আলকামাহ ইবনে কাইস رحمة الله عليه(মৃ. ৬২ হিজরী : ৬৮১ খৃস্টাব্দ)
আকাশের শিরা-উপশিরায় ও রন্ধ্রে রন্ধ্রে যাঁর আত্মা ঝুলন্ত। হৃদয়ের তন্ত্রীগুলো কুরআনের ধ্বনিতে গুঞ্জরিত হতে থাকতো। কস্তুরি মশকের যাঁর আনাগোনায় কেবল সুঘ্রাণ ছড়াতো। তিনি দরবেশ ও যাহিদ গোষ্ঠীর বুলবুল, ক্বারী সম্প্রদায়ের শোভা এবং এই উম্মতের আল্লাহওয়ালা বুযূর্গ। তিনি আল্কামাহ ইবনে কাইস ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মালিক আন্নাখায়ী আলহামাদানী, আবূ শিবল। প্রখ্যাত তাবেঈ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। যুহদ ও আখেরাতমুখী লোকদের শীর্ষ অবস্থান করে দুনিয়া ছেড়েছিলেন।
রাসূলে আকরাম ﷺ এর জীবদ্দশায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইলম ও জ্ঞানের কথা বর্ণনা করেন। সাহাবা কেরাম থেকে ফিকহ সংগ্রহ করেন। ঈমানের তরবারির জোরে যিনি জিহাদের ধুলোবালি উড়ান। অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। সিফফীন ও খুরাসান জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। থাকতেন কুফা নগরীতে। তিনি ইরাকের ফকীহ-ইসলামী আইনজ্ঞ ও মুসলিম প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রা. এর সাথে চেহারা-সুরত ও চালচলনে যাঁর মিল ছিল।
হযরত দাঊদ আলাইহিস সালামের বাঁশীর সুরের ন্যায় যাঁর কণ্ঠ ছিল সুমধুর। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. তাঁকে বলতেন, আমার আব্বা-আম্মা তোমার জন্য উৎসর্গ হোক, তুমি সুমধুর কণ্ঠে তেলাওয়াত কর। প্রতি পাঁচ দিনের মাথায় কুরআন শরীফ এক খতম করতেন। নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোকগমন করেন। শাইখ মুররা তাঁর প্রশংসা করেছিলেন এই বলে, আলকামাহ এই উম্মতের বুযূর্গ ব্যক্তি। অসাধারণ ইলম ও গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর ইলম ও প্রজ্ঞার প্রাচুর্যের কারণে সাহাবা কেরামসহ লোকজন তাঁর কাছে যুগের জিজ্ঞাসা জানতে আসতো। ফাতাওয়া ও দৈনন্দিন প্রশ্নাদি তাঁকে জিজ্ঞেস করতো। স্বয়ং আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. প্রশংসা করে বলেন, আমি যে ক্বেরাতই পড়ি কিংবা ইলম ও প্রজ্ঞার কথাই বলি সেটা আলকামাহ জানে ও পড়ে।
একদিন কাবূস ইবনে আবূ যুবইয়ান তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি সাহাবা কেরাম থাকতে তাঁদের শরণাপন্ন না হয়ে আলকামাহ এর নিকট কেন গমন করেন? তিনি বললেন, যেখানে দেখতে পাই স্বয়ং সাহাবা কেরাম আলকামাহকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা তাঁর কাছে ফাতওয়া চান তাহলে আমার তাঁর দ্বারস্থ হতে বাধা কোথায়?
বিশাল ইলম ও প্রজ্ঞার অধিকারী এই আলেম কখনও আসর জমাতেন না। ইলমের মজলিস করতেন না। তিনি সেগুলো এড়িয়ে চলতেন। একদিন জনৈক ব্যক্তি বলল, আপনি যদি মসজিদে বসতেন, লোকজন আপনার কাছ থেকে ইলম সংগ্রহ করতে পারতো এবং আপনি ফাতাওয়া প্রদান করতে পারতেন? একথা শোনার সাথে সাথে ভয়ে তাঁর শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়ে যায়। মাথা নেড়ে শুধু এতটুকু কথা বললেন, আমার পদচিহ্ন পদদলিত হোক আমি সেটা চাই না। (ভক্ত ও শিষ্যবৃন্দ পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করি তা আমার পরম অপছন্দনীয় বিষয়)। মানুষ আঙ্গুল নির্দেশ করে বলবে, ইনি আলকামাহ!!
সর্বদা নিজের পৃষ্ঠদেশ ফিরিয়ে রেখেছিলেন আমীর ও শাসকবর্গের দরজার দিকে। নিজেকে কখনও উপস্থিত করেননি তাঁদের দরবারে। বাদশাহ’র চৌকাঠে কখনও পা ওঠেনি। রাজা ও আমীরের চৌকাঠ কখনও মারাননি তিনি। একলোক বলল, বাদশাহ’র কাছে কেন যান না? গেলে তো তিনিও উপকৃত হতে পারতেন। একথা শোনে চটে গিয়ে বললেন, কসম, তাঁদের দুনিয়া থেকে তো আমরা সামান্যও উপকৃত হবো না। কিঞ্চিৎ উপকৃত হলেও সে পরিমাণই তারা আমাদের থেকে দ্বীন লাভ করতে পারবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা হয় উপকারের চেয়ে আমাদের ক্ষতিই বেশিই হয়ে যাবে।
মুহাদ্দিস আবূ ওয়েল রহ. হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে আমাদেরকে বলেছেন, ইবনে যিয়াদের উদ্দেশ্যে বসরা এবং কুফা নগরীতে কেন আসেন? তিনি বললেন, সফর সঙ্গী হয়ে আসলাম। আলকামাহকে জিজ্ঞেস করলাম এ সম্পর্কে। তিনি বললেন, আমার জানা মতে, তুমি তাঁর থেকে যা কিছু হাসিল করবে তিনি তোমার থেকে তার চেয়ে বেশি হাসিল করবে।
যখন তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় শায়িত, মরণাপন্ন অবস্থায় বলেছিলেন, জাহিলী যুগের ন্যায় কান্নাকাটি করে আমার জন্য বিলাপ কর না। আমার কারণে কাউকে কষ্ট দিয়ো না। দরজা বন্ধ রাখবে। আমার জানাযায় কোন নারী যেন অংশগ্রহণ না করে। তোমরা আমার জানাযায় আগুন সাথে নিয়ে আসবে না। সম্ভব হলে তোমরা আমার শেষ কথাটি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলার জন্য চেষ্টা করবে।
হিজরী ৬২ সালে তিনি মারা যান। কুফার পবিত্র মাটিতে তাঁর সমাহিত করা হয়।