ফেলা হয়। কিন্তু তাতে কোন ক্ষতি হয়নি। বরং তিনি আগুন থেকে নিরাপদ বেরিয়ে আসেন। সমর অভিযানে আবূ মুসলিম আলখাউলানীকে সম্মুখে নিয়োজিত করা হয়। এতে সেনাপতি আশাবাদী হয়ে ওঠেন।

ইয়েমেন দেশে আসওয়াদে আনাসী নবুওয়তীর দাবি করে। শয়তান তার কর্মকাণ্ড শোভিত করে তোলে। মিথ্যা নবুওত দাবীদার আসওয়াদে আনাসী ডেকে আবূ মুসলিমকে পাঠান। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহ’র রাসূল? তিনি প্রশান্ত হৃদয়-উৎসারিত কণ্ঠে বললেন, হাঁ। আসওয়াদে আনাসী আবার প্রশ্ন করল, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, আমি আল্লাহ’র রাসূল? আবূ মুসলিম বললেন, আমি কিছুই শুনতে পারছি না। আসওয়াদে আনাসী আবার প্রশ্ন রাখল। আবূ মুসলিমও একই উত্তর দিলেন। আবূ মুসলিমের প্রতিটি কথা আসওয়াদে আনাসীর গায়ে কাঁটার ন্যায় বিঁধতে লাগে এবং তার মর্যাদায় আঘাত করতে থাকে। আসওয়াদে আনাসী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে মনের জ্বালায় দগ্ধ হয়ে বিশাল অগ্নিকাণ্ড প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেয়। আগুন জ্বালানো হল এবং তাতে আবূ মুসলিম আলখাউলানীকে নিক্ষিপ্ত করা হল। কিন্তু সেই আগুনে তাঁর কোন ক্ষতি হল না। তিনি আগুন থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসলেন।

যখন আবূ মুসলিম আলখাউলানী রহ. আগুনের কুণ্ডলী থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসলেন এবং এই মু’জিযা মিথ্যা নবুওতী দাবীদার আসওয়াদে আনাসীর জন্য হিতে বিপরীত হল তখন তার সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে পরামর্শ দিলো আপনি যদি ওকে (আবূ মুসলিমকে) এদেশে থাকতে দেন সে আপনার সর্বনাশ করে ফেলবে। এই পরামর্শ পেয়ে আসওয়াদে আনাসী আবূ মুসলিমকে দেশান্তরিত করে দিলো। আবূ মুসলিম আলখাউলানী রহ. ইয়েমেন ছেড়ে মদীনা শরীফে এসে গেলেন। তখন নবীজী ﷺ দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেন এবং হযরত আবূ বকর রা. তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে দেশ পরিচালনা করছেন। আবূ মুসলিম আলখাউলানী মদীনা আগমন করে মসজিদে নববীর একটা স্তম্ভের পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে লাগলেন। হযরত উমর রা. আবূ মুসলিমকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি বললেন, ইয়েমেন। উমর রা. বললেন, আল্লাহ’র দুশমন (ভণ্ড নবুওয়াতের দাবীদার আসওয়াদে আনাসী) যাঁকে আগুনে ফেলেছিল তাঁর অবস্থা? আগুনে তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি। আপনি তাঁর সম্পর্কে কিছু বলুন। আবূ মুসলিম নিজের পরিচয় গোপন করার উদ্দেশ্যে বললেন, তিনি তো আব্দুল্লাহ্ ইবনে সুওয়াব। হযরত উমর রা. বললেন, আমি আপনাকে আল্লাহ’র কসম দিয়ে বলছি, তিনি কি আপনি? আবূ মুসলিম (অপারগ হয়ে) বললেন, তবে…হাঁ। উমর রা. কাঁদলেন। আলিঙ্গন করে কপালে চুমু খেলেন। এরপর উমর রা. আবূ মুসলিমকে হযরত আবূ বকর রা. এবং নিজের সামনে বসালেন। পরক্ষণে বললেন, প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি মৃত্যুর আগেই নবীজী ﷺ-এর উম্মত তথা উম্মতে মুহাম্মাদীর মাঝে এমন ব্যক্তিকে দেখার সৌভাগ্য দান করলেন যাঁর সাথে হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ্’র ন্যায় আচরণ করা হয়েছে।

দুনিয়ার চাকচিক্য ও শোভা-সৌন্দর্য তাঁর কাছে ঘেঁষতেও ভয় পায়। যখনই কোন ব্যক্তি আবূ মুসলিমের কাছে বসে জাগতিক আলোচনার অবতারণা করেছে তখনই তিনি তার থেকে নিজের চেহারা ঘুরিয়ে নিয়েছেন। একদিন তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন। লক্ষ্য করলেন, একটি দল জড়ো হয়ে বসে আছে। তিনি মনে করলেন, হয়তো তারা আল্লাহ তাআলার যিকিরে মশগুল। তাই তিনি সেই দলের লোকদের সাথে বসে গেলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পান, একজন বলে ওঠল, আমার গোলাম বেশ লাভ করে সফর শেষ করে এসেছে। আরেক জন বলল, আমি আমার গোলাম পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আবূ মুসলিম আলখাউলানী রহ. তাদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, সুবহানাল্লাহ্! তোমরা কি জানো, আমার আর তোমাদের দৃষ্টান্ত কী? সেই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যার প্রচুর বৃষ্টি লাভ হল। সে চেয়ে দেখে সে একটি বড় গেইটে অবস্থান করছে। সে ঐ বাড়িতে ঢুকলেই হয়। সবটুকু বৃষ্টির পানি নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বাড়িতে প্রবেশ করে দেখে বাড়ির কোন ছাদ-ই নেই। আমি তোমাদের দেখে বসলাম। আমার আশা ছিল তোমরা কোন যিকিরের মজলিসে ব্যস্ত। কিন্তু আমি শরিক হয়ে দেখি তোমরা সবাই দুনিয়াদার। দুনিয়া নিয়ে তোমাদের ব্যস্ততা।

আবূ মুসলিম আলখাউলানী রহ. অনেক বড় আবেদ ছিলেন। ইবাদত-বন্দেগী আর রোনাজারি করে সময় কাটাতেন বেশি সময়। মসজিদে একটি বেত ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। নামায ও যিকিরের প্রতি শৈথিল্য মনে হলে নিজের পায়ের গোড়ালিতে এক দু’টি বেত লাগাতেন।

একবার দুইজন লোক আবূ মুসলিম আলখাউলানীর মেহমান হয়ে তাঁরা আসলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হল, তিনি তো মসজিদে আছেন। মেহমান দু’জন মসজিদে এসে দেখলেন, তিনি নামায পড়ছেন। তারা আবূ মুসলিম আলখাউলানীর অপেক্ষা করতে লাগলো। তারা গোনে গোনে অনুমান করলো যে, একটি রুকুর সময়ে তিনশ থেকে চারশ রাকাত নামায পড়া যাবে। আবূ মুসলিম আলখাউলানী নামায শেষ করলেন। তারা বললেন, আবূ মুসলিম, আমরা আপনার পেছনে বসে বসে আপনার অপেক্ষা করছিলাম। তিনি বললেন, আমি যদি জানতে পারতাম তাহলে তো আপনাদের প্রতি লক্ষ্য করতাম।

বিখ্যাত তাবেঈ আবূ মুসলিম আলখাউলানী রহ. এর অসংখ্য কারামাত ছিল। লোকাতীত সেসব কারামাত ও ঘটনা আচমকা প্রকাশ পেয়েছিল। হঠাৎ ও অনিচ্ছায় সেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। কাউকে তাক লাগানোর জন্য সেগুলো ছিল না। সুখ্যাতির জন্য বা প্রশংসা কুড়ানোর জন্য সেগুলো ছিল না। মর্যাদার শিখরে ওঠার মানসে সেগুলো দেখা দেয়নি।

একদিন তাঁর স্ত্রী তারস্বরে বলে ওঠল, আবূ মুসলিম, আমাদের আটা নেই। তিনি বললেন, তোমার কাছে কোন দিরহাম আছে? স্ত্রী বলল, মাত্র একটি দিরহাম আছে। তিনি বললেন, দিরহামটি আমাকে দাও। সাথে একটি থলেও দাও। এগুলো নিয়ে তিনি চলে গেলেন বাজারে। এমন সময় এক ভিক্ষুক আবূ মুসলিমের কাছে সেই দিরহামটি চেয়ে বসল। তিনি ভিক্ষুককে একটি দিরহাম দিলেন এবং থলে কাঠমিস্ত্রীদের কাঠের গুঁড়া দিয়ে ভরলেন। বাড়িতে এসে দরজা কড়াঘাত করলেন। মনে অস্থিরতা। স্ত্রী দরজা খুললে তিনি থলেটি দরজার সামনে রেখে দ্রুত প্রস্থান করলেন।
রাতে বাড়িতে আসলেন। স্ত্রী তাঁর সামনে কতগুলো রুটি এনে দিলেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কোথায় পেলে এসব রুটি? বিবি উত্তরে জানায়, কেন? এগুলো তো বাজার থেকে আনয়নকৃত আপনার আটার রুটি। এরপর তিনি কেঁদে কেঁদে খেতে লাগলেন।

আবূ মুসলিম আলখাউলানী রহ. যখন রোম দেশে সমর অভিযানে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হলেন রাস্তায় মুসলিম বাহিনীর সামনে একটি নদী দেখা দেয়। তিনি আল্লাহ তাআলার উপরে ভরসা করে বললেন, আল্লাহ তাআলার নাম নিয়ে পার হয়ে যাও। সর্বপ্রথম তিনি সবার সামনে অতিক্রম করে গেলেন। এরপর একে একে সবাই সেই নদীটি উতরে গেলেন। তরঙ্গায়িত একটি নদী মুসলিম বাহিনী সহজেই পার গেলেন। বেশির চেয়ে বেশি কোন কোন বাহনের হাঁটু পরিমাণ পানি ছুঁয়েছিল।

হযরত আবূ মুসলিম আলখাউলানী একবার হযরত মুয়াবিয়া রা. এর নিকট গেলেন। তখন তিনি খেলাফতের চেয়ারে বসে আছেন। লোকজন চারপাশে বসে তাঁর গুণকীর্তন করছে। আবূ মুসলিম আলখাউলানী সালাম দিয়ে বললেন, আপনি মুমিন লোকদের রক্ষা করুন। লোকজন চকিত হয়ে বিড়বিড় করতে লাগে। কেমন যেন তারা বলতে চাইছে, পাত্তা দিবেন না এসব কিছু হে আমীরুল মুমিনীন। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া রা. মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, আবূ মুসলিমকে বলতে দাও। কারণ সে বুঝেশুনেই বলছে। এরপর হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর দিকে ফিরে বললেন, আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আপনাকে গণমানুষের শাসনকার্যের দায়িত্ব প্রদান করার পর আপনার দৃষ্টান্ত সেই ব্যক্তির ন্যায় যে একজন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে নিজের মেষ-ছাগলের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তার পারিশ্রমিক ধার্য করে শর্ত আরোপ করেছে যে, এইসব মেষ-ছাগলের রাখালি, দেখাশোনা এবং সেগুলোর শারীরিক যত্নআত্তি ও পশমের বর্ধনসহ রকমারি আয়োজন যথাযথভাবে করতে হবে। যদি সে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করে। এক পর্যায়ে ছোট পশুগুলো বড় হয়ে ওঠে, ক্ষীণ ও দুর্বলকায় পশু মোটা হয়ে যায় এবং রোগা পশুগুলো সুস্থ ও স্বাস্থ্যসম্পন্ন হয়ে যায় তাহলে সে তার নির্ধারিত পারিশ্রমিক পাবে এবং (পারিতোষিক হিসেবে) একটু বেশিও পাবে। পক্ষান্তরে সে যদি সেগুলোর রাখালি ভালোভাবে না করে এবং অযত্নে ফেলে রাখে; যার কারণে ক্ষীণকায় পশুগুলো মারা যায়, মোটা ও স্বাস্থ্যসম্পন্ন পশুগুলো আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে, পশমগুলো ঝরে যায় এবং দুধ শুকিয়ে যায় তাহলে সে তার নির্ধারিত বেতন পাবে না। মালিক তার উপর চটে যাবে এবং প্রয়োজনে শাস্তিও ভোগ করতে হবে। (হে আমীরে মুয়াবিয়া রা.) আপনি আপনার বিষয়ে যা ভালো মনে করেন সেটাই গ্রহণ করুন। আখেরাতের সওয়াব ও প্রতিদান পাওয়া যাবে যে তরিকায় সেটাই অবলম্বন করুন।
এ কথা শোনে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রা. মাথা ওঠালেন। বললেন, আবূ মুসলিম! আল্লাহ তাআলা আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে এবং প্রজাকুলের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমাদের জানা মতে, আপনি একজন হিতাকাঙ্ক্ষী লোক। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ﷺ এবং সাধারণ মুসলমানের জন্য আপনি একজন সত্যিকার অর্থে শুভানুধ্যায়ী মানুষ।
ভোর রাতে মুসলিম বাহিনী রোম সাম্রাজ্য থেকে অভিযান শেষ করে ফিরে আসলেন। হিমস শহর থেকে চার মাইল দূরত্বে উমাইর নামক স্থান দিয়ে অতিক্রমন করার সময় মুজাহিদ বাহিনী গির্জায় অবস্থানরত এক পাদ্রীর সাথে দেখা। পাদ্রী বললেন, তোমরা কি আবূ মুসলিম আলখাউলানীকে চেনো? মুজাহিদ বাহিনী উত্তরে বললেন, হাঁ। আমরা তাঁকে জানি। পাদ্রী বললেন, তাঁর সাথে তোমাদের দেখা হলে তাঁকে আমার সালাম জানাবে। কারণ প্রাচীন আসমানী গ্রন্থাদিতে দেখা যায় তিনি হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামের বন্ধু। তবে আমার জানা মতে তোমরা দেশে গিয়ে তাঁকে জীবিত পাবে না। (পরে দেখা গেল ঠিকই) মুজাহিদ বাহিনী যখন দামেস্কের নিকটবর্তী গাওতা এলাকায় প্রবেশ করলো তখন তাঁরা আবূ মুসলিম আলখাউলানীর মৃতু-সংবাদ শোনতে পায়।