বকর ইবনে আব্দুল্লাহ্ আলমুযানী رحمة الله عليه (মৃ. ১০৮ হিজরী : ৭২৬ খৃস্টাব্দ)
ইচ্ছে হলেই যিনি আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রবেশ করতে পারতেন। জীবনভর ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তির ন্যায়। দরিদ্রের বেশে যিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। যতই অর্থ-সম্পদ বেড়েছিল ততই তিনি সেগুলো দান করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সহায়-সম্পদ দীন-দরিদ্র লোকদের জন্য আশ্রয় আর অভাবী লোকদের মরূদ্যান ছিল। শক্তিধর বক্তা, প্রামাণ্য ব্যক্তি, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি আবূ আব্দুল্লাহ্ বকর ইবনে আব্দুল্লাহ্ আলমুযানী আলবসরী। ভদ্র ও মার্জিত এক তরুণ। তাকওয়া ও পরহেযগারির দীপ্তি যাঁর চেহারায় জ্বলজ্বল করতো। বিচারপতির দায়িত্ব আসলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। শান-শওকতময় কাপড়-চোপড় পরিধান করে দীন-দরিদ্র লোকদের মাঝে বসতেন। এতে তাদের মনে আনন্দের শিহরণ লাগতো। তিনি বলতেন, আমার মনের ইচ্ছা, ধনীদের ন্যায় আমি জীবন যাপন করি আর অসহায় ও ছিন্নমূল লোকদের ন্যায় মৃত্যুবরণ করি। বাস্তবে দেখা গেছে যে, তার ইন্তেকালের পর সামান্য ঋণ রেখে মারা যান।
শাইখ সুলাইমান আত্তাইমী রহ. বলেন, হাসান বসরী বসরা নগরীর প্রধান মুরব্বী আর বকর আল্মুযানী হলেন সেই বসরা নগরীর শক্তিধর প্রাণপুরুষ। হযরত বকর আলমুযানী রহ. তাঁর দোআয় বলতেন, হে আল্লাহ! আমাকে এমন রিযিক দান করুন যা আমাদের কৃতজ্ঞতা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের যাবতীয় দীনতা ও দারিদ্র্য তোমাকে পর্যন্ত সীমিত থাকুক। তুমি ছাড়া অন্য কারও নিকট আমাদেরকে মুখাপেক্ষী করে রেখো না।
একদিন তিনি দরিদ্র লোকদের মাঝে অবস্থান করলেন। তিনি তাদের অন্তরে আনন্দ আর পুলকে ভরে দিলেন। বললেন, হে বনী আদম, তোমার মতো আর কে আছে ? কোন ধরনের দোভাষী ছাড়াই কথা বলতে পারো মহান আল্লাহ তাআলার সাথে।
বকর আলমুযানী দীন-দরিদ্র মানুষের মাঝে এক শক্ত অবস্থান তৈরী করতে পেরেছিলেন। তিনি তাদের মাঝে প্রশান্তিদায়ক ছিলেন। উদ্ধত প্রবৃত্তি নিবারণ করতে তাঁর কথা খুবই উপকারী ছিল। তিনি বলতেন, তোমার চেয়ে বড় কাউকে দেখলে বলবে, এই লোকটি আমার চেয়ে ঈমান ও নেক আমলের দিক দিয়ে এগিয়েছে। তাই সে আমার চেয়ে অবশ্যই ভালো। পক্ষান্তরে নিজের চেয়ে ছোট কাউকে দেখলে বলবে, আমি তার চেয়ে গুনাহ ও পাপে এগিয়ে আছি। সুতরাং সে আমার চেয়ে ভালো। যখন দেখো, নিজের বন্ধু-বান্ধব লোকেরা তোমাকে সম্মান করছে, সমীহ করছে তখন তুমি বলো, সম্মান করা ও সমীহ করা একটি মর্যাদার বিষয় যা তারা করছে। আবার যখন দেখো, তারা যথাযথভাবে সম্মান করছে না এবং সমীহ করছে না তখন তুমি মনে মনে বলো, এটা আমার কৃতকর্ম, আমার হাতের কামাই। গুনাহগার মানুষ তো আর সমাদৃত হয় না। আমিও গুনাহগার। সুতরাং বরণীয় না হওয়া আমার গুনাহর প্রতিফলন।
হজ্জ্বের মওসুম। মানুষের ভিড়। বনী আদমের মিছিল। আরাফাহ পর্বতে অগণিত মানুষের সমাগম। লোকজন রোনাজারি করছে। কান্নাকণ্ঠে হাজী সাহেবান দোআ-দরূদ পড়ছে। এমন সময় বকর আলমুযানী রহ. বললেন, তখন তাঁর গণ্ডদেশ বেয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছে, আমি এসব হাজী সাহেবানদের মাঝে না থাকলে বলতাম, তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, রোনাজারিরত হাজী সাহেবানদের গুনাহ মাফ করা দেয়া হয়েছে।
একবার তখনকার শাসক হযরত বকর আলমুযানী রহ.-কে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানের জন্য ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে বললেন, হে আবূ আব্দুল্লাহ্! আমি আপনাকে বিচারকার্যে নিয়োগ করতে যাচ্ছি। তিনি বললেন, আমি এ কাজের উপযুক্ত নই। কসম, বিচার সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান নেই। আমি যদি এ কথায় সত্যবাদী হই তাহলে তো আমাকে এ কাজের দায়িত্বশীল বানানো আপনার জন্য উচিত হবে না। আর যদি এ কথায় আমি মিথ্যাবাদী হই তাহলে তো মিথ্যুককে দায়িত্ব কিভাবে দিতে পারেন না।
বকর বিন আব্দুল্লাহ্ আলআলমুযানী রহ. শয্যাশায়িত। তিনি ক্ষীণকায়। লোকজন ও বন্ধুবান্ধব তাঁকে দেখতে আসলেন। তিনি তাদেরকে দেখে মাথা উঠিয়ে বললেন, আল্লাহ তাআলা দয়াপরবশ হোন সে ব্যক্তির উপর যাকে তিনি শক্তি দিয়েছেন এবং সে সে শক্তি তাঁরই আনুগত্যে লাগিয়েছে। আবার যখন তিনি তার শক্তি হ্রাস করেছেন সে তাঁর নাফরমানি থেকে বিরত থেকেছে।
হিজরী ১০৮ সালে এই মহান মনীষী ও আল্লাহ প্রেমিক লোকটি দুনিয়া ছেড়ে পরলোকে গমন করেন।