দোআআখলাক ও আত্মশুদ্ধিতওবা-ইস্তেগফার

সকালে রাতে এতটুকু করতে পারলে জীবনে পরিবর্তন আসবে ইনশাআল্লাহ

এটি মূলত মুফতী তাকী উসমানী সাহেবের বয়ান থেকে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যেখানে রয়েছে সর্বসাধারণ থেকে নিয়ে সব স্তরের মুসলমানগণের জন্য সহজ অথচ খুব উপকারি একটি আমল। আমলটি করলে আমরা অশেষ লাভবান হব ইনশাআল্লাহ! শায়খের কথাগুলো তরজমা করতে গিয়ে ভাবানুবাদ করা হয়েছে। একেবারে হুবুহু কথা বাংলায় লিখতে বা বোঝাতে গিয়ে অর্থের পরিবর্তন ছাড়া সামান্য কথা সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু মূল কথা সব একই রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। 

আসল কথা তো এই যে, আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যা কিছু করছি বা করব সব আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য। আমাদের কাজগুলো আল্লাহ তাআলার জন্য হচ্ছে কিনা — চিন্তা করা উচিত, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই কাজ করা উচিত। প্রত্যেকের এ কথা ভাবা দরকার: যে কথা আমি মুখ দিয়ে বের করছি তা কি আমাকে জান্নাতের দিকে নিচ্ছে নাকি জাহান্নামের দিকে নিচ্ছে। সাধ্যমতন এটি চিন্তা করে কাজ করা উচিত।

একজন আল্লাহওয়ালার একটি আমল আমি আপনাদের বলছি, আল্লাহ তাআলা আমাকেও এর ওপর আমল করার তাওফীক দিন, আপনাদেরকেও দান করুন (আমীন)। এ আমলটি আমাদের জীবনের সময়গুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সহজ এক পদ্ধতি। এত সহজ যে মানুষ বলবে, আরে এ তো খুবই সহজ! কিন্তু যখন আমলের সময় আসবে তখন শয়তান বলবে, চল কাল থেকে আমলটি করব। আবার আগামীকাল সে বলবে, আগামীকাল থেকে..। এভাবে (ঐ আগামীকাল আর আসবে না যেদিন আমলটি করা হবে, অর্থাৎ) সারা জীবন আর আমলের তাওফীক হবে না!

কিন্তু যদি অন্তরে মৃত্যুর চিন্তা কিছু পরিমাণও থাকে, আর কবরের অবস্থা ও আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়ানোর কিছুমাত্র চিন্তা থাকে, তাহলে ভাই কম-সে-কম এতটুকু করে দেখুন! আমাদের জীবন আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অনুযায়ী অতিবাহিত হবে ইনশাআল্লাহ।

সকাল বেলা পাঁচ মিনিট আর রাতের বেলা পাঁচ মিনিট আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

সকালের মুরাকাবা (গভীর চিন্তা, ধ্যান) ও প্রচেষ্টা

সকালে পাঁচ মিনিট ফজরের পর কিছুক্ষণ এ অনুভূতি জাগ্রত করুন যে, আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে আমি আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কিছু কথা বলছি।

তারপর এভাবে বলুন: হে আল্লাহ! আজকের দিনটি শুরু হচ্ছে। জানি না পুরো দিনটি আমি পাব নাকি পাব না। এটাও জানি না যে এরপর কোনো দিন আর পাব কি পাব না। হে আল্লাহ! আমি দিনের শুরুতে এই ইচ্ছা করছি, পাকাপোক্ত-দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করছি আর আপনার দরবারে এই প্রতিশ্রুতি করছি, আজ আমি আপনার সন্তুষ্টি অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করব। আজ প্রতিটি কাজ আপনার সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যেই করব। যখন কিছু খাব সুন্নত পন্থায় খেয়ে সেটিকে ইবাদত বানাব, বাসার মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত ও কথাবার্তা সব আপনার সন্তুষ্টির জন্য করব। তাদের সঙ্গে আনন্দ করব আপনারই জন্য, আপনি এ কাজের আদেশ-অনুমতি দান করেছেন বলেই করব। এভাবে যে কাজই আজ আমি করব, আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই করব। (পুরুষ হলে) পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে পড়ব। সবরকম গুনাহ থেকে বাঁচব। মিথ্যা বলব না, গীবত করব না, কারুর বিরুদ্ধে অপবাদ দিব না, কাউকে কষ্ট দিব না, কোনো না জায়েয পদ্ধতিতে আয় করব না, ঘুষ নেব না, সুদ নেব না। হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে এ প্রতিশ্রুতি করছি। আর মুখ দিয়ে এ কথাও বলুন:

 إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

অর্থ: আমার নামায, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।

‘জীবন আপনার জন্য’ অর্থ কী(?): (এর অর্থ হল) হে আল্লাহ, জীবনে যত কাজ আছে সব কেবল তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই।

এ প্রতিশ্রুতি করার পর দোআ করুন: হে আল্লাহ! আপনার ফযল ও করমে আমি এই প্রতিশ্রুতি করেছি যে, আজকের দিনটি আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্যই অতিবাহিত করব। আপনার আদেশ-নিষেধ মেনে চলব। কোনো গুনাহ করব না। কিন্তু হে আল্লাহ! এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আমি দুর্বল হয়ে না যাই! আমি এ প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারব না যতক্ষণ তোমার তাওফীক না হবে। আমি এ প্রতিশ্রুতি করার পাশাপাশি চেষ্টাও করব। সঙ্গে আমি তোমার কাছে সাহায্য চাচ্ছি তুমি আমাকে এ চেষ্টায় সফল কর।

দেখুন সূরা ফাতিহার মাঝে কী দোআ শেখানো হয়েছে:

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

অর্থ: আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমার কাছেই সাহায্য চাই।

তোমারই ইবাদত করব, (মানে) তোমার ইচ্ছার বিপরীত কিছু করব না। তোমার আদেশই শিরোধার্য, সব তোমার পথে করব।

(এভাবে দোআ করব, কারণ) তোমার ইবাদত আমার দ্বারা হয়ে উঠবে না। আমি তোমার ইবাদত ততক্ষণ পর্যন্ত করতে পারব না যতক্ষণ তোমার সাহায্য আমার সহায় না হয়! এজন্যই إِيَّاكَ نَعْبُدُ এর সঙ্গে আল্লাহ তাআলা إِيَّاكَ نَسْتَعِينُ লাগিয়ে দিয়েছেন।

অতএব বোঝা গেল, তোমারই ইবাদত করি — অনেক বড় কথা, অনেক বড় একটি সাক্ষ্য! এটি তো তোমার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। তাই এ সাক্ষ্যের সঙ্গে দোআ শেখানো হয়েছে: তোমার কাছেই সাহায্য চাই। কেমন যেন আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিলেন যে, সাক্ষ্য ও প্রতিশ্রুতি তো বান্দা তুমি করে ফেলবে, কিন্তু আমার কাছে সাহায্য না চাওয়া পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয় না।

তারপর যে সাহায্য-মদদ চাওয়া হল, সেটির লক্ষ্য ব্যক্ত করা হচ্ছে (তাই এটি স্মরণ করে আমরাও আল্লাহ তাআলার কাছে দোআ করি):

   اهدِنَــــا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ

অর্থ: আমাদেরকে হেদায়েতের পথে রাখ।

আর এভাবে সীরাতুল মুস্তাকীম বা হেদায়েতের পথ স্পষ্ট করা হচ্ছে (সঙ্গে এভাবেই দোআ করা উচিত):

صِرَاطَ الَّذِينَ أَنعَمتَ عَلَيهِمْ غَيرِ المَغضُوبِ عَلَيهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ

 

অর্থ: তাদের পথে রাখ যাদের তুমি পুরষ্কৃত করেছ, তাদের পথে নয় যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট।

(অতএব কেমন যেন আল্লাহ বলছেন, বান্দা!) তুমি নিয়ত (ইচ্ছা করা), আযম (সুদৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করা) ও আহদ (প্রতিশ্রুতি) কর, কিন্তু সঙ্গে অবশ্যই আমার সাহায্যও চেয়ে নাও।

এভাবে প্রতিদিন সকালে, ফজরের পর আমরা আল্লাহ তাআলার দরবারে তাঁর সঙ্গে কিছু সময় কথা বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হব, তাঁর কাছে নেক পথে চলার, গুনাহ থেকে বাঁচার তাওফীক-সাহায্য চাব; নিজেকে আল্লাহ তাআলার সোপর্দ করে দিয়ে দিন শুরু করব ইনশাআল্লাহ।

রাতের মুরাকাবা (গভীর চিন্তা, ধ্যান) ও প্রচেষ্টা

সারাদিন অতিবাহিত করার যখন রাতে ঘুমের উদ্দেশ্যে শুয়ে পড়বেন তখন আবার পাঁচ মিনিট আল্লাহ তাআলার দরবারে নিজেকে পেশ করবেন। প্রথমে চিন্তা করবেন: আমি সকালে আল্লাহ তাআলার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম।

স্মরণ করবেন দিনের বেলা কী কাজ করেছেন। এমন হয়ে যেতে পারে যে বিগত দিনে, আমি কারো গীবত করেছি, কারো হক নষ্ট করেছি, কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, নাজায়েয আয়-আমদানী করেছি।

সকালে  তো আমি আল্লাহ পাকের কাছে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হয়েছিলাম, আমার ইবাদত, জীবন মরণ সবই আল্লাহর জন্য। আমি কতটুকু এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছি। কোথায় আমি আল্লাহর রহমতে কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করেছি আর কোথায় আমার পক্ষ থেকে ভুল-ত্রুটি-গুনাহ হয়ে গেছে(?) নিজের মন-নফস আর শয়তানের পাল্লায় পড়ে কী কী না করে ফেলেছি আমি! এসব মনে করে আল্লাহকে বলতে হবে:

হে আল্লাহ! তুমিই বলেছ যে, আমার পক্ষ থেকে যদি তোমার নাফরমানি হয়ে যায়, আমি তৎক্ষণাৎ যেন তোমার দিকে মনোযোগী হয়ে তওবা-ইস্তেগফার করে নেই। আমি আজ যা ভুল-ত্রুটি-গুনাহ করে ফেলেছি তার জন্য (সর্বপ্রথম) তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, খাঁটি তওবা করছি (সত্য অন্তরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাব ও গুনাহ না করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হব)। তওবা অর্থ আমি লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চেয়ে তোমার কাছে ফিরে এসেছি আর যখন নতুন একটি দিন শুরু করব আমার প্রতিশ্রুতি আমি নবায়ন করব, আবার তোমার হুকুম মানার পূর্ণ চেষ্টা করব। সঙ্গে তোমার সাহায্য চাব, তাওফীক চাব (যে তওবার বাক্য কুরআন হাদীসে বর্ণিত আছে তা পড়লে সবচেয়ে উত্তম, যদিও এটি জরুরি নয়)।*

যদি ঐ রাতে মৃত্যু চলে আসে, ইনশাআল্লাহ মাগফেরাত অর্থাৎ ক্ষমাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন!

শেষ কথা

আর যদি নতুন একটি দিন পেয়ে যান তাহলে ইনশাআল্লাহ ঐ কাজই করবেন যা পূর্বের দিন করেছেন। আর রাতে ঐ কাজই করবেন যা গত রাতে করেছেন।

————————————————————————————–

*এখানে একটি কথা উল্লেখ করা অনুবাদক জরুরি মনে করছে (যে কথা মুফতী তাকী সাহেবের অন্য কোনো লেকচার/বয়ানেও আছে))। বান্দার উপর জুলুমকারী যেন মজলুম (যার ওপর জুলুম করা হয়েছে)-এর কাছে ক্ষমা চাওয়ার বা তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পূর্ণ নিয়্যত রাখে। না হলে সেটা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে, সঙ্গে ঐ বান্দার কাছ থেকেও ক্ষমা চাইতে হবে যাকে কোনোভাবে আমি কষ্ট দিয়েছি।

Last Updated on October 15, 2024 @ 4:07 pm by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *