ইস্তেতাআত বা সামর্থ্য সম্পর্কে সঠিক আকীদা
ইস্তেতাআতের প্রথম অর্থ
মানুষের মধ্যে যে কাজ করার শক্তি ও সামর্থ্য রয়েছে তা আল্লাহ তাআলার দান। সেই অনুযায়ী আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে আদেশ করেছেন। সাধ্যের বাইরে তিনি কোনো আদেশ করেননি। এই যে সুস্থতা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অর্থ-সম্পদ, সম্মান, যোগ্যতা যেসব বান্দাকে দিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলো সবই ইস্তেতাআত বা সামর্থ্য। এসব এজন্যই দেওয়া হয়েছে যে বান্দা আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মান্য করে।
এই ইস্তেতাআতের মধ্যে বান্দার ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, একজন বান্দার প্রয়োজনীয় সুস্থতা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অর্থ-সম্পদ, সম্মান, যোগ্যতা রয়েছে। এখন সে এগুলোকে ঠিক কোথায় বা কী কাজে ব্যবহার করবে, এই ব্যাপারে সে স্বাধীন। তাকে কেউ জোর করছে না যে, তুমি এটা নেক কাজে ব্যবহার কর অথবা গুনাহের কাজে। সে চাইলে এই ইস্তেতাআতকে নেক কাজে ব্যবহার করতে পারে অথবা গুনাহের কাজে। অর্থাৎ, এই ইস্তেতাআত ব্যবহার করে মানুষ আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মান্য করতে আদিষ্ট। মান্যতার কারণে সে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। আর যদি এই ইস্তেতাআত সে ব্যবহার না করে বা তা আল্লাহ তাআলার অমান্যতা ও অবাধ্যতার কাজে ব্যবহার করে, সে আল্লাহ তাআলার অসন্তষ্টি অর্জন করবে।
এই ইস্তেতাআত সম্পর্কেই কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে:
لاَ يُكَلِّفُ اللّهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا
অর্থ: আল্লাহ তাআলা বান্দাকে তার সাধ্যের অধিক দায়িত্ব দেন না। সূরা বাকারা: ২৮৬
এই ইস্তেতাআত সেটিই যেই সামর্থ্য বান্দার মধ্যে বিদ্যমান থাকে এবং যার সাহায্যে সে কোনো কাজ করার সামর্থ্য রাখে। আরেকটি আয়াত দেখুন:
وَلِلّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً
অর্থ: আর এ ঘরের হজ্ব করা হল মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। সূরা আলে ইমরান: ৯৭
আয়াতে, “যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে” বলতে হজ্বের হুকুম তাকেই দেওয়া হয়েছে যার এই ইস্তেতাআত রয়েছে।
দেখুন মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে:
صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ لاَ يَرْجِعُونَ
অর্থ: তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না। সূরা বাকারা: ১৮
এ আয়াতে তাদেরকে বধির, মূক ও অন্ধ এজন্য বলা হয়নি যে তাদের আসলে শ্রবণশক্তি, বাকশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি নেই। আছে ঠিকই, কিন্তু তারা সেগুলোকে আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনে কাজে লাগায় না। এটি তাদের সেই ইস্তেতাআত যা তারা বিপথে কাজে লাগিয়ে ধ্বংস হচ্ছে। সেই অর্থে তাদের শ্রবণশক্তি, বাকশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি বেকার ও নিষ্ফল।
উপরের আলোচনা থেকে এ কথাটিও স্পষ্ট হল যে, বান্দার কাজ বা আমল করার আগেই এই ইস্তেতাআত তথা সামর্থ্য বান্দার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
ইস্তেতাআতের দ্বিতীয় অর্থ
বান্দা প্রথম প্রকার ইস্তেতাআত ব্যবহার করে কাজে উপনীত হওয়ার পর কাজটি সংঘটিত হওয়া বা না হওয়া আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন। কোন কর্ম সৃষ্টি হবে আর হবে না এটি সম্পূর্ণ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন। বান্দা যতকিছু ইচ্ছা আর ইন্তেজাম (আয়োজন) করুক, আল্লাহ না চাইলে কাজটি সংঘটিত হবে না। ঘটনাটি ঘটবে না। অন্যভাবে বলা যায়, বান্দার কাজ ওজুদে আসবে না অর্থাৎ, বাস্তবায়িত হবে না।
এই দ্বিতীয় ইস্তেতাআতটি আসলে কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাটির হাকিকত বা অন্তির্নিহিত বাস্তবতার নাম। যেকোনো কাজের সঙ্গেই এটির সংশ্লিষ্টতা। এই হাকিকত মানুষের সামর্থ্যের নাগালে নয়। আপনি হজ্বে যাওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছেন। এখন হজ্ব সমাপন করা’ কার্যটি আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা বা কুদরতে সম্পন্ন হবে। কেউ চুরি করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। এখন সে চুরি করতে সক্ষম হবে নাকি না সে সুনিশ্চিত জানে না। সক্ষমও হতে পারে, ধরাও পড়তে পারে।
এটিকে সাধারণভাবে কাজের ফলও বলা যেতে পারে। তাই আল্লাহ তাআলার কাছে এভাবে আবেদন বা দোআ করতে বলা হয়েছে:
رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত কর না এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা। সূরা আলে ইমরান: ৮
এখানে ‘তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত কর না’ বলে আবেদন করা হচ্ছে যে, আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলা যেন হেদায়াত-চ্যুতির ফল না দেন।
আরেক আয়াতে আছে:
خَتَمَ اللّهُ عَلَى قُلُوبِهمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ وَعَلَى أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ عظِيمٌ
অর্থ: আল্লাহ তাদের অন্তঃকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখসমূহ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। সূরা বাকারা: ৭
এখানে কাফিররা যে ঈমান আনবে না তার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, “আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন..”। এর মূল কারণ হল, তারা প্রথম প্রকারের ইস্তেতাআতকে (যেটা তাদের সামর্থ্যে ছিল) সঠিক কাজে ব্যয় করেনি, আল্লাহ তাআলার পূর্ণ নাফরমানিতে ব্যয় করেছে। এখন তাদের জন্য এই খারাপ পরিণতি অবধারিত হয়েছে।
ইস্তেতাআতের তৃতীয় অর্থ
এটি এমন একটি ইস্তেতাআত যা কেবল আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাদের দেন। ঈমান না আনার কারণে কাফেররা এ থেকে চির বঞ্চিত থাকে। বিশেষ নেয়ামতসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত।
এটাই ইস্তেতাআতের সেই অর্থ, যাকে বলা হয় আল্লাহ তাআলার তাওফীক। এটি মুমিনদের জন্য নির্দিষ্ট। একে আল্লাহ তাআলার ফযলও বলে।
এ তাওফীকের কথাই কুরআনে এভাবে আছে:
وَمَا تَوْفِيقِي إِلاَّ بِاللّهِ
অর্থ: আল্লাহ তাআলার তাওফীক ছাড়া কোনো তাওফীক নেই। সূরা হুদ: ৮৮
إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاء
অর্থ: ফযল আল্লাহরই হাতে; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। সূরা আলে ইমরান: ৭৩
Last Updated on March 21, 2023 @ 10:42 am by IslamInLife বাংলা