ভালোবাসা: তারতম্য ও ভারসাম্য -১
ভালোবাসা কী ও কেন? কার জন্যই বা কতটুকু?
একজন মুমিন হিসেবে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া জরুরি। কারণ ভালোবাসা বিষয়টি এমন যা দেখা যায় না কিন্তু উপলব্ধি করা যায়। এটি অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেখানে মানুষের সবচে দামী জিনিস বরং অমূল্য সম্পদ ঈমান অবস্থান করে!
ভালোবাসার নিদর্শন ও প্রকাশ
তবে দেখা না গেলেও কে কাকে ভালোবাসে, সেটা বোঝা যায়। তার আলামত আর প্রমাণও মিলে। তা লুকিয়ে রাখা কঠিন। ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার বস্তুও নয়! যে ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা হয় বা যে ভালোবাসাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় সেটা কি আদৌ ভালোবাসা?!
ভালোবাসা গুণ মানুষ কোথা থেকে পেল
আমাদেরকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদেরকে অশেষ ভালবাসে ও দয়া করে সৃষ্টি করেছেন। আবার আমাদের অন্তরে তিনিই ভালোবাসা নামক প্রকৃতি বা গুণটি দান করেছেন। এ ফলশ্রুতিতেই কাউকে আমরা নিজেকে বা কাউকে ভালোবাসতে পারি। মৌলিকভাবে ভালোবাসা একটি গুণ, কিন্তু তার অপব্যবহারের ফলে সেটাই আবার দোষ হতে পারে! কারণ সব ভালোবাসা গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয় নয়।
ভালোবাসার সবচেয়ে বড় হকদার কে
ভালোবাসাকে যদি আমরা মৌলিক সেই গুণ ‘ভালোবাসা’ বিবেচনা করি, তাহলে সে ভালোবাসার সবচেয়ে বড় হকদার অর্থাৎ ভালোবাসা লাভের সবচেয়ে বেশি অধিকার রাখেন সেই সুমহান পবিত্র সত্ত্বা যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অফুরন্ত নেয়ামত দান করে সবসময় আমাদের লালন পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর মতন কেউ নেই! তাঁর ভালোবাসার কোনো সীমা নেই, তাঁকে ভালোবাসারও নেই কোনো সীমা-পরিসীমা!
প্রিয় মালিক, প্রিয় খালিক, তুলনাবিহীন একক সত্ত্বা তিনি। আমরা তো অস্তিত্বহীন ছিলাম! নিজেকেই যেখানে চিনতাম না, তাঁকে চিনব কিভাবে?! তিনি নিজ পরিচয় তুলে ধরে আমাদের নিজ পরিচয়ও আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। তারপর কিছুটা জানলাম ও বুঝলাম: আমার মালিক কে, আমি কে।
আল্লাহকে কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللّهِ أَندَاداً يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللّهِ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَشَدُّ حُبًّا لِّلّهِ
অর্থ: আর কিছু লোক এমন আছে যারা অন্যদেরকে আল্লাহ পাকের সমকক্ষ হিসেবে সাব্যস্ত করে, যাদেরকে তারা আল্লাহ পাককে ভালোবাসার মতন ভালোবাসে। আর ঈমানদারদের রয়েছে এর চেয়ে বেশি আল্লাহর ভালোবাসা। সূরা বাকারা: ১৬৫
আলোচ্য বিষয়টি অনেক ব্যাপক! এটির সংক্ষিপ্ত আলোচনা দুরূহ ব্যাপার। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে কিছু আলোকপাত করব..লেখক-পাঠককে আল্লাহ পাক তাওফীক দিন, উপকৃত করুন। (হে আল্লাহ! আমরা তোমার ভালোবাসা চাই, তোমাকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে চাই!)
সবাই কি আল্লাহর আশেক হবে?
স্বাভাবিক ও সুস্থ বিবেকের দাবী হল, যিনি আমাকে বেশি দান করেছেন, তাকেই আমি বেশি ভালোবাসব। এভাবেই প্রাথমিকভাবে বুঝুন যে, ঈমানদার ব্যক্তি, সে হোক পুরুষ অথবা নারী, সে এ কথা অকপটে স্বীকার করে যে আল্লাহ তাআলার দান-অবদানই সবার ওপর সবচেয়ে বেশি। আর বাস্তব কথা এটিই যে, সব দান-অবদানই একমাত্র আল্লাহ তাআলার! সবকিছুর মূল একমাত্র মালিক তিনি, কেবল তিনিই। অতএব, তাঁর প্রতি ভালোবাসা স্বভাবজাতভাবে সমগ্র সৃষ্টির রয়েছে। তবে, জিন ও মানবজাতিকে আল্লাহ তাাআলা সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষার উদ্দেশ্যে। এই দুই জাতিকে দুটো পথের যেকোনো একটি অবলম্বন করার সুযোগ করে দিয়ে পার্থিব জগৎ তথা দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।
হয় জিন ও মানুষ আল্লাহ তাআলার ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেবে, না হয় সে প্রাধান্য দেবে নিজের খেয়াল-খুশিকে। খাঁটি একজন ঈমানদার সবসময় আল্লাহ তাআলার ভালোবাসাকেই প্রাধান্য দেবে। এভাবে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পার্থিব জগতের পর পরকালীন জগতে পুরস্কৃত হয়ে সফল হবে। আর যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আনবে না, তাদের ভালোবাসার প্রাধান্য অন্য কারো জন্য — নিজের খেয়াল-খুশি মুতাবিক হবে।
বুঝতে হবে, আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা চিরস্থায়ী ভালোবাসা! অন্য যত সত্য বা খাঁটি ভালোবাসা রয়েছে তার মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। কারণ এটি হল স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির ভালোবাসা! এ ভালোবাসা খাঁটি বা সত্য হলে তা অনন্ত কালের জন্য, সেটির পুরস্কারও অনন্ত কালের পুরস্কার হবে!
আল্লাহকে ভালোবাসার স্তর রয়েছে
আবার ঈমানদারের মধ্যেও আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসার স্তর রয়েছে। সব ঈমানদার আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে। এটি অনস্বীকার্য। কিন্তু ব্যক্তি ভেদে এ ভালোবাসার পার্থক্য হয়।
দূর্ভাগ্যের লক্ষণ
আর যদি কোনে ব্যক্তি এটি কথা বা কাজ দ্বারা স্পষ্ট প্রকাশ করে যে সে আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে না, তার ভালোবাসার মূল পাত্র আল্লাহ নন, তাহলে তো ভিন্ন কথা! সে তো ঈমানদারই নয়। এটিও একজন ঈমানদারের জানা ও বোঝা থাকা দরকার। কারণ, কোন্ ভিত্তিতে সে ঈমানদার?! আল্লাহ তাআলার প্রতি আমার খাঁটি ভালোবাসা নেই, বা আমি তাতে একটুও আগ্রহী নই — মা’আয আল্লাহ! — এ তো দূর্ভাগ্যের লক্ষণ ছাড়া কিছু না!
যারা আল্লাহর ভালোবাসা বঞ্চিত
যে বা যারা আল্লাহ তাআলার কোনো আদেশ-নিষেধকে তাচ্ছিল্য করে বসে, অস্বীকার করে বসে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কটু বা বিরূপ মন্তব্য করে বসে, তারা যতই নিজেদের নাম আবদুল্লাহ, আবদুর রাহমান, ফাতিমা, আয়েশা রাখুক বা দাবী করুক, তারা (অন্তত ঐ কৃতকর্মের দরুণ এখন আর) ঈমানদার নয়, যদি তারা সম্পূর্ণ খাঁটিভাবে ইসলামের মধ্যে ফিরে না আসে। তাদের এ জাতীয় কাজগুলিও কারো ভালোবাসা ও মায়ায় হয়ে থাকে। কখনো সেটা হয় সম্পদের ভালোবাসা, অথবা পদবী/ক্ষমতার লোভ, বা অন্য কারো ভালোবাসা।
যে ভালোবাসা আল্লাহ পাকের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দেয়, যে ভালোবাসা অন্য কোনো লোভ-লালসাকে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পরিবর্তে গ্রহণ করা একদমই সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে যায় তা অবশ্যই কোনো সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, আর সেটা অবশ্যই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা পরিপন্থী কোনো ভালোবাসা! সেটাকে অন্য জাতির লোকেরা খাঁটি অথবা সত্য দাবী করতে পারে। খাঁটি ঈমানদার জানে ও মানে যে তওবা ব্যতীত এসব ভালোবাসা একদিন চির অনুতাপের কারণ হবে!
বড়কে ভালোবাসার সাধারণ বৈশিষ্ট্য
বড়কে ভালোবাসার সঙ্গে তার জন্য ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের পাশাপাশি, তাকে শ্রদ্ধা ও মান্য করা অতীব জরুরি বিষয়! বড় কারো সঙ্গে ভালোবাসার অর্থ হল, তার শ্রদ্ধা ও আনুগত্যকে আমরা শিরোধার্য মনে করি! এ ভালোবাসার বন্ধন যত বেশি দৃঢ় হবে, ছোট বড়কে তত বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা করবে, তাকে তত বেশি মানবে!
আমরা যে কেউ কোনো বড় কাউকে ভালোবাসার দাবী করি না কেন, আমাদের মাঝে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিদ্যমান। চিন্তা করুন এক্ষেত্রে বড়, যাঁকে ভালোবাসা হবে, তিনি যখন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা, আর তাঁকে ভালোবাসে বান্দা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, আনুগত্য, কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের বিষয়গুলো কেমন হতে পারে?!
আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা সর্বশ্রেষ্ঠ, অতুলনীয়
এ তো সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির ভালোবাসা নয়, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির ভালোবাসা। স্রষ্টা যিনি আসল স্রষ্টা, কোনো মূর্তি-পুতুল তো নয়ই, কোনো সৃষ্টির প্রতিকৃতি নয়, কোনো মৃত-জীবিত সৃষ্টিও নয়, আসল স্রষ্টা যাঁর পরিচয় তাঁর বিশেষভাবে নির্বাচিত সত্যবাদি বান্দা অর্থাৎ নবী-রাসূলদের মাধ্যমে প্রামাণিকভাবে মানুষ পেয়েছে, সেই সুপবিত্র, সুমহান সত্ত্বা, আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা, সর্বশ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়।
প্রত্যেক ঈমানদার আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা লাভের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত!
Last Updated on July 18, 2023 @ 6:45 pm by IslamInLife বাংলা