মুসলিম ইবনে ইয়াসার رحمة الله عليه (মৃ. ১০৮ হিজরী : ৭২৬ খৃস্টাব্দ)

নিজের বজ্রকণ্ঠে যিনি আশার দোআর খোলেছিলেন। নামায পড়তে পড়তে যিনি চলে যেতেন যিকিরের ধ্যানে। জ্ঞানে ও গুণে যিনি উড়েছেন ওহীর কালে। নীরব-নিস্তব্ধ আবহে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে থাকতে যিনি খুব পছন্দ করতেন আর আনন্দ লাভ করতেন। আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা এবং তাঁর জন্য ভালোবাসাই ছিল যাঁর আত্মার খোরাক ও পুষ্টি। তিনি মুসলিম ইবনে ইয়াসির। দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে যিনি পরিচিত হন উমাইয়্যা বংশোদ্ভূত হিসেবে। একজন দুনিয়াবিরাগী ও হাদীস বিশারদ। ইসলামী আইনজ্ঞ ও মুজতাহিদ। পূর্বপুরুষ থাকতেন মক্কা শরীফে। পরবর্তীতে বসতি গাড়েন বসরা নগরীতে। এখানে তিনি ফতুয়ার দায়িত্ব পালন করেন এবং মুফতী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি এবং আখেরাতের প্রতি আসক্তি ছিল। ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি অনুরাগ ছিল প্রবল। নামায পড়তে দেখলে মনে হতো একজন রোগী। সেজদায় অবস্থায় দেখা যেতো একখানা বস্ত্রখণ্ড। নামায থেকে বের হলে মনে হতো তিনি যিকির ও তাসবীহতে নিমগ্ন আছেন।
এই মহান মনীষী সম্পর্কে ইবনে আউন রহ. বলেন, তাঁর কালে তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাউকে মনে করা হতো না। হযরত মুসলিম ইবনে ইয়াসির রহ. লোকদেরকে উপদেশ করে বলতেন, ঐ ব্যক্তির ন্যায় আমল কর যাকে আমলই কেবল মুক্তি দিতে পারে। আবার ঐ ব্যক্তির ন্যায় তাওয়াক্কুল ও ভরসা কর যিনি নিয়তি বেষ্টিত দুর্যোগ ছাড়া অন্য কোন বিপদে পড়ে না।

তিনি বলতেন, নির্জনে আল্লাহ তাআলাকে ডাকার ন্যায় মজাদার অন্য কোন কিছু নেই। সেজদায় পড়ে তিনি আল্লাহ তাআলাকে ডাকতেন। বলতেন, মাবুদ! তুমি যখন আমার প্রতি সন্তুষ্ট আমি সে সময়ে তোমার সান্নিধ্যে যেতে চাই। মাবুদ, সেই ক্ষণটা কখন? সেই মুহূর্তটা কবে? তিনি যখন নামায শুরু করতেন আশার সবকটি দোআরের সাথে তাঁর হৃদয় সম্পর্কিত হয়ে যেতো। দুনিয়া সম্পর্কচ্ছেদ হতো। একদিন তিনি নামায পড়তে লাগলেন। রুকু-সেজদায় নিমগ্ন। ইতোমধ্যে তাঁর পার্শ্বে অগ্নিকাণ্ড লেগে যায়। লেলিহান আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সবকিছু পুড়ে তছনছ। কিন্তু আল্লাহ তাআলার এই বান্দা আপন অবস্থায় ধীরস্থিরভাবে রুকু-সেজদা করছেন। এক পর্যায়ে আগুন নিভেও গেছে কিন্তু তিনি টেরও পাননি।

একরাতে কীলকের ন্যায় নামাযে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় এক সিরিয়ান তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে ঢুকে পড়ে। তারা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বাড়ির লোকজন, যার যা আছে লাঠি-বর্শা, সেগুলো নিয়ে সবাই ধাওয়া দিলে সে পালিয়ে যায়। মুসলিম ইবনে ইয়াসার রহ. নামায শেষ করলে তাঁর বিবি তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলে, এই তো ভিনদেশী লোক বাড়িতে প্রবেশ করেছিল কিন্তু আপনি নামায ছেড়ে তাড়া দিলেন না। মুসলিম ইবনে ইয়াসার রহ. বললেন, আমি কিছুই টের পায়নি।

মসজিদের দেয়াল ভেঙে পড়ে যায়। আশেপাশের লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে দেখে কী ঘটেছে। দেখে যে, মুসলিম ইবনে ইয়াসার দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন এবং ভেঙে পড়া দেয়ালের দিকে তিনি কর্ণপাতও করেননি।

সবসময় কাঁদতেন। চোখের পানি কখনও শুকাতো না। আকাশের বৃষ্টিকণা যেমন কখনও শুষ্ক হয় না। ইবনে সীরীন রহ. বংশের এক লোক বর্ণনা দিচ্ছেন যে, মুসলিম ইবনে ইয়াসির রহ.কে দেখলাম তিনি জামে মসজিদে নামায পড়ছেন। যখন সেজদা থেকে মাথা উঠালেন লক্ষ্য করে দেখলাম, তাঁর সেজদার জায়গাটি ভিজা। চোখের পানির আধিক্যের কারণে মনে হল সেখানে পানি ঢালা হয়েছে।

তাকওয়া ও পরহেযগারিতে তিনি আবর্তিত হতে থাকতেন। তাকওয়ার চৌহদ্দিতে পড়ে থাকতেন। বলতেন, কাপড় পরিধান করলে যদি তোমার কাছে খুব ভালো লাগে এবং নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে হয় তবে তুমি মনে কর সেই কাপড় তোমার জন্য খুবই নিকৃষ্ট। ইখলাস ও নিষ্ঠার দিগন্তে তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি সবসময় ঘুরপাক করতো। হৃদয়রাজ্যে থাকতো খোদার ভয়ভীতি। নিজের বর্ণনা নিজেই দিচ্ছেন, আল্লাহ তাআলা’র ভালোবাসা ব্যতীত আমার সকল আমলে আমার জন্য ক্ষতিকর কোন কিছুর আশঙ্কা আমাকে সবসময় তাড়া করে ফিরে। তিনি নিজের সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে বসে আছেন। নিজের মনের বাজে চিন্তাগুলো নিয়ে আলোচনা করছেন। তিনি বলেন, আমি রোগে আক্রান্ত। তখন আল্লাহ তাআলার জন্য মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমার সর্বাধিক আশা-ভরসা বিষয় দাঁড়ায়।

এই মনীষীর অনেক কারামত রয়েছে। লোকাতীত ও অলৌকিক বিষয়াবলীর মধ্যে একটি হল, তিনি জিলহজ্বের মাসের আট তারিখ বের হলেন। বসরাবাসীদের মাঝে তিনি তারস্বরে বলে উঠলেন, তোমরা কি হজ্জ্ব করবে? লোকজন বিড়বিড় করতে করে বলতে লাগল, হয়তো হযরতের ভীমরতি ধরেছে। তাই আজ এমন সময় হজ্জ্বের কথা বলছেন। কোথায় ইরাকের বসরা শহর আর কোথায় মক্কা নগরী? এই বিশাল দূরত্ব এই মুহূর্তে অতিক্রম করে কীভাবে সেখানে গিয়ে হজ্জ্ব করা সম্ভব! তিনি আবার বললেন, হজ্জ্ব করতে যারা ইচ্ছুক তারা বেরিয়ে পড়। লোকজন নিজেদের বাহন নিয়ে বের হল। তিনি তাদেরকে বললেন, উটের লাগাম ছেড়ে দাও। সকাল বেলায় সবাই লক্ষ্য করে দেখে, সবাই ‘তেহেমা’ মরুপ্রান্তরে উপস্থিত।
এই মহান ব্যক্তিত্ব হিজরী ১০৮ সালে বসরা নগরীতে মারা যান।