আতা সালীমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৪০ হিজরী : ৭৫৭ খৃস্টাব্দ)

খোদাভীতি যাঁকে তাকওয়ার নিগড়ে নিগড়িত করে রেখেছিল। অশ্রুবিধৌত সমুদ্রে যাঁর হৃদয় অবগাহিত হয়েছিল। অতি কান্নাপ্রবণ ব্যক্তি। কেঁদে কেঁদে যিনি চোখের পানিতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। চল্লিশ বছর ধরে যাঁর দু’ঠোঁটে হাসির স্নিগ্ধতা স্পর্শ করেনি। ওয়ায-নসিহত তাঁর মনে খুব রেখাপাত করতো। ওয়ায শোনে বেহুঁশ হয়ে যেতেন। কেউ তাঁকে দেখলে মনে হবে দুনিয়ার মানুষ নয়। তিনি আতা আস্সালীমী আলবসরী। বুযর্গ ও ইবাদতগুজার। সবচেয়ে কমবয়সী তাবেঈ। কিন্তু মর্যাদা ও গুণে সর্বাগ্রে। হযরত আনাস বিন মালিক রা.কে দেখেছেন। হযরত হাসান বসরী রহ. থেকে হাদীস শোনেছেন। নিজে হাদীস বর্ণনা করতেন না। কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার প্রতি অতি ভীতিতে আতঙ্কিত থাকতেন। সেজন্য মজাদার পানাহার করতেন না। খোদাভীতি অতিমাত্রায় থাকায় আল্লাহ তাআলার কাছে জান্নাত না চেয়ে ক্ষমার দরখাস্ত করতেন।
জনশ্রুতি রয়েছে যে, আতা রহ. চল্লিশ ধরে শয্যায় ছিলেন। ডরে উঠতেন না এবং বের হতেন না। বিছানায় উযূ করতেন। প্রত্যেহ তিনি শরীরে হাত বুলিয়ে দেখতেন পাছে না শরীর বিকৃত হয়ে গেছে। হযরত নাঈম বিন মুআররি’ রহ. বলেন, আমরা আতা সালীমী রহ. এর নিকট আসলাম। তিনি বলতে লাগলেন, হায়! আতাকে যদি তার জননী জন্ম না দিতেন! এ কথা বার বার বলতেন। এমন কি শেষ বিকাল পর্যন্ত একথাই বলতে রইলেন।
তিনি বিনয়ী হয়ে রোনাজারি করতেন। হে আল্লাহ! দুনিয়ার নিঃসঙ্গতার ব্যাপারে আমার উপর রহম করুন। মৃত্যুর কঠিন অবস্থায় আমাকে দয়া করুন। রোজ হাশরে তোমার সামনে উপস্থিতির সময় আমাকে তোমার দোআবেষ্টিত করুন।
সবসময় তিনি খোদাভীতিতে আক্রান্ত থাকতেন। যার ফলে তিনি কুরআন শরীফ পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। এজন্য তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমার আপতিত সমস্যা লাঘবে আমার জন্য তোমরা সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ও সহজ হাদীস সংগ্রহ কর। সালিহ ইবনে মুররী রহ. তার বন্ধু আতা সালীমীকে এই প্রাণঘাতী সমস্যা থেকে উতরে উঠতে সাহায্য করতে চাইলেন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, দোস্ত! তোমাকে ইবলিশ শয়তান প্রতারিত করেছে। তুমি নামায পড়তে, উযূ করতে যে শক্তি দরকার তার জন্য কিছু পানীয় পান কর। একথা তিনি তাকে তিন দিরহাম দিলেন। বললেন, প্রত্যহ ছাতুর শরবত পান করবে। কিন্তু আতা সালীম এক দু’দিন পান তাও ছেড়ে দিয়েছে। বললেন, সালিহ, জাহান্নামের কথা মনে পড়লে আহার-আহার্য গলায় যায় না।
আতা সালীমী রহ. পাত্র থেকে আঁজলা ভরে পানি নিচ্ছেন। উযূর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ধুয়ে নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তার শরীর কাঁপতে লাগে। তিনি কাঁদতে লাগলেন। চেহারা রক্তিম। বন্ধু-বান্ধবরা শঙ্কিত হয়ে পড়লো। জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, আতা, কী সমস্যা? আপনার শরীরে এই কম্পন কেন?
হযরত আতা রহ. গ-দেশ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। তিনি বললেন, আমি আল্লাহ তাআলার সামনে হাজির হতে চাচ্ছি। আমার সামনে বড় একটি কাজ হাজির। (আখেরাতের কথা সর্বদা ভাবতে ভাবতে মনে হল এই মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজিরি দিতে যাচ্ছেন)। হযরত আলা ইবনে মুহাম্মাদ রহ. তিনি আতা সালীমী রহ. এর কাছে গেলেন। তখন তিনি বেহঁশ। পরিবারের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আতা’র কী অবস্থা? আমাদের এক প্রতিবেশী মহিলার চুলায় আগুন দেখে তিনি বেহঁশ হয়ে পড়েছেন।
হযরত সাররার ইবনে উবাদাহ রহ. আতা সালীমী রহ. এর বাড়িতে গেলেন। আতা’র স্ত্রী তাকে বলল, তিনি তো অধিক পরিমাণে কান্নাকাটি করেন। এতে তিনি আতাকে তিরস্কৃত করলেন। এরপর আতা বললেন, সাররার! তুমি আমাকে কীভাবে এমন একটি বিষয়ে তিরস্কৃত কর যার ফয়সালা আমার হাতে নেই? আমি যখন জাহান্নাম, জাহান্নামের অধিবাসী এবং তাদের আযাব নিয়ে ভাবি তখন মনে হয় জাহান্নামের শাস্তি আমার মধ্যে ধারণ করেছে। সেই মনের কী অবস্থা হয়, যার হাত গলায় বাঁধা? যাকে জাহান্নামের দিকে টেনে-হেঁচড়ে নেয়া হচ্ছে? এমন অবস্থায় সেই মন কি কাঁদবে না? চিৎকার করবে না? শাস্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তি না কেঁদে থাকতে পারে? কী বলো, সাররার! তোমার জন্য করুণা লাগে!
জনৈক ব্যক্তি হযরত আতা সালীমী রহ. এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি বললেন, কোথা থেকে এসেছো? লোকটি বলল, আপনার বন্ধু হাসান বসরীর দরবার থেকে এসেছি। হযরত আতা রহ. বললেন, হাসান বসরী কী বলেছে? লোকটি বলল, হাসান বসরী বলেছেন, ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য আখেরাতে বাহন। তার উপর সওয়ার হয়ে মুমিন তার রবের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়। তোমরা তোমাদের বাহন ঠিক করে নাও। এই বাহন তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের দরবারে পৌঁছিয়ে দিবে।’ এ কথা শোনে আতা সালীমী রহ. কাঁদতে লাগলেন। গ-দেশ বেয়ে চোখের পানি বেয়ে পড়তে লাগলো। শরীরে কম্পন শুরু হয়ে গেলো। পরক্ষণে চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। মহান এই মনীষী হিজরী ১৪০ সালে দুনিয়ার ঝুঁটঝামেলা থেকে বের হয়ে পরকালের যাত্রা শুরু করেন

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it