হজ্ব ও উমরাহ

হজ্ব: ৬

আমাদের তো এ প্রত্যাশাই ছিল যে, হজ্ব সংক্রান্ত নানাবিধ বিষয়, কমপক্ষে যেগুলো মৌলিক সেইগুলোই আলোচনা করব। কিন্তু, পাঠকদের কাছে বড় ভগ্ন হৃদয়ে এ কথা নিবেদন করছি যে, তা যেন সম্ভব হল না। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, এ আমাদের অপূর্ণতা। আল্লাহ তাআলার সুমহান দরবারে দোআ যে, এ হজ্বের মৌসুমে না হলেও যেন দ্রুত শেষ করার তাওফীক তিনি দেন। আমীন।

শ্রদ্ধেয় হাজীদের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে বলছি। মক্কা-মদীনা-আরাফাহ-মীনা-মুজদালিফাহ আল্লাহ তাআলার আশেকদের জায়গা। যে জায়গাগুলিতে সব আম্বিয়া عليهم السلام, বিশেষভাবে সাইয়্যেদুল মুরসালীন ﷺ-এর এবং হাজার হাজার সাহাবায়েকেরাম رضي الله عنهم -এর পবিত্র পদধূলি পড়েছে। আবহমান কাল ধরে যেখানে আল্লাহ তাআলার লাখো-কোটি আশেক তথা আল্লাহওয়ালাদের পদাচরণ হয়েছে। সেখানে আল্লাহ তাআলা আপনাকে নিচ্ছেন।

আর এ তো বলাই বাহুল্য যে, যে পূণ্যভূমিতে বায়তুল্লাহ, যেখানে পবিত্র রওযায়ে আতহার, কারো যদি সে জায়গায় যাওয়ার ভাগ্য জুটে যায়, তার কেমন শুকরিয়া আদায় করা উচিত? সেখানে ক্ষণিকের উপস্থিতিই তো কল্পনাতীত নেয়ামত।

কোনো একজন বুযূর্গ কতই না সুন্দর বলেছেন, যাচ্ছ তো বাবা মক্কা-মদীনা…! সেই মক্কা-মদীনা সম্পর্কে একটু জেনে তারপর যেও। জেনে যাও তুমি আসলে যাচ্ছ কোথায়!

সেই পবিত্র স্থানে যাওয়ার পূর্বে এই অনুভূতি জাগ্রত থাকা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে নিচ্ছেন। আমার সাধ্য নেই সেখানে যাওয়ার। আমি তো এর উপযুক্ত নই। সেখানে ইবাদত করব, তাওয়াফ-সাঈ করব, রওযায়ে আতহারে সালাম পেশ করব –এ তো আরো বড় ভাগ্যের বিষয়। সেখানে সামান্য থেকে সামান্য সময় অবস্থানের আদবই তো আমার জানা নেই।

বুযূর্গানে দ্বীন নসিহত করতে গিয়ে এ কথাও বলে থাকেন যে, তুমি অনেক কিছু জানো, তুমি অমুক, তুমি এত বার হজ্ব করেছ বলে তোমার অভিজ্ঞতা বেশি। …সাবধান! অবশ্যই এসব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে বায়তুল্লাহর দিকে রওনা দেবে। তোমার রব যেভাবে তোমাকে দয়া আর মায়া করে নিয়ে যাচ্ছেন, সেই মহামহিম আল্লাহ তাআলার দরবারে ভিখারি সেজে, অন্তরকে সাধ্যমত দুনিয়াবিমুখ করে রওনা দেবে। নিজেকে মিটিয়ে আল্লাহ তাআলার এবং তাঁর রাসূলের ﷺ মহব্বত-কে সর্বাধিক অমূল্য মনে করে পাগলপারা হয়ে এই পবিত্র সফরে রওনা হবে। তাঁর সাহায্য কামনা কর। তুমিতো সব বিষয়ে তাঁরই মুখাপেক্ষী। হজ্ব কবুল হওয়া আর সহজ হওয়ার জন্য তুমি সেই সুমহান সত্ত্বার পরিপূর্ণ মুখাপেক্ষী, এ কথা যেন সদা মনে জাগ্রত থাকে। হজ্বকে সাফল্যমন্ডিত করার এটাই মূল উপায় ও অবলম্বন।

এমনকি তুমি যখন সেই পবিত্র ভূমিতে পৌঁছবে, তোমার আশেপাশে কার কী অবস্থা – এ দৃশ্য অবলোকনে ব্যস্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। চিন্তার দৌড় সীমাবদ্ধ থাকবে নিজের কবুলিয়াত, নিজের সংশোধন, নিজের নাজাতের মধ্যে। কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ তো সেই পবিত্র ময়দানে অসম্ভব। আমার দ্বারা আল্লাহ তাআলার কোন বান্দার, নবীজির ﷺ এর কোনো উম্মতের সামান্যও কষ্ট হয়ে যায় কিনা – এ দুশ্চিন্তায়ই তো একজন ঈমানদারের বিভোর থাকা উচিত।

আল্লাহ তাআলার প্রকৃত আশেকগণতো এরও বহু ঊর্ধ্বে। তাদের চিন্তা চেতনা বিলীন হয়েছে শুধুই আল্লাহ তাআলার মহব্বতের গভীর সমুদ্রে।
নিজেকে আল্লাহ তাআলার জন্য মিটিয়ে দিয়ে যে হজ্ব করা হবে, ইনশাআল্লাহ, সেই হজ্ব তার জন্য হবে দুনিয়া ও আখেরাতের মহাসম্পদ।

হজ্ব-কে মাবরুর বানানোর জন্য আমরা কমপক্ষে কুরআনের এই আয়াত সামনে রাখি:

ٱلۡحَجُّ أَشۡهُرٞ مَّعۡلُومَٰتٞۚ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ وَمَا تَفۡعَلُواْ مِنۡ خَيۡرٖ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُونِ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ ١٩٧ 

অর্থ: হজ্বের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের উপর হজ্ব অবধারিত করে নেয়, সে হজ্বের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গুনাহ করবে না, এবং ঝগড়াও নয়। তোমরা যা-কিছু সৎকর্ম করবে আল্লাহ তাআলা জানেন। আর হজ্বের সফরে পথ খরচা সাথে নিয়ে নিও। বস্তুত তাকওয়াই উৎকৃষ্ট অবলম্বন। আর হে বুদ্ধিমানেরা! তোমরা আমাকে ভয় করে চলো। [সূরা বাকারা: ১৯৭]

হজ্বের পাঁচ দিন বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলার ঘরে আল্লাহ তাআলার মেহমান হয়ে এমন কিছুই করা যাবে না, যা শ্রেষ্ঠ মেজবানকে অসন্তুষ্ট করে। যেই বায়তুল্লাহ ক্ষমা, হেদায়াত, আকর্ষণে ভরা, আল্লাহ তাআলার রহমত ও মহব্বতের জোয়ার ও নূরের বৃষ্টি যেখানে ক্রম বর্ষমান, সেখানে কোনোভাবেই একটি মুহূর্ত বৃথা যাওয়া উচিত নয়। তাই দুআ ও যিকিরের মাঝে থাকতে চেষ্টা করতে হবে। অতি বিনয় ও ভক্তির সাথে চলতে হবে। আল্লাহ তাআলার কোনো বান্দার যেন আমার দ্বারা কষ্ট না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। আবেগ যেন আমাকে নিয়ন্ত্রণ না করে। শরিয়তের অধীন জযবা ও আবেগ খুবই ভালো। কিন্তু আমার নফসের অধীন আবেগ খুবই ক্ষতিকর। ভুল-ত্রুটি হতে পারে; হয়েই যায়। কিন্তু সতর্ক থাকা উচিত এবং ইস্তেগফার করা (ক্ষমাপ্রার্থনা) জরুরি।

হজ্বের পাঁচদিন ছাড়াও পুরো সময়টাই বিরাট গনীমত। মক্কা-মদীনায় মুমিনের এই অবস্থান – এ কোনো সাধারণ বিষয় নয়। জীবনে বার বার এই তাওফীক সবার ভাগ্যে জুটে না। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে বার বার যাওয়ার তাওফীক চাব অবশ্য।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাযগুলো হেরেম শরীফে ও মসজিদে নববীতে পড়ার প্রতি যত্নবান হব। অমূল্য সময়কে তাওয়াফ, কাবা শরীফ দেখা, দুআ, তেলাওয়াত, যিকির, নিজের সংশোধনের ফিকিরে অতিবাহিত করব। মদীনায় অবস্থানকালে যথাসম্ভব রওযায়ে আতহারে সালাম পেশ করব। মক্কা-মদীনার স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলিতে দাঁড়িয়ে, বা চলতে চলতে হাজার বছর আগের নবী-রাসূল عليهم السلام গণের মুজাহাদা (কষ্ট) ও কুরবানী (ত্যাগ)  এর বিষয়গুলোকে তাজা করে শিক্ষা নেব।

নিজের নযর, যবানকে খুব সংযত রাখব। পবিত্র হজ্জ সফরতো এমন যে, মন-দিলকে পর্যন্ত বেশি আল্লাহ-মুখী রাখব। অধিক যিকির ও আত্মসংশোধনের চিন্তার মাধ্যমে এটা সম্ভব ও সহজ।

একজন হাজীর এ মানসিকতা থাকবে যে, আমি নিজ সাথীদের খেদমত করব। জানা নেই কোন আমলটি কবুল হয়ে যাবে। হয়ত সামান্য ও ছোট্ট কোনো আমলই আমার নাজাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে! হে আল্লাহ, তুমি কবুল কর, সহজ কর, তাওফীক দাও! আমীন।

Last Updated on December 12, 2024 @ 8:56 am by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *