তায়ূস ইবনে কাইসান رحمة الله عليه (মৃ. ১০৬ হিজরী : ৭২৫ খৃস্টাব্দ)
কেউ দেখলে তাঁকে ভালোবাসবেই, অন্যের মজলিস তাঁর মজলিসই ভালো লাগবে। নিজের প্রয়োজন শুধু আল্লাহ তাআলাকেই জানাতেন। এমন কোন ফযীলত বা মর্যাদা নেই যা তার মাঝে ছিল না। ভালো গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাহার তাঁর মধ্যে ঘটেছিল। পার্থিব খাহেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। যিকির ও বিনয় দিয়ে দুনিয়া ভরে দিয়েছিলেন। তাকওয়ার সৌরভে নিজের আমালনামা ভরপুর ছিল। জীবন-অভিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠা পরহেযগারির সুবাসে সুবাসিত হতো। তিনি তায়ূস ইবনে কায়সান। ইয়ামেনের অধিবাসী। পারস্য বংশোদ্ভূদ। বড় বড় তাবেঈদের তিনি একজন। একধারে ফকীহ, বুযূর্গ ও বিনয়ী ব্যক্তি। বড় বড় শাসক ও বাদশাহদেরকে নসীহত করতে যাঁর এতটুকু ভয় লাগতো না।
জীবনে তিনি চল্লিশ বার হজ্জ্ব করেছিলেন। পঞ্চাশ জন সাহাবীকে দেখে যিনি ধন্য হয়েছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে যে, তিনজন ব্যক্তি রাজা-বাদশাহ থেকে দূরে থাকতেন। একজন আবূ যর, দ্বিতীয়জন তায়ূস এবং তৃতীয়জন হযরত সুফইয়ান সূরী রহ.। হযরত আমর রহ. বলেন, মানুষের অর্থকড়ি থেকে সম্পূর্ণ নির্লোভ ব্যক্তি হিসেবে তায়ূস রহ. চেয়ে অন্য কাউকে দেখিনি। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমার ধারণা তায়ূস একজন জান্নাতী লোক।
হযরত তায়ূস রহ. বলেন, বনী আদমের সব কথার হিসাব হবে। এমন কি রোগের ঘোরে যে সব শব্দ করে সেগুলোরও। জনৈক ব্যক্তি হযরত তায়ূস রহ. কে জিজ্ঞেস করলো, আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে দোআ করুন। তিনি বিনয় ও কাতর হয়ে বললেন, যে ভীতি নিয়ে দোআ করা চাই সেই ভীতি তো আমি আমার মাঝে পাচ্ছি না। যদি পেতাম তাহল আমি তোমাদের জন্য করে দিতাম।
হযরত আতা রহ. বর্ণনা করেন, এক বার হযরত তায়ূস রহ. আমাদের কাছে আসলেন, বললেন, আতা! যে ব্যক্তি তোমার সামনে তার দরজা বন্ধ করে দেয় তার কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা বলো না। যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তার কাছে কোন কিছু চেয়ে বলো না। নিজের প্রয়োজন ঐ সত্তার কাছে তুলে ধরো যার দরজা তোমার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত খোলা। তাঁর কাছেই চাও সকল প্রয়োজন। তিনিই সকল দরকারে সাড়া দিয়ে থাকেন।
বাদশাহ সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিকের পুত্র এসে হযরত তায়ূস রহ. এর নিকট এসে বসলেন। হযরত তায়ূস রহ. সে দিকে কর্ণপাতও করলেন না। কেউ একজন বলল, আপনার কাছে আমীরুল মুমিনীনের পুত্র বসল আর আপনি তার দিকে তাকালেন না? তিনি হৃদয়ে পরিপূর্ণ ইলম ও যুহদ নিয়ে বললেন, আমার উদ্দেশ্য হল, সে জানুক এ কথা যে, আল্লাহ তাআলার এমন কিছু বান্দা আছে দুনিয়ার এসব বাদশাহ’র নিকট যাঁদের কোন ঠেকা নেই।
বাদশাহ সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক একবার হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ আগমন করলেন। এসে বললেন, এখানকার ফকীহ ও ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদেরকে আমার কাছে আসতে বলুন। তাঁদেরকে আমি হজ্জ্বের কিছু মাসআলা জিজ্ঞেস করবো। তায়ূসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় লোকজন বলল, আমীরুল মুমিনীন, এই তো ইয়ামানী তায়ূস। দ্বারবান তায়ূসকে ধরে বললেন, আমীরুল মুমিনীনের ডাকে সাড়া দিন। তায়ূস বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন। দ্বারবান তাঁকে সামনে যেতে দিলেন না। সে তায়ূসকে আমীরুল মুমিনীনের সামনে নিয়ে আসলো। তায়ূস রহ. বাদশাহ’র সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, এখানে তো আল্লাহ তাআলা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন। এরপর বলতে লাগলেন, আমীরুল মুমিনীন, একটি জবরদস্ত জগদ্দল পাথর। জাহান্নামের কিনারায়। সত্তর বছর ধরে পড়তে পড়তে একসময় জাহান্নামের তলদেশে স্থির হয়েছে। আপনি কি জানেন সেই পাথরটি আল্লাহ তাআলা কাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন? সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক বললেন, না। আমি তো তা জানি না। এরপর তিনি তারস্বরে বলে উঠলেন, কী দুর্ভোগ এ পাথর যাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তায়ূস বললেন, আল্লাহ তাআলা যাদেরকে তাঁর হুকুমের মধ্যে শরীক করেছেন আর সে কিনা জুলুম করেছে তার জন্য এই পাথর প্রস্তুত করা হয়েছে। এই কথা শোনে সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক কাঁদতে লাগলেন। চোখের জলে নয়ন ভাসলো।
একবার তায়ূস মক্কা শরীফে আসলেন। ঘটনাক্রমে সেদিন সেখানে নতুন আমীরের সাথে দেখা। সেখানে লোকজন জড়ো হয়ে গেলো। তায়ূসের সমবেত হল। উদ্দেশ্য নতুন আমীরের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা। লোকজন তায়ূসকে বলতে লাগলো, এই আমীরের বহু দান-অবদান এবং তাঁর অনেক ফযীলত। তায়ূস বললেন, নতুন আমীরের সাথে দেখা করা আমার কোন প্রয়োজন নেই। তারা বলল, এতে আপনার ক্ষতি হবে। তিনি বললেন, যা হবার তা হোক।
হযরত তায়ূস রহ. শীত মওসুমে ফজর নামায পড়ছিলেন। তিনি সেজদায় অবস্থায় আছেন। এমন সময় শহরের আমীর যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁকে দেখে ঠাণ্ডা লাগার আশঙ্কা করলেন। তাই আমীর নিজের চাদর খানি তাঁর গায়ে জড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তায়ূস রহ. নামায শেষ করে দেখলেন, তাঁর গায়ে এক খানি চাদর। মুহূর্তের মধ্যে শরীর নেড়ে ফেলে দিলেন। কর্ণপাতও করলেন না। এভাবে চলে গেলেন বাড়িতে।
হিজরী ১০৬ সালের ৭ যিলহজ্ব তারিখে মক্কা শরীফে ইন্তেকাল করেন। তখন হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক হজ্জ্ব করতে এসেছিলেন। তিনিই তাঁর জানাযার নামায পড়িয়েছিলেন।