অশনি সংকেত: ফিরে না এলে করুণ পরিণতি
আজ সর্বসাধারণ মুসলমানদের মাঝে জেহালত তথা দ্বীনি মূর্খতা চরম আকার ধারণ করেছে। এটা প্রকাশ পাচ্ছে নানাভাবে। একেবারে খালি চোখে এর অনেক উদাহরণ সামনে। অতীব দুঃখজনক সত্য এটাই যে, অনেক মুসলমান আজ ইসলামের ফরয ইলম অর্জন করেনি। আর তা যে করেনি, এ ব্যাপারে তারা উদাসীন। না তওবা করছে, না সেজন্য সাধারণ পর্যায়ের অনুতাপ আছে! ফলে তারা নিজের জ্ঞানে যা আসে তা-ই বলছে, তা-ই করছে। একটুও চিন্তা করছে না যে, আমি যা করছি কতটুকু যোগ্যতা নিয়ে করছি। যে কথা বলছি কতটুকু বলার আমার অধিকার আছে। আসলে ব্যক্তির এই উপলব্ধি যে হারিয়ে গেছে এটা এজন্যই যে, চরম মূর্খতা আর জ্ঞান-পাপে তার অন্তর-মস্তিষ্ক ছেয়ে গেছে! আল্লাহ তাআলা যে কাজটি ফরয করেছেন (দ্বীনের জ্ঞান অর্জন) সেটির প্রতি চরম অবহেলার বিষফল এটা।
যেসব লক্ষণ সুস্পষ্ট মন্দ ইঙ্গিত দেয়
যখন ঈমান ও ইসলামের ছায়াতলে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দবোধ করা হয় না, বরং লজ্জাবোধ হয়; ব্যক্তি তার মূল পরিচয় দেয় পদবী, জাগতিক জ্ঞান, যোগ্যতা বা পেশার ভিত্তিতে। নিজের ঈমান ও নেক আমলের ক্ষতি হয় হোক, কিন্তু পার্থিব স্বার্থ অর্জনে যেন কোনো ঘাটতি না হয় সেভাবেই সে সমাজের মাঝে বসবাস করে। এটা সুস্পষ্ট দুনিয়াপ্রীতি, আখেরাতের ওপর পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দান। তখন এটা সুপস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এমন ব্যক্তির কাছে ঈমান ও ইসলাম দ্বিতীয় নম্বরে অথবা আরও পরে। আগে তো হল তার পার্থিব নাম-পরিচয়, পদবী, ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তি। এটা এমন একটি লক্ষণ যা সুস্পষ্ট এ ইঙ্গিত দেয় যে, ঐ ব্যক্তি বিজাতীয়দের বিশ্বাস ও তাদের কর্মকান্ডের প্রতি ঝুঁকে রয়েছে। তার কাছে ইসলামী বিশ্বাস ও আমল, ইসলামের শিক্ষা, ইসলামের নিদর্শনসমুহ, ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান, আলেম-উলামা ও মুসলমানদের প্রতি অনীহা ও আপত্তি। এ অবস্থা যত প্রকট তার ঈমান তত দুর্বল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় যদি কারো মধ্যে কোনো প্রকার অনুতাপ-আক্ষেপ না থাকে, তাকে হয়ত কেবল আদমশুমারীতে মুসলামান হিসেবে গনণা করা হবে!
হীন মানসিকতার কারণ ও ফল
উপরোক্ত অবস্থা বা মানসিকতার মৌলিক কারণগুলোর অন্যতম হল, জাগতিক জ্ঞানকে অতি প্রাধান্য দান ও দ্বীনি জ্ঞানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। একদিকে ঐ জাগতিক জ্ঞান যা সে অর্জন করেছে সেটা মূলত তার মন-মস্তিষ্কে পার্থিব সম্মান, অর্থ আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির লালসার বীজ বপন করেছে। এসবই দুনিয়ার মোহ ও বস্তুজগতের প্রাধান্যতা শেখায়। অন্যদিকে তার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে দ্বীনি জ্ঞানের চরম ঘাটতি, উলামাগণকে হেয়-জ্ঞান করার মানসিকতা, নিজের অবস্থার উপর সন্তুষ্টি, নিজের যোগ্যতা ও সম্পদ-সম্মানকে ‘নিজস্ব’ অবদান বলে দৃঢ় বিশ্বাস (অথচ এগুলো আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত, ব্যবহারও তাঁরই পথে করা জরুরি ছিল)। এসব চিন্তা ও বিশ্বাসের ফলেই এ ব্যক্তির অন্তর রোগাক্রান্ত। এতটা রোগাক্রান্ত যে, কেউ কেউ মনে করে থাকে: (দ্বীনের জ্ঞান সঠিকভাবে অর্জন না করেও) তাদের নিজ যোগ্যতা ও অর্থ প্রতিপত্তি এরই প্রমাণ যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে খুব ভালোবাসেন। তাই তিনি আমাদের মত মানুষকে এগুলো দান করেছেন। এ কথাটি কেউ মুখে প্রকাশ করেন, কেউ বা কর্মে প্রমাণ করেন। অথচ এসব কেবলই তাদের মনগড়া ধারণা ও আস্থা-বিশ্বাস। কারণ পার্থিব জগতে আল্লাহ তাআলার দান তো সবার জন্য! কাউকে অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা-শক্তি, যোগ্যতা-মেধা কম-বেশি দেয়া — এসবই আল্লাহ তাআলার হেকমত তথা গভীর জ্ঞানবেষ্টিত — তিনি যাকে যেভাবে ভালো মনে করেন দান করে থাকেন।
দ্বীনি জ্ঞান ও তার বাহক-প্রচারকগণকে হেয়-তুচ্ছকারীদের ভয়ানক কিছু বৈশিষ্ট্য
এ জাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলো বা তার যেকোনোটি যখন কোনো ব্যক্তির মধ্যে স্পষ্ট বিদ্যমান আছে বোঝা যায় (আরো যেমন): নিজ জাতির (অর্থাৎ ইসলাম ও মুসলিমদের) কুরআন-হাদিস নির্ভর জ্ঞান ও ইতিহাসের প্রচন্ড অভাব তার, কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই। অথচ মন্তব্য ছোড়ায় অগ্রগামী। আলেমগণ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা: (এবং সেই ধারণাবশত এমন মনে করা) তারা দুনিয়ার বিষয়াদী ‘বেশি কিছু’ বোঝেন না। বুঝলেও তারা কম বুঝেন, তাই তারা বুদ্ধিমান নন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতে অপারগ। তারা গরীব ও অভাবি, তাদের কাছে অর্থকড়ি কম। আর সেজন্য তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কম। তারা এমন হেয় এক জনগোষ্ঠি যারা কিনা মানুষের দান-অনুদানে চলে থাকে । আবার কোনো আলেমের কাছে অর্থকড়ি দেখলে তারা বলে বসে, আলেমগণ এত টাকা কোথায় পায়?! (এসব ব্যক্তিবর্গ আরো বিশ্বাস করেন) আমরা বিদেশ যাই, অনেক মহলে (সোসাইটিতে) চলি, বহু মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। ইন্টারনেট, বইপত্র-সংবাদপত্র পড়ে আমরা অনেক জ্ঞানী। আমরা জানি ও বুঝি যুগের চাহিদা কী। শুধু কুরআন মুখস্থ করে আর ছেলে মেয়েদেরকে মাদ্রাসায় ইসলাম শিক্ষা দিয়ে সমাজের আসল সংস্কার হবে না, ঈমান ও ইসলামের উন্নতি হবে না। অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না। আলেম ও হুজুরদের বিভিন্ন দোষ ও অপকর্ম বেশি। তারা অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন। সামাজিকভাবে দূরে অবস্থানকারী। তাদের সঙ্গে বসে আমি যত না শিখব, তার থেকে আমি সভা-সেমিনার করে, নানান গবেষণামূলক কাজ করে, নেট ঘেটে, বইপত্র পড়ে ও কুরআন-হাদীস তরজমা পড়ে অনেক বেশি শিখতে পারব।” তখন বুঝতে হবে যে, যদিও এ জাতীয ধারণা পোষণকারী সৌভাগ্যবশত মুসলমান ঘরে জন্মেছে, যদিও সে নামায-রোযা করছে, যদিও তিনি সময়-সুযোগে ইসলামের কথা বলে থাকেন, এ দাবীও করেন যে, তিনি ইসলামের উন্নতি চান, যদিও বা তিনি বলেন আমি হুজুরদের শুভাকাঙ্ক্ষী — বাস্তবে, এমন ব্যক্তি দূর্ভাগ্যবশত ঈমান ও ইসলাম থেকে দূরে, বরং বহু দূরে অবস্থানকারী! এসব বৈশিষ্ট্যধারীগণ বিভিন্ন ধরণের ও প্রকারের হন। হতে পারে সরাসরি এ ধরণের বৈশিষ্ট্য কারো মধ্যে পুরোপুরি নেই কিন্তু সে এমন ব্যক্তিবর্গের সাথে উঠাবসা করে এ জাতীয় রোগে আক্রান্তর হুমকিতে পড়ছে। হয়ত তার ঈমান এখনও বাকি আছে কিন্তু তা দিন-দিন আশঙ্কাযুক্ত হচ্ছে। আর যারা এসব চিন্তা-চিন্তা-বিশ্বাসের কোনোটিকে বদ্ধমূল করে নিয়েছে, ঈমান হানীকর কোনো বক্তব্য-বিশ্বাসের কারণে তার ঈমান নষ্ট হয়েই গেছে!! আল্লাহ তআলার পানাহ।
তাদের পরিশুদ্ধ দ্বীনি জ্ঞানের চরম ঘাটতির কারণ:- আলেমগণ থেকে দূরে অবস্থান (কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা পেতে হলে উনাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই)। যে ব্যক্তি এই ভয়ানক রোগে চরম অবহেলার সাথে আক্রান্ত, তার এক অন্যতম কারণ হল, ঐ ব্যক্তির নিবিষ্টতা ও মগ্নতা সম্পূর্ণ বিপরীত পথে, বিপরীত মহলের সঙ্গ-সহচরদের সাথে।
আশ্চর্য হতে হয় এমন ব্যক্তিকে দেখলে ও তাদের কথা শুনলে যারা নিজেদের ইসলামী জ্ঞানকে প্রকাশ্যে, বা ‘হুজুর’দের সামনে ‘আমি ইসলাম সম্পর্কে খুব কম জানি’ ভুমিকা দিয়ে কথা শুরু করে থাকেন। কিন্তু তারপর এমন সব উপদেশ বাণী ও সংশোধনমূলক কথা বলেন, সেগুলি শুনলে বোঝা যায় যে, তার ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকলেও ইসলাম সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও মত রয়েছে। ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন লেখাপড়া ভিত্তিক গবেষণা আছে। যেহেতু তিনি না প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দ্বীনি লেখাপড়া করেছেন, না তিনি আলেমগণের কারো সঙ্গ-পরামর্শে চলে দ্বীন শিখেছেন। সেজন্যই এটা স্বাভাবিক যে, তার সামনে হুজুরদের দোষ ও তাদের (আলেমগণের) জ্ঞানের ঘাটতির অজস্র ব্যাখ্যা বিদ্যমান!! তারা অবশ্য সর্বসাধারণ মুসলমান (যেমন: মুবাল্লিগ, অন্যান্য যত মতের মানুষ আছেন) সম্পর্কেও খুব নেতিবাচক মন্তব্য ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাকেন। জ্ঞানের স্বল্পতা যখন অধঃপতিত হয় তখন কার দোষ কোনটি। কেন সেটা বড় দোষ অথবা ছোট, না বুঝলেও সামগ্রিকভাবে সব দ্বীনি খাদেমগণের দোষই তার নজরে আসে। সবার বিরুদ্ধে এলোপাতাড়ি মন্তব্য ছুড়তে থাকেন। কেবল নিজের ত্রুটি ও দোষগুলি ধরা পড়ে না!
উদাসীনতার কয়েক স্তর ও স্বরূপ
এক শ্রেণী ইসলামকে জানতে আগ্রহী। কিন্তু চলেন সম্পূর্ণ মনগড়া পথে। আরেক শ্রেণী ইসলামকে জানতে আগ্রহী। কিন্তু চলেন আংশিক মনগড়া পথে। কখনো শেষোক্ত শ্রেণি আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকেন। কারণ তারা তওবা করতে চায় না। অনেকে জানতেও আগ্রহী নয়।
দ্বীনি তালীম-তরবিয়ত অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা তথা কুরআন-সুন্নাহর পথে সংশোধন অর্জন উপরের সব শ্রেণীর সবার কাছেই অপছন্দনীয়। নিজে তারা এ পথে হাঁটেননি, তাদের সন্তানদেরও বাঁধা দিচ্ছেন ও বারণ করছেন। এমনকি অন্যরা যে এ ইসলামী পথে শিক্ষা-সংশোধনে অগ্রসর হচ্ছে, কষ্ট-ক্লেশ করছে, তাদের সন্তানদেরকে দ্বীন শেখানোর জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি করছে — তাতেও অনেকের শান্তি হচ্ছে না! এতেও তারা ক্ষুব্ধ।
উপরের সব শ্রেণীরই কুরআন ও হাদীস অধ্যয়নে বিশেষ কোনো প্রচেষ্টা নেই। অথচ এর বিপরীতে তারা মিডিয়ার প্রচার-প্রসারলব্ধ তথ্য, যার মাঝে ইসলামকে বিকৃতির, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-বিশৃংখলা সৃষ্টির সব ধরণের অপঃপ্রয়াস চালানো হচ্ছে, সেগুলির দ্বারা খুব প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী আকিদার স্থলে পাশ্চাত্যের আকিদা তাদের মনে, অন্তরে বসে যাচ্ছে। এরও নানান আলামত সুস্পষ্ট। যদি বা কারো মধ্যে দ্বীনি শিক্ষা কিছুটা থাকেও বা জানার চেষ্টা থাকে, তার গোড়া হয়ে থাকে ইন্টারনেট অথবা নিজস্ব গবেষণালব্ধ সূত্র বা উৎস। যেখানে সর্বসাধারণ মানুষ দ্বীন শিখতে গিয়ে সবচেয়ে নিম্নমানের পথটি অবলম্বন করে থাকে। সবচেয়ে ভালো মানের দ্বীনের জ্ঞানও সেখানে সবচেয়ে নিম্নমানের উপায়ে পাওয়া যায়। কথাটি বলতেও কষ্ট হল, বোঝাতেও খুব কষ্ট! তারপরও বলতে হচ্ছে। কারণ আমরা জাগতিক-পার্থিব কোনো গুরুত্বপূর্ণ/দামী জিনিস, সেটা যত ক্ষুদ্রই হোক, অনেক ভালো অনুসন্ধান না করে দ্রুত ইন্টারনেট থেকে লুফে নিই না! কিন্তু দ্বীনি বিষয়, দ্বীনি জ্ঞান, নামাযের মাসআলা, কুরআন-হাদীস সংশ্লিষ্ট জ্ঞান খুব দ্রুত, স্বল্প সময়ে ইন্টারনেট থেকে গ্রহণ করে ফেলি!! এর পরিণতি চিন্তা করার কোনো ফুরসত নেই(!) এর থেকে উন্নত কিছু চিন্তা করার কোনো চেষ্টা নেই, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার প্রচন্ড অভাব। যদি নিজের স্বল্প জ্ঞানে বলে যে, ঐ কুরআন মাজীদের তরজমাটি কেনা দরকার, বা ঐ হাদীস শরীফের তরজমাটি কিনে পড়া উচিত, দ্রুত একাকি বা দু’ চারজন আমারই পর্যায়ের মানুষের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে বইটি আমি কিনে ফেলি! কোনো আলেমকে বা কমপক্ষে কোনো দ্বীনদার-পরহেযগার বন্ধুকে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করা উচিত, তা একটুও ভাবি না!!
আসলে জেহালত বা মূর্খতার অনেক অবস্থা রয়েছে। আজ আমরা মুসলমান নামধারী হয়েও ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম (বা অনেকে আল্লাহর পানাহ বের হয়েই গিয়েছে!) এক অবস্থায় উপনীত হয়েছি। এটা জেহালত বা মূর্খতার সবচেয়ে করুণ পরিণতি।
একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, অনেকের মধ্যে শুধু ইসলামের নাম-গন্ধটুকু বাকি আছে(!) তাদের আকিদা (মৌলিক বিশ্বাস), তাহযীব-তামাদ্দুনে (সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, ব্যবহার, সংস্কৃতি) কাফেরদের কার্যকলাপের মতন। সেজন্য তাদের মধ্যে খুব একটা আফসোস পর্যন্ত নেই। বরং তাদেরকে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-সংস্কৃতির স্পষ্ট ক্ষতিকর বিষয়গুলি ত্যাগ করার চেষ্টার কথা বলা হলে তারা স্বপক্ষে অযৌক্তিক কথা বলে ফেলেন। স্বীকার করতে চান না যে, তাদের ঈমান-ইসলাম মনগড়া এক রূপ নিয়েছে। এই মনগড়া চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ইসলামের মৌলিক বিষয়ে আমূল পরিবর্তন চলে আসলেও তারা টের পায়নি যে, ঈমানের গন্ডিতে কে আছে, কে নেই।যেমন ধরুন: যদি কেউ আল্লাহ তাআলার দ্বীন বুলন্দ করতে গিয়ে সত্যিই আল্লাহ তাআলার পথে শহীদ হয়ে যায়, বা কাফেরদের নির্যাতনে শুধু এজন্য পড়ে যে সে একজন মুসলিম, তার জন্য আজ মুসলমানের এ সন্তানদের ততটা কান্না আর দয়া হয় না যতটুকু দয়া আর মায়া হয় অন্যান্য কারণে কারো মৃত্যু হলে। দেখবেন রোড এক্সিডেন্ট বা ধর্ষণ জাতীয় মৃত্যুর খবরে তারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। কিন্তু ঈমান ইসলামের জন্য জীবন দেওয়া সর্বোচ্চ মর্যাদার শহীদগণের প্রতি অন্তরে ততটুকু শ্রদ্ধাবোধ জাগে না। আবার ধরুন, কারো সন্তান কুরআন মাজীদ হেফয করেছেন। হাফেযে কুরআন হয়েছেন। তাকে দেখে বা তার এ হেফযের খবর তাদেরকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে না। যতটা করে কেউ জাগতিক বিদ্যা অর্জন করলে — বিদেশ থেকে কোনো ডিগ্রী নিয়ে আসলে। অথচ কোথায় আল্লাহ তাআলার কালামের হাফেয আর কোথায় জাগতিক বিদ্যার কোনো ডিগ্রী!
এই ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই যে, জাগতিক বিদ্যা-বুদ্ধি-ডিগ্রীর কোনো মান-মর্যাদা নেই। কিন্তু একজন ঈমানদারের কাছে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মানার ভিত্তিতেই সব, এটিই সর্বাগ্রে! অন্য সব কাজ, পরিকল্পনা, সাধনা আল্লাহ তাআলার আহকামের ভিত্তিতেই হতে হবে।
প্রিয় মুসলিম ভাই বোনেরা!
উপরে যেসব মানসিকতা, চিন্তাধারা, জীবনধারা ও কার্যকলাপের কথা বলা হল, সেগুলির দ্বারা এমন ব্যক্তিদের বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যারা পূর্ব থেকেই অবিশ্বাসী বা কাফের। বরং, যেসব ঘরে মুসলমানগণ নামায পড়েন, রোযাও রাখেন, এমনকি হজ্জ-উমরাও করেছেন, যিকির-তেলাওয়াতও করেন এমন পরিবারের সদস্যদের কথা বলা হচ্ছে। যদি এসব নেক আমলের পাশাপাশি আমরা নিজেদের চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাসকে ঠিক করতে না পারি (অর্থাৎ শরীয়তসম্মত করতে না পারি) তা হলে আমাদের নেক আমল রেওয়াজ ও রসমমাত্র। ইয়াহুদী, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মমত অবলম্বনকারীদের মধ্যে এমন বহু সংখ্যক আছে যারা কেবল নামেই সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বী। আসলে তারা তাদের ধর্মের কিছুই মানে না (যদিও তাদের ধর্মবিশ্বাস স্বয়ং বিকৃত ও বাতিল)। ইসলামের ফরয ইলম অর্জন না করে ও ইসলামের বিপরীত পথে জীবন পরিচালনা করে আমাদের অবস্থা ঠিক তাদের মতনই হয়ে গেল। বরং বলতে হয়, তার থেকেও হতভাগ্য হব আমরা। কারণ আমরাও ঐ মানুষ যারা দ্বীনে-ইসলাম পেয়ে ধন্য হয়েছিল! যদি চিন্তা-চিতনা-বিশ্বাসে আমরা ঈমানদার বা মুসলমান না হতে পারি তা হলে শুধু নেক আমল আমাদেরকে বাঁচাতে পারবে না। উপরের যে বৈশিষ্ট্যসমুহ আলোচনা করা হল এগুলো সবই আমাদের নেক আমলকে বরবাদ ও ধ্বংসকারী!
মনে রাখবেন, বিশ্বাসই কর্ম ও কর্মধারার মূল নির্দেশক ও প্রভাবক। যদি মৌলিক জ্ঞানার্জন হয় বিজাতীয়, তার প্রয়োগ ও ব্যবহার বিজাতীয়দের মতনই হবে। আমাদের মন-মস্তিষ্ক, বিশ্বাস সবই তাদের দ্বারাই প্রভাবিত হবে, যেটা বর্তমানে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এ বিশ্বাস নিয়ে চলতে থাকলে নেক আমলের পাহাড় গড়েও মৃত্যুর আগে শেষ রক্ষা হবে না অর্থাৎ ঈমান নসীব হবে না। কেবল মুসলমান ঘরে জন্মেছি বলে মুসলমান হয়ে মরতে পারব, এমন ধারণা অমূলক ও অযৌক্তিক।
সেজন্যই দেখুন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঈমানদারগণকে সম্বোধন করে বলেছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। সুরা আলে ইমরান: ১০২
আর বিজাতীয়দের বন্ধুরূপে গ্রহণের বিষয়ে কুরআন সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
وَلاَ تَرْكَنُواْ إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُواْ فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ اللّهِ مِنْ أَوْلِيَاء ثُمَّ لاَ تُنصَرُونَ
সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন (অর্থ); যে কোনো জাতিকে অনুকরণ করবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। (সুনানে আবু দাউদ)
সবার আহ্বান ও সতর্কতা আমরা এড়াতে ও অগ্রাহ্য করতে পারি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের আহ্বান ও সতর্কতা কিভাবে এড়িয়ে যাব, অগ্রাহ্য করব?!
শুরুতে যে বলা হয়েছিল, “আজ সর্বসাধারণ মুসলমানদের মাঝে জেহালত অর্থাৎ দ্বীনি মূর্খতা চরম আকার ধারণ করেছে। এটা প্রকাশ পাচ্ছে নানাভাবে।” এ অবস্থায় একদিকে ঐসব মুসলমান, যারা মূলত জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। তাদের কোনো নিয়মতান্ত্রিক/ফরমাল দ্বীনি শিক্ষা নেই। থাকলেও তা একেবারে স্বল্প (যেমন কেউ স্কুলে ইসলামিয়াত পড়েছে, বা কিছুকাল মাদ্রাসায় পড়েছে)। আরেকদিকে এ অবস্থায় ঐসব মুসলমান, যারা দ্বীনি বা জাগতিক কোনো শিক্ষাই অর্জন করেনি। সবার অবস্থা একরকম নয়। কিন্তু কিছু মৌলিক মিলও আছে। দ্বীন শিক্ষায় উদাসীনতা, আলেম-উলামাগণের সঙ্গে আন্তরিক ওঠা-বসা ও তাদের মাজলিসে দ্বীন শেখার জন্য গমনে অবহেলা, দ্বীনি কিতাবাদী ঐভাবে অধ্যয়ন না করা যেভাবে অধ্যয়নে ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ পূর্ণাঙ্গভাবে জানা হয়, দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও দ্বীনি কাজ থেকে অনেক দূরে অবস্থান গ্রহণ — এগুলি হল তাদের মধ্যে একদম মৌলিক কিছু মিল। দ্বীনি বিষয়ে যদি এসব ব্যক্তিবর্গ কথা বলেন তা আন্দাজ ও অনুমান করেই হবে, তাই তাদের কোনো কথা গৃহীত হবে না। আমাদের প্রত্যেককে নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখতে হবে আমরা এমন কিনা?!
কী করণীয়
তাই ঈমানদার মুসলিম ভাই বোনদের বলছি, দ্বীনি তালীম (অন্তত ইসলামের মৌলিক শিক্ষা) গ্রহণ করুন। তওবা করে অন্তরকে কুফুর, শিরক ও নেফাক মুক্ত রাখার আন্তরিক চেষ্টা শুরু করে দিন। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির পথে চলার জন্য শুধু ‘ইসলামকে ভালো লাগা’ যথেষ্ট নয়। খাঁটি মুসলমান হতে হবে। এজন্য ইসলামের আকিদা জানা ও মানা ফরয। সে অনুযায়ী ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন গড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কথা ও কাজে, মনে-প্রাণে বিজাতীয় সব ধ্যান-ধারণাকে ঝেটিয়ে বের করতে হবে। আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব ও তাঁর জন্যই শত্রুতা — এই ভিত্তিতে অন্তরকে ঈমানী বলে বলীয়ান করতে হবে এবং কার্যত তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে (অন্তরে ঈমান থাকলে কার্যত তা প্রকাশ হবেই)। এসব গুণ অর্জনের জন্য আলেমগণের মাজলিসে নিয়মিত দীর্ঘ সময় দিতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে দীর্ঘ সময় দিতে না পারলে নিয়মিতভাবে কিছু সময়ই দিন, তবু দ্বীন শেখা শুরু করুন!
বর্তমান যুগের একজন আলেমে-দ্বীন বলেছেন, আরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজাতীয়দের যুদ্ধ তো সেদিনই শুরু হয়েছে যেদিন তালীম অর্থাৎ দ্বীনের শিক্ষা মুসলমানদের ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য আমাদের! আমরা তো সেই ‘বিজাতী’দের পঠন-পাঠেই জীবন গড়ে তুলছি! আর এটা না করাকে বিফলতা বলেই বিশ্বাস করে বসেছি।
আমাদের পক্ষ থেকে অন্যায় হয়েছে। বরং বড় রকমের অন্যায় হয়ে গেছে আমাদের। এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই! আর এটা এজন্য হয়েছে কারণ আমরা আলেমগণের সংস্পর্শে গিয়ে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করছি না। অতএব অতি শীঘ্রই খাঁটি তওবা করতে হবে। অতিসত্বর আলেমগণের কাছে গিয়ে নিজের অবস্থা পেশ করতে হবে। নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অবস্থা অনুযায়ী পরামর্শ নিয়ে তওবা করে জরুরিভিত্তিক সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এমনটি না করা হলে করুণ পরিণতির অপেক্ষা করতে হবে! সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হল ঈমানবিহীন মৃত্যু। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রক্ষা করুন! আমীন।
Last Updated on March 21, 2023 @ 11:11 am by IslamInLife বাংলা