হাসান বসরী رحمة الله عليه (মৃ. ১১০ হিজরী : ৭২৮ খৃস্টাব্দ)
যাঁর কথা নবী-রাসূলদের কথার সাথে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অপূর্ব মিল। নবী ﷺ-এর বংশধরের মাঝে যিনি বেড়ে ওঠেন। হযরত উমর রা. এর চিবানো খেজুর রস জীবনের প্রথম খাদ্য। যাঁর পাকস্থলীতে সর্বপ্রথম বরকতময় খাদ্যকণা প্রবেশ করে। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা. যাঁকে দুগ্ধপান করিয়েছেন। হযরত আলী রা.-এর তত্ত্বাবধানে যিনি যৌবনে পদার্পণ করেন। যাঁর হৃদয় মন্দিরে যুহদ ও আখেরাতমুখিতা নঙ্গর করেছিল।
তাকওয়ার ও পরহেযগারির তিনি নিদর্শন। যাহিদ ও দুনিয়াবিরাগীদের প্রধান ব্যক্তি। শীর্ষস্থানীয় তাবেঈ। তিনি আলহাসান ইবনে ইয়াসার আবূ সাঈদ। মুত্তাকী নেতা। দুঃখ-বেদনা এবং ভয়ভীতির নিত্যসঙ্গী। সময়ের শ্রেষ্ঠ বুযূর্গ। বসরাবাসীদের মাথা। নির্ভরযোগ্য ফকীহ ও ইসলামী আইনজ্ঞ ব্যক্তি। উম্মতের পণ্ডিতপ্রবর ব্যক্তি।
হযরত উমর রা. নিজ যাঁকে ‘তাহ্নীক’ করিয়েছেন। খেজুর চিবিয়ে লালা তালুতে লাগিয়েছেন। শারীরিক অবয়বে পরিপূর্ণতার ছাপ ছিল। দেখতে বেশ সুন্দর ছিলেন। আখলাক-চরিত্র এবং আচার-ব্যবহার সন্তোষজনক। সাহিত্যিক ও সাহসী উলামা কেরামের তিনি একজন।
সাহাবা কেরাম থেকে ইলম-বিদ্যা অর্জন করেছেন। মদীনা শরীফের মহান মনীষী ও দরবেশদের থেকে লাভ করেছেন দুনিয়া বিরাগের শিক্ষা। হযরত আলী রা. এর ছায়ায় লালিত-পালিত হন। হযরত মুয়াবিয়া রা. এর শাসনামলে খুরাসানের গভর্নর রবী ইবনে যিয়াদ তাঁকে সেক্রেটারি বানিয়েছেন। থাকতেন বসরা। মানুষের অন্তরে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। তিনি পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে যে কোন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ করতেন। হাজ্জাজের সাথে তাঁর আচরণ ছিল কঠোর। বাগ্মী ও সুসাহিত্যিক ছিলেন। যাঁর মুখ দিয়ে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের কথা নিঃসৃত হতে থাকতো। দীর্ঘ সময় ধরে চিন্তাভাবনা করতেন। হালাল ও হারামের ব্যাপারে মানুষের মাঝে যাঁর জানাশোনা সবচেয়ে বেশি।
হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন রা. হযরত হাসান বসরী সম্পর্কে বলেন, এই সেই ব্যক্তি যাঁর কথা নবী ও রাসূলগণের কথার সামঞ্জস্য রয়েছে। একবার খালেদ ইবনে সাফওয়ান হীরা শহরে হযরত মাসলামা ইবনে আব্দুল মালিকের নিকট গেলেন। তিনি তাঁকে হাসান বসরী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। খালেদ বললেন, আল্লাহ তাআলা আমীরকে সংশোধন করে দিন। আমি তাঁর সম্পর্কে যা জানি আমি এখনি সেগুলো বলছি। আমি তাঁর প্রতিবেশী। মানুষের মাঝে তিনি এমন এক ব্যক্তি যাঁর জাহের ও বাতেনের মাঝে অপূর্ব মিল। বাহ্যিক ও ভিতরে এক ও অভিন্ন চেহারার মানুষ। কথা ও কাজে অসাধারণ মিল। কোন কাজ করার ইচ্ছা করলে তা করেই ছাড়েন। কোন কাজের আদেশ করলে সবার চেয়ে তিনিই সে কাজে অগ্রগামী। আবার কোন কাজের নিষেধ করলে দেখা গেছে সে কাজ সর্বাগ্রে তিনিই বর্জন করছেন। প্রয়োজনে মানুষ এড়িয়ে চলতেন। লোকজনের কাছে প্রয়োজনের কথা বলতেন না। মানুষই তাঁর প্রতি এক ধরনের মুখাপেক্ষিতা নিয়ে চলতো।
হযরত মাসলামা ইবনে আব্দুল মালিক রহ. বলেন, হে খালেদ, আপনি কী মনে করেন যে জাতির মাঝে হাসান বসরীর মতো মানুষ রয়েছে তারা বিপথগামী বা পথহারা হবে? হযরত আশ’আস বলেন, হাসান বসরী রহ. এর পর যাকেই দেখিছি আমার দৃষ্টিতে তাকে হাসান বসরীর তুলনায় ছোট মনে হয়েছে। হযরত হাসান বসরী রহ. এর অনেক বিজ্ঞবচন আছে। তিনি বলতেন, মৃত্যু দুনিয়াকে পানসে করে দিয়েছে। বিবেকমান ও বুদ্ধিমান লোকদের জন্য এই মৃত্যু আনন্দ ও বিনোদনের কোন কিছু রেখে যায়নি।
দুনিয়ার কোন মূল্য ছিল না তাঁর নিকট। স্বর্ণমুদ্রা এবং রৌপ্যমুদ্রার কোন দাম ছিল না। হযরত আশআ’স রহ. বলেন, আমরা হযরত হাসান বসরী রহ. এর নিকট যেতাম। তাঁর দরবার থেকে বের হওয়ার পর আমরা দুনিয়াকে কোন কিছুই মনে করতাম না। হযরত হাসান বসরী লোকদেরকে উপদেশ দিতেন। তাদেরকে ওয়াজ-নসিহত শোনাতেন। তাদের কর্ণকুহরে দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা ঢেলে দিতেন। তিনি বলতেন, দিরহাম ও দীনার অতি নিকৃষ্ট সঙ্গী। এই স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা কারও উপকারে আসে না যতক্ষণ না সে সেগুলোকে নিজের থেকে পরিত্যাগ না করে। তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি এই অর্থকড়িকে মর্যাদাবান মনে করবে আল্লাহ তাআলা তাকে অপমানিত করবেন। তোমরা দুনিয়াকে অপমানিত ও তুচ্ছ মনে কর। কসম, দুনিয়াকে লাঞ্ছিত মনে করার মাঝেই প্রশান্তি রয়েছে।
হযরত হাসান বসরী রহ. সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। আখেরাতের পাথেয় যোগায় এমন সামগ্রী ব্যতীত অন্য কোন সম্পদ তার ঘরে ছিল না। তাঁর এক বন্ধু’র বর্ণনা, আমরা হাসান বসরী রহ.কে দেখতে গেলাম। দেখলাম তাঁর ঘরে কোন বিছানা নেই, কোন বালিশ নেই। সামান্য খেজুর পাতার শয্যায় তিনি শায়িত। একবার এক বেদুঈন বসরা শহরে প্রবেশ করল। বলল, এই নগরীর প্রধান ব্যক্তি কে? লোকজন বলল, হাসান বসরী। লোকটি বলল, হাসান বসরী কী দিয়ে নেতৃত্ব করে? লোকজন বলল, মানুষের কাছে জাগতিক যে সামগ্রী রয়েছে সেগুলো হাসান বসরীর দরকার নেই। পক্ষান্তরে হাসান বসরী রহ. এর নিকট দ্বীনের যে অগাধ পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান রয়েছে সেগুলোর প্রতি মানুষ একান্ত মুখাপেক্ষী। যাযাবর বললো, কী চমৎকার কথা! আসলে তিনিই প্রধান ব্যক্তি, তিনিই আসল নেতা।
হযরত হাসান বসরী রহ. নিজেকে শোভনীয় করেছিলেন ফযীলত ও মর্যাদার বিষয়াবলী দিয়ে। তাঁর বুকে ছিল অগণিত সুন্দর চরিত্রের সমাহার। এমন কোন চরিত্র ছিল না যা তিনি বুকে ধারণ করেননি। একদিন জনৈক লোক হাসান বসরী রহ.এর গীবত করল। তিনি তার নিকট পাত্র ভরে খেজুর হাদিয়া পাঠালেন। তিনি তাকে বললেন, তুমি আমার গীবত করেছো। এতে তোমার সওয়াব আমাকে তুমি হাদিয়া দিলে। সেই হাদিয়ার বিনিময় আমি দিলাম। এরপর লোকটি লজ্জিত হয়ে গেল এবং পরবর্তীতে আর কোন দিন কারও বদনাম করেননি এবং গীবত করেনি।
একবার হাসান বসরী রহ. এর নিকট জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, জনাব! আপনি যদি গোলাম আযাদ করার ফযীলত সম্পর্কে খুতবায় বলতেন! তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ আমি তা করবো। জুমার দিন হাসান বসরী রহ. মিম্বরে উঠলেন, গোলাম আযাদ করা সম্পর্কে কোন কিছুই বললেন না। লোকজনের সামনে অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। এভাবে দ্বিতীয় জুমা এবং তৃতীয় জুমায় অন্য আলোচনা করলেন। চতুর্থ বা পঞ্চম জুমায় তিনি গোলাম আযাদ প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন। উক্ত লোকটি বিস্ময়াভিভূত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, জনাব! গোলাম আযাদ করার বিষয়ে আপনার কাছে আমি আবেদন করলাম। কিন্তু আপনি সেই আলোচনা চার সপ্তাহ পর করলেন। উত্তরে হযরত হাসান বসরী রহ. বললেন, গোলাম আযাদ করা প্রসঙ্গে আলোচনা আমি করিনি। কারণ আমার কাছে অর্থকড়ি ছিল না। আমার হাতে টাকাপয়সা আসার পর আমি বাজারে গিয়েছি এবং কিছু গোলাম ক্রয় করে আযাদ করেছি। এরপর গিয়ে আমার জন্য ওয়াজ-উপদেশ দেওয়া বৈধ হয়েছে। কারণ, আমি যদি ক্রীতদাস মুক্ত না করে ওয়াজ করতাম তাহলে তো আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম যারা আমল না করে বলে বেড়ায়। (পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা এমন লোকদের নিন্দা করেছেন যারা বলে বেড়ায় কিন্তু আমল করে না। সূরা সাফ্ফ, আয়াত : ২; হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা কেন বল?)
হযরত হাসান বসরী রহ. খুব ভাবুক ব্যক্তি ছিলেন। হৃদয়স্পন্দিত লোক। মনে সবসময় ব্যথা অনুভব করতেন। এমন চিন্তিত ছিলেন, কেমন যেন জাহান্নাম শুধু হাসান বসরীর জন্য তৈরি করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম ইয়াশকুরী রহ. বলেন, আমি হাসান বসরী’র চেয়ে অন্য কোন ব্যক্তিকে এতো চিন্তাশীল দেখিনি। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ভেবে সময় কাটাতেন। তাঁকে দেখে আমার মনে হতো, তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বিপদে আক্রান্ত হয়েছেন। হযরত হাসান বসরী লোকজনকে ভাবতে বলতেন। ব্যথিত হতে বলতেন। ভয়ভীতি একটি বিশেষণ। সেই গুণটি লোকজনের হৃদয়গ্রাহী করতে বলতেন, নিরাপদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার ভীতসন্ত্রস্ত থাকা ভয়তরাসে হওয়ার আগ পর্যন্ত নিরাপদ থাকার চেয়ে অতি উত্তম।
একবার এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করতে আসলো। বলল, হে আবূ সাঈদ! কোন্ জিনিস হৃদয়ে ভয়ভীতি সঞ্চার করে? তিনি বললেন, ক্ষুধা। লোকটি আবার বলল, তাহলে দুশ্চিন্তা দূর করে কোন জিনিস? তিনি বললেন, পরিতৃপ্তি। ক্ষুধামুক্ত জীবনযাপন করলে মানুষের মনে খোদাভীতি হ্রাস পায়।
রাতের বেলায় নামাযে সময় অতিবাহিত করতেন। দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদতেন। আলী ইবনে যায়েদ বলেন, তিনি একদিন হাসান বসরী রহ. এর নিকট ছিলেন। তিনি দেখেছেন, হাসান বসরী রহ. সারা রাত ধরে ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়েছেন। লোকটি বললেন, হে আবূ সাঈদ! এই রাতে তো আপনি আমাদেরকে কাঁদালেন। আপনি এতো কাঁদেন কেন? তিনি বললেন, আলী, আমি মনে মনে বলেছি, হে হাসান! হয়তো তোমার কোন আমলের প্রতি মহান আল্লাহ তাআলা’র দৃষ্টি পড়ার পর তিনি বলেছেন যে, তোমার যা ইচ্ছে তাই আমল কর। এসব আমল আমার দরকার নেই।
হযরত হাসান বসরী রহ. লোকজন নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আবূ সাঈদ! আমি একটি ঘর বানিয়েছি। আমার একান্ত ইচ্ছে, আপনি একটু আমার বাড়িতে আসবেন এবং ঘুরে দেখে আমার জন্য বরকতের দোআ করবেন। হযরত হাসান বসরী রহ. লোকটির ঘর দেখার উদ্দেশ্যে সাথে থাকা লোকজন নিয়ে রওনা হলেন। বাড়িতে এসে বাড়িওয়ালাকে বললেন, পৃথিবী ও জগতের লোকজন তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে। আকাশবাসী তোমার প্রতি বিরাগভাজন হয়েছেন। নিজের ঘর নষ্ট করে অন্যের ঘর বানালে। একথা বলে তিনি লোকজন নিয়ে ফিরে আসলেন।
লোকজন হাসান বসরী রহ. এর বাড়িতে এসে দেখে, তাঁর বাড়ির একটি দেয়াল বাঁকা হয়ে পড়পড় অবস্থায় উপনীত। একজন বলল, হে আবূ সাঈদ (হাসান বসরী), দেয়াল ধসে পড়ার আগেই বানিয়ে ফেললে ভালো হবে। হযরত হাসান বসরী রহ. বললেন, অনেক দূর! অনেক দূর! (মৃত্যুর) বিষয়টি আরও দ্রুত। (কারণ, হাসান বসরী রহ. এর দৃষ্টিতে স্বল্পমেয়াদে আশা করা যথার্থতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদী আশা করা ছিল নিছক বাতুলতা)।
রজব মাসের শুরুতে জুমার রাতে হিজরী ১১০ সালে হযরত হাসান বসরী রহ. বসরা নগরীতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে গোটা বসরার লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়ে যায়।