হাতিমুল আসাম্ম রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ২৩৭ হিজরী : ৮৫১ খৃস্টাব্দ)

এই উম্মতের লুকমান। দুনিয়া যাঁর জবানের কিনারায়ও পড়েনি। তহবন্দ পরিধানে অনুপম। গাফলতি থেকে জেগে ওঠেছিলেন। গুনাহ স্মরণ করে আল্লাহ তাআলা প্রতিশ্রুতি পেয়ে শান্ত হয়েছিলেন। তিনি হাতিম ইবনে উনওয়ান আবূ আব্দুর রহমান। আসাম্ম নামে যিনি পরিচিত।
যাহিদ ও দুনিয়াত্যাগী। তাকওয়া ও সাধনাখ্যাত লোক। বলখের অধিবাসী। বাগদাদ সফর করেছিলেন। হযরত আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। বিভিন্ন সামরিক অভিযানে মুসলিম মুজাহিদদের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ তার আসাম্ম (বধির) নামকরণ সম্পর্কে একটি কারণ উল্লেখ করেছেন। সেটি হল, একবার এক মহিলা ফতওয়া চেয়ে তার কাছে এসেছিল। কথা বলার সময় মহিলা থেকে সশব্দে বাতাস বের হচ্ছিল। মহিলা লজ্জিত হয়ে পড়লে তিনি বধিরতার ভান করেন। বললেন, কী বল…আমি তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না… জোরে বল।
তার মুখ দিয়ে প্রজ্ঞা ও হিকমতের কথা নিঃসৃত হতো। তার কথাগুলো বেশ সুস্পষ্ট এবং সুমিষ্ট ছিল। একটি বাণী হল, তাকওয়া ছাড়া যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা দাবি করবে সে মিথ্যুক। একদিন মধ্যাহ্নের সময় এক ব্যক্তি হাতিম আলআসাম্ম এর নিকট এসে হাজির। বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগে। প্রশ্ন করলেন, যুহদ ও দুনিয়াত্যাগের শুরু কী মধ্যম কী এবং শেষ কী? তিনি উত্তরে বললেন, যুহদের শীর্ষ হল আল্লাহ তাআলার প্রতি ভরসা ও আস্থা। মধ্যম হল ধৈর্য এবং শেষাংশ হল ইখলাস, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার ব্যাপারে যুহদ করবে, আখেরাতের প্রতি অনুরাগী হবে, দীন-দরিদ্র লোকদেরকে ভালোবাসবে এবং আখেরাতের জন্য আমল করবে আল্লাহ তাআলার নিকট তার একটা অবস্থান সৃষ্টি হবে।
আরেকবার এক লোক এসে জিজ্ঞেস করলো, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহ তাআলা ভরসার বিষয়ে আপনার বুনিয়াদ ও মূলভিত কী? তিনি বললেন, তাওয়াক্কুলের বুনিয়াদ চারটি। যথা- (ক) মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা যে, আমার রিযিক অন্য কেউ খেতে পারবে না। এই বিশ্বাস থেকে মনে চরম প্রশান্তি সৃষ্টি হওয়া। (খ) বিশ্বাস করা যে, আমার আমল আমাকেই করতে হবে। অন্য কেউ আমার আমল করে দিবে না। সেই বিশ্বাস থেকে আমল ও কাজে নিমগ্ন থাকা। (গ) দৃঢ়বিশ্বাস করা যে, হঠাৎ একদিন আমার মৃত্যু আসবে। আমি সেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত। (ঘ) আল্লাহ তাআলার দৃষ্টি থেকে আমি কখনও অন্তর্ধান হতে পারবো না। সুতরাং সবসময় তার সামনে দাঁড়াতে আমি লজ্জাশীল হয়ে আছি।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. আর হাতিম আসাম্ম একসাথে বসে আছেন। একজন অপর জনকে অভিনন্দন জানালেন। এরপর ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. প্রশ্ন করলেন, লোকদের খপ্পর ও অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায় কী? হাতিম আসাম্ম বললেন, তাদেরকে আপনার সম্পদ দান করুন, তাদের থেকে অর্থকড়ি গ্রহণ করবেন না। তাদের হক ও পাওনা পরিশোধ করুন, তাদের থেকে আপনার অধিকার তাগাদা দিবেন না। তাদের পক্ষ থেকে অন্যায় আচরণ বরদাস্ত করুন, তাদেরকে কোন প্রকার কষ্ট দিবেন না। এভাবে চললে আশা করি নিরাপদ থাকতে পারবেন।
একবার হাতিম আসাম্ম রহ. এর নিকট আসিম নামক এক ফকীহ (ব্যুৎপন্ন মুফতী) আসলেন। বললেন, হযরত, আমাকে নামাযের পদ্ধতি শেখান। হাতিম আসাম্ম রহ. বললেন, আসিম, নামায পড়ার সময় আমার পরওয়ারদেগারের হুকুমে দাঁড়াই। চলার সময় গম্ভীর হয়ে চলি। সুন্নাত অনুযায়ী প্রবেশ করি। এতো কিছুর পর আশঙ্কা, তিনি আমার পক্ষ থেকে গ্রহণ করছেন না।
ঈমান আর তায়াক্কুলে তার হৃদয়জগত টইট¤ু^র ছিল। যুহদের সামনে তিনি ধরাশায়ী। মানুষের সাথে উঠাবসা করতেন আর তাদেরকে ঈমানের উপজীব্য শেখাতেন। তিনি বলতেন, আমার চার বিবি। সন্তানাদি নয়জন। এই পর্যন্ত শয়তান তাদের রিযিকের ব্যাপারে আমার অন্তরে কোন কিছুর ব্যাপারে সামান্যতম কুমন্ত্রণা দেওয়ার সাহস-ই করেনি।
তার কাছে এক লোক এসে হাজির। বলল, আমাকে ওয়াজ করুন, আমাকে উপদেশ প্রদান করুন। হাতিম বললেন, তুমি যদি তোমার মাওলার (আল্লাহ তাআলার) অবাধ্যতা করতে চাও তুমি এমন স্থানে গিয়ে নাফরমানি কর যেখানে তিনি তোমাকে দেখতে না পায়।
তিনি লোকদেরকে মৃত্যু সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে বলতেন, প্রত্যেক জিনিসের একটা সৌন্দর্য রয়েছে। ইবাদতের সৌন্দর্য হল খোদাভীতি। আর খোদাভীতির আলামত হল স্বল্প আশা। ছোট্ট আশাই আল্লাহ-ভীতির বাহ্যিক নিদর্শন।
একদিন তিনি লোকদের সাথে দেখা করলেন। বললেন, প্রত্যহ সকালে শয়তান বলে, তুমি কী খাবে? কী পরিধান করবে? কোথায় বাস করবে? আমি বলি, মৃত্যু খাবো, কাফন পরিধান করবো এবং কবরে বসবাস করবো। যুহদ ও দুনিয়াত্যাগে ভাস্বর এই মহান মনীষী হিজরী ২৩৭ সালে মারা যান। ইন্তেকালে সময় তিনি আখেরাতের জাহাজে সফরে ছিলেন। পরকালের এই মুসাফির সফর করতে করতে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it