পারিবারিক জীবনইলমে দ্বীন/দ্বীনি ইলম

ইসলামে সন্তানের অন্যতম অধিকার দ্বীনি শিক্ষা

সন্তান-সন্ততি নেয়ামত, আর যার কোনো সন্তান নেই..

সন্তান-সন্ততি নিঃসন্দেহে অনেক বড় নেয়ামত। নিঃসন্তান কোনো দম্পতিকে দেখলে, তাদের অবস্থা জানলে সেটি কিছুটা বোঝা যায়। মুমিন অবশ্য আল্লাহ তাআলার সব ফয়সালায় সন্তুষ্ট! এ কথা তো একটি হাদীসে এমনভাবে এসেছে যে, যতবারই হাদীসটি কোনো মুমিনে স্মরণ হবে, যখনই স্মরণ হবে, সে আল্লাহ তাআলার সামনে আরো বেশি নত হয়ে যাবে (ইনশাআল্লাহ)!

মুমিনের ব্যাপারগুলো (সবই) বিস্ময়কর! কারণ তার প্রতিটি বিষয়ে কল্যাণকর, আর এটি কেবল তারই বৈশিষ্ট্য (যে মুমিন)। যখন কোনো অবস্থায় সে আনন্দিত হয় তখন সে আল্লাহ পাকের শোকর করে। যখন সে কোনো সমস্যায়/বা বিপদে পড়ে তখন সে সবর করে অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার আদেশের ওপর অটল থেকে ধৈর্যধারণ করে। এ অবস্থায়ও তার জন্য রয়েছে কল্যাণ। মুসলিম

তাই এখানে এ বিষয়টি স্মরণ করানো জরুরি মনে করছি যে, কারো এখন সন্তান নেই বা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই, তার জন্য জীবন থেকে হতাশ হওয়া, বা নাউযুবিল্লাহ ‘আল্লাহ আমাকে সন্তান দিলেন না’ এরকম চিন্তা করে অভিযোগ তোলা বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়! আল্লাহ যা-ই করেন তাতে অশেষ কল্যাণ। এটি চিরসত্য। কীসে কার কল্যাণ আল্লাহ তাআলাই জানেন, তাঁর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হওয়া তাই নেক বান্দার পরিচয়।

সন্তান-সন্ততি পরীক্ষাও

দেখুন আল্লাহ তাআলা সূরা তাগাবুনের ১৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন (অর্থ): তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি ফেতনা; আল্লাহ তাআলার কাছে আছে বিশাল পুরস্কার।

যাকেই দুনিয়াতে যা দেওয়া হয়েছে সেটা আসলে তার জন্য পরীক্ষা। কিন্তু আয়াতে কারীমায় বিশেষভাবে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিকে ‘ফেতনা’ বা পরীক্ষা বলা হয়েছে।

সন্তানের জন্য কোন্ কাজটি আমরা অগ্রাধিকার দেব

এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। যাকে আল্লাহ তাআলা সন্তান দান করেছেন, তাকে সন্তান দান করে পরীক্ষায় ফেলেছেন। মাতাপিতা থেকে প্রাপ্য সন্তানের যতগুলো হক বা অধিকার রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল, দ্বীন শিক্ষা ও চারিত্রিক সংশোধন। এ দুটি জিনিস অর্থাৎ সন্তানের তালীম ও তরবিয়ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কেয়ামতের দিন আমাকে সন্তানের অধিকারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। তাই আজ পার্থিব হায়াতে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি: আমার সন্তান যে আজ আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেটার জন্য আমি দায়ী নই তো? যদি আমি তাকে সঠিক শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করে থাকি তাহলে তো ঠিক আছে। কিন্তু এ শিক্ষা বলতে বোঝানো হচ্ছে ঐ শিক্ষা যা কিনা আমার সন্তানকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ এর সঙ্গে পরিচয় করায়। বর্তমানে স্কুল কলেজ ইউনিভারসিটির শিক্ষার যে কারিকুলাম, তাতে যদি সে ব্যবস্থা থাকে তাহলে তো আমার সন্তান সেখান থেকে সেটি পাচ্ছে। কিন্তু এটিও দেখতে হবে যে, এসব প্রতিষ্ঠানেই কি এমন কোনো বিপরীত শিক্ষা পাশাপাশি দিচ্ছে কি না যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ এর সাথে সাংঘর্ষিক? এমন হলে তো বাস্তবে আমার সন্তানকে আখেরাতের জন্য তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি!

নিজেকে প্রশ্ন করে যাচাই করি 

একটু চিন্তা করি: সন্তানকে স্কুল-কলেজে পড়ানোর জন্য যে পরিমাণ পরিকল্পনা, খরচ ও কষ্ট বহন করছি, তাকে ঈমান ও ইসলাম শেখানোর জন্য সেই অনুপাতে আমি কতটুকু সময় ও শ্রম ব্যয় করছি? দৈনিক কি আমি সন্তানের সঙ্গে অন্তত পাঁচ-দশ মিনিট আল্লাহ, তাঁর রাসূলের কথা বলি? আখেরাতের কথা বলি? সন্তানের সঙ্গে আমার খাওয়া হয়, পড়ালেখার কথা হয়, অন্যান্য প্রয়োজনের কথাও আমরা বলে থাকি। এগুলো কতটুকু আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাত-মুখী? একটু পরখ করি যে, তাকে ছোটকাল থেকে আল্লাহর পথে চলার তাগিদ আসলে আমি কতটুকু দিয়েছি।

যারা সৌভাগ্যবান তারা সন্তানকে আখেরাতের সম্বল বানাচ্ছেন মাশাআল্লাহ। নিজ সন্তানকে সাধ্যমতন কুরআন শেখানোর ব্যবস্থা করছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লামের পবিত্র সুন্নতগুলো শেখাচ্ছেন। হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য শেখাচ্ছেন। আলেম ও দ্বীনি বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। কেবল দুনিয়ার ব্যস্ততায় তাদেরকে আল্লাহ বিমুখ করে দিচ্ছেন না উনারা। কারণ এমন অভিভাবকগণ ভাবেন যে, আমি যেকোনো সময় এ দুনিয়া ছাড়ব। হয়ত সন্তান বড় হলে অথবা আগেই। কমপক্ষে আল্লাহকে নারাজ করার পথে সন্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা আমি করতে পারি না। কবরে আমার অবস্থা কী হবে। কেয়ামতের দিন আল্লাহকে কী জবাব দেব?! এ ভয়ে তারা ভীত।

কখন বলতে পারব যে সাধ্য মতন চেষ্টা করেছি

যে সন্তানকে ইসলামের আলোকিত শিক্ষা দান করা হয়, আখেরাতের জীবন সম্পর্কে যাকে সতর্ক করা হয়, আশা করা যায় সে সন্তানের অভিভাবকগণ তাদের দায়িত্বমুক্ত হতে পেরেছেন। সাধ্যমতন চেষ্টার পর ফলাফল অন্য কিছু হলে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে শাস্তি দেবেন না ইনশাআল্লাহ। তবে এতটুকু বলা জরুরি মনে করছি যে, বিজ্ঞ কোনো আলেমে দ্বীন থেকে পরামর্শ নিয়ে, তার শরণাপন্ন হয়ে নির্দেশনা নিয়ে চেষ্টা করতে হবে। নিজ বুদ্ধি ও প্রচেষ্টার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে এ কথা বলা যে, বহু চেষ্টা করেছি, এখন ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। আমার কিছু করার নেই! এমন বলে ফেলা সহজ নয়। আল্লাহ তাআলা কাকে কেমন যোগ্যতা ও শক্তি দিয়েছেন তা তিনি সবচেয়ে ভালো জানেন। আমাদের নিজস্ব চিন্তা ও সিদ্ধান্ত অনেক সময় ভুল হয়। আল্লাহ না করুন, কেবল পরিবারের অন্য সদস্যদের চাপ কিংবা সমাজে মাথা হেট হবে ইত্যাদি অজুহাতে যেন আমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে নারাজ না করি!

নেক সন্তান পার্থিব জীবনেও নেয়ামত, আখেরাতে তো আরো বড় নেয়ামত!  কেবল ‘নাম করা’ একটি স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে তাকে ভর্তি করিয়ে বা পড়িয়ে মানুষ করার প্রবণতা মুসলিম হিসেবে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত হবে। যত কিছুই করি, তাকে আল্লাহর পথ চেনাতে হবে। আখেরাতের চিন্তা চেতনায় বড় করতে হবে। আমার প্রিয় সন্তানের সুন্দর আখলাক বা চরিত্রবান মুসলমান হওয়ার সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। তাহলেই ইনশাআল্লাহ সে আমার জন্য সদকায়ে জারিয়া হবে (আজীবন, মৃত্যুর পরও তার নেক কাজের সাওয়াব আমি পাব)! আর এ লক্ষ্যেই তার শিক্ষা ও চরিত্র উন্নয়নে আমাকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে। ইসলাম সন্তানকে লালন-পালনের শুরু থেকেই, জন্মের সাথে সাথে মাতাপিতার দায়-দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে। এটি কেবল ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামতে এবং সুন্দর একটি নাম রাখায় সীমাবদ্ধ রাখেনি। সন্তান বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তাকে এমন শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত করা জরুরি করেছে যেটি তার আজীবনের আসল পুঁজি হবে। যদি মাতাপিতাগণ নিজেরাই দ্বীনদার-পরহেযগার হন তাহলে তো তাদের ছায়া ও সঙ্গই ঐ সন্তানের জন্য বিরাট নেক আশ্রয়! আর তা না হলে মাতাপিতা গুরুত্ব সহকারে ঘনিষ্ঠ দ্বীনদার মুসলমানগণের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ ও নির্দেশনা নেবে। দ্বীনদার মুসলমানদের মধ্যে মুত্তাকী শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ অগ্রগণ্য। তাদের মাঝে আবার যারা আলেমে-দ্বীন, কুরআন-সুন্নাহ সবচেয়ে ভালো বোঝেন, তারা অগ্রগণ্য।

আজ যে ভুলটি করা হচ্ছে তা হল, শুধু একটি ইসলামিক স্কুল বা ক্যাডেট মাদ্রাসা নাম দেখে আমরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ি! চিন্তাকে প্রশস্ত করা প্রয়োজন। চেষ্টাকে উন্নত করা জরুরি। আল্লাহ তাআলার কাছে সন্তানের দ্বীন ও দুনিয়ার জন্য আন্তরিক দোআ করা খুব জরুরি। আমাদের সাধ্য-সামর্থ্য ও চেষ্টাগুলো আল্লাহ দেখেন! এ কথা বলা যে, একজন ভালো হুজুর রেখেছি, সে আমার বাচ্চাকে আরবী পড়ায় (অর্থাৎ, কায়দা থেকে শুরু করে কুরআন মাজীদ), আমাদের অনেকের কাছে বর্তমানে আত্মতুষ্টির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আল্লাহর কালাম, অর্থাৎ কুরআনকে পড়ানোর ব্যবস্থাকে সবচেয়ে সংকীর্ণ ও সঙ্কুচিত করে বড় খুশি হয়ে বসে আছি! কিভাবে কুরআন পড়লে আমার সন্তান আসলে কুরআনের অনুসারী হবে সে চিন্তা মাথায় নেই। কিন্তু কোথায় ভর্তি করলে সন্তান ভালো ডাকতার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে সেটা মাথায় দিন-রাত ঘুরপাক খাচ্ছে! কোন্ শিক্ষা আমার সন্তানকে গুনাহ থেকে বাঁচাবে দুনিয়া আখেরাতের আযাব-গযব থেকে বাঁচাবে, সে চিন্তা করার সময় মা বা বাবার হয়ত একজনের আছে, কিন্তু আরেকজন তাতে বাঁধা দিচ্ছে। মুসলিম সমাজের করুণ অবস্থা আজ আমাদের সবার চোখের সামনে! অথচ জরুরি, অতীব জরুরি, আমি নিজে নেক ও পবিত্র জীবনযাপন করার চেষ্টা করব, আমার সন্তানকে আমার মুক্তির মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলব। আমার অবর্তমানে যেন সে গুনাহে লিপ্ত হয়ে আমাকে মহা-বিপদে না ফেলে, যে বিপদ দুনিয়ায় শুরু হবে আর আখেরাতে হবে চিরস্থায়ী! আল্লাহর পানাহ।

কিভাবে আখেরাতে মাতাপিতা, অভিভাবক, মুরুব্বীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হবে

আল্লাহ তাআলার কথাগুলো লক্ষ করুন:

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا- وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا- رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا

যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমন্ডল ওলট পালট করা হবে; সেদিন তারা বলবে, হায়। আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রসূলের আনুগত্য করতাম। তারা আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের পালনকর্তা! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিসম্পাত করুন। সুরা আহযাব: ৬৬-৬৮

আজই নিজের পরিণতি চিন্তা করুন। ভাবুন আর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। আমার ও আপনার হায়াত শেষের পথে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।

Last Updated on June 4, 2024 @ 2:20 pm by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it