সাফ্ওয়ান ইবনে মুহরিয رحمة الله عليه (মৃ. ৭৪ হিজরী : ৬৯৩ খৃস্টাব্দ)
সালাত ও নামাযের চেরাগে যিনি রাতকে আলোকিত করেছিলেন। যাঁর ঘরই তাঁর কবর। ব্যক্তিত্বপূর্ণ একজন মানুষ। শুধু আলহামদুলিল্লাহ বলে মানুষকে কাঁদিয়েছেন। আন্তরিকতা আর আমলের একনিষ্ঠতা হৃদয়ের গহিনে ছুঁয়েছে। যাঁর কথামালা হৃদয়কাড়া ছিল। তিনি নেক আবেদ। অসামান্য প্রতিভাবান ও বুযূর্গ লোকদের তিনি একজন। তিনি সাফওয়ান ইবনে মুহ্রিয ইবনে যিয়াদ আলমাযিনী। বিখ্যাত তাবেঈ। রাত জেগে ইবাদতগুজার। অশ্রুবিধৌত নয়নসিক্ত এক ব্যক্তি। ইবাদত সমুদ্রে সন্তরণশীল এক ব্যক্তি। দুনিয়া চিনেছে। তাই গ্রহণ করেননি সামান্য সামগ্রী। নামাযের চেরাগে রাতের তিমির বিদূরিত করেছিলেন। জাগতিক কথাবার্তা বলতে চাইতেন না। দুনিয়ায় বাদশাহ’র ন্যায় থাকতেন। দুনিয়া তাঁর পদযুগলে এসে ভিড় করেছে। মুকুটহীন সম্রাট। মাথায় থাকতো সম্মান ও তাকওয়ার মুকুট।
সিয়াম সাধনায় হায়াত কাটিয়েছেন। সামান্য রুটি খেয়ে ইফতার করতেন। সামান্য পানি পান করে পরিতৃপ্ত হতেন। এই সামান্য খাবার ও পানীয় খেয়ে সারা রাত সকাল পর্যন্ত জেগে নামাযে লিপ্ত থাকতেন। ফজর নামায শেষ করে কুরআন শরীফ হাতে নিতেন। দেখে দেখে যোহর বেলা বাড়া পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন। এরপর দ্বিপ্রহর পর্যন্ত নামায পড়তেন। বেলা ঢলে পড়লে তিনি সামান্য বিশ্রাম নিতেন। আমৃত্যু এটাই তাঁর অভ্যাস ছিল। যোহর নামায শেষে আবার আসর পর্যন্ত নামায পড়তেন। আসর নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
হযরত হাসান বসরী রহ. লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন। তারা হাসান বসরী রহ. থেকে উপদেশ ও ইলম হাসিল করতে চাচ্ছেন। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, কিছু লোকের সাথে আমার দেখা। হারামের ব্যাপারে আপনারা যেমন সচেতন তাঁরা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক তাঁদের জন্য হালালকৃত বিষয়ে তার চেয়ে অধিক সচেতন। অন্য দিকে আরও কিছু লোকের সাথে দেখা হয়েছে। যাঁরা নিজেদের গুনাহের কারণে তাঁদের নেকির আমলগুলো কবুল না হওয়ার আশঙ্কায় থাকে। তৃতীয় আরেক গ্রুপের সাথে আমার দেখা। এই পৃথিবীতে খায় আর ঘুমায়। তাদের একজন সাফওয়ান ইবনে মুহরিয।
বাড়ি-ঘর নির্মাণে দুনিয়াবাসিদের সাথে যোগদান করেননি। যেসব সুস্বাদু ও মজাদার খাবারের জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকে সেগুলোর জন্য সাফওয়ান ইবনে মুহরিয রহ. লালায়িত ছিলেন না। নিজের জন্য মাটির নিচে একটা গুপ্ত-কক্ষ তৈরি করলেন। সেখানে তিনি ঘুমাতেন। বেঁতেবর্তে থাকার জন্য তিনি রুটি খেতেন। পানি পান করে বলতেন, দুনিয়া ও দুনিয়াবাসীর প্রতি সালাম নাযিল হোক।
বুলবুলের সুরের ন্যায় তাঁর কথা শ্রুতিমধুর ছিল। দু’ঠোঁট গড়িয়ে যখন কোন কথা বের হতো তখন দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতো। হৃদয়-উৎসারিত কথা বলতেন। মানুষের হৃদয়ে ঝঙ্কৃত হতো সেসব কথা। হযরত সাফওয়ান ইবনে মুহরিয রহ. নিজের সঙ্গী-সাথীদের সাথে কথা বলতেন। যিকির ও আখেরাত সম্পর্কে কথা বলতেন। এতে তাঁদের হৃদয় বিগলিত হতো। তারা বলতো, আপনি আরও বলুন।
হযরত সাফওয়ান ইবনে মুহরিয রহ. আলহামদুলিল্লাহ্ বলতেন। এতে তাদের মনে দাগ কাটতো। মুষলধারে চোখের পানি পড়তো। তিনি যখন দোআ করতেন তাঁর দোআ কবুল হতো। আকাশের দরজা খুলে যেতো। কোন দোআই বাতিল হতো না। একবার বসরা শহরের গভর্নর হযরত সাফওয়ান ইবনে মুহরিয রহ.এর ভাতিজাকে গ্রেফতার করে জেলখানায় বন্দী করে ফেলে। ভাতিজাকে ছাড়ার জন্য সাফওয়ান রহ. শহরের প্রায় সকল সম্ভ্রান্ত লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়েছিলেন। সকলের কাছে ভাতিজার মুক্তির আবেদন করেছিলেন। একবার তিনি জায়নামাযে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে রাত যাপন করলেন। তন্দ্রা চেপে বসল। ঘুমে একজন আগন্তুক ব্যক্তি এসে বলল, সাফওয়ান! তোমার কী প্রয়োজন? যে কোন প্রয়োজনের কথা বলতো পারো। তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। উযূ করে নামায পড়লেন। দোআ করতে লাগলেন। বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় উচ্চস্বরে দোআ করতে লাগলেন। যেন আকাশের দরজা ভেদ করে উপরে উঠে যাবে সে দোআ।
বসরা গভর্নর ইবনে যিয়াদের অনিন্দ্রায় আক্রান্ত। ঘুম নেই। ছটফট করছে বিছানায়। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। ভয়ভীতির একটা ছাপ তাঁর কপালে রেখাপাত করে আছে। উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, সাফওয়ানের ভাতিজাকে মুক্ত করে আমার কাছে নিয়ে আসো। তার জন্যই আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রহরী সাফওয়ানের ভাতিজাকে নিয়ে হাজির। ইবনে যিয়াদ তাকে বললেন, তুমি তাকে সাফওয়ানের কাছে নিয়ে যাও। নোটিশ বা মুক্তির পরওয়ানা দরকার নেই। সাফওয়ানের কোন খবরই নেই। প্রহরী সোজা গিয়ে সাফওয়ানের দরজা কড়াঘাত করতে লাগল। গিয়ে গভর্নরের সকল ঘটনা তাঁকে প্রহরী শোনাল।
সাফওয়ান ইবনে মুহরিয রহ. বসরা নগরীতে হিজরী ৭৪ সালে মারা যান। তখন সেখানে শাসনক্ষমতা ছিলেন বিশর ইবনে মারওয়ান।