আখলাক ও আত্মশুদ্ধিচিন্তার খোরাক​

যেসব গুনাহে অনেক ‘বাহ্যত নেক সুরত’ মানুষও লিপ্ত: অতি সতর্কতা ও সত্ত্বর তওবা প্রয়োজন

ওহে নিজ বন্ধু, প্রতিবেশি ও আত্মীয় মহলে ‘হাসান বসরী’ আর ‘জুনায়েদ বাগদাদী’র মতন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি! দেখতো নিজের মধ্যে নিচের কোনো একটিও দোষ খুঁজে পাও নাকি?! পেলে অতি সত্ত্বর তওবা করে নিও..

মা-বাবার সঙ্গে অসদাচরণ: অনেকে আমরা বাইরে, অফিস-আদালতে ও দোকানপাটে ভেজা বিড়াল। বন্ধু মহলে তো কথাই নেই! কিন্তু মা-বাবার সামনে? দেখা যাচ্ছে মা-বাবার সঙ্গে যথেচ্ছ ব্যবহার করছি অনেকে আমরা। খুব বড় গুনাহের মধ্যে মা-বাবার সঙ্গে অসদাচরণ অন্যতম। এটি তো এমন গুনাহ যার শাস্তি দুনিয়াতেই ভোগ করতে হবে। মা-বাবা জীবিত থাকতে অনেকেই এ নেয়ামতের কদর করে না।

অধীনস্থদের সঙ্গে অসদাচরণ: অধীনস্থমাত্রই দুর্বল। দুর্বলকে বাগে পেয়ে কী করছি? খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে আমাদের কাছে এহেন আচরণের ব্যাখ্যা আছে, উপরওয়ালার সামনে যথার্থ জবাব দিতে পারব কিনা ভেবে দেখতে হবে। না হলে জুলুম-অত্যাচার করে জালেম হয়ে মরতে হবে। নামায, রোযা, যিকির, তেলাওয়াতে করে পার পাওয়া যাবে না। ভয়ে অধীনস্থরা আজ চুপ করে আছে। কেয়ামতের দিন অধীনস্থরা সবাই আমাদেরকে ঘিরে ধরবে। কী হবে উপায়? ভাবুন। তওবা করুন। তাদের হক ফিরিয়ে দিন। তাদের সঙ্গে নরম-কোমল-সদাচরণ করুন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, কাজের মানুষ (বাড়ির বা বাইরের), পিয়ন-চাপরাশি-দারোয়ান — এভাবে যত অধীনস্থ আছে সবার প্রতি যথার্থ আচরণ করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য জিম্মাদার বা নেতা নিযুক্ত করে আমাকে পরীক্ষায় ফেলেছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে সদাচরণ তো বটেই, তাদের হক ঠিকঠাক আদায়ে তৎপর হতে হবে।

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকরণ: আরেকটি বড় গুনাহ। সব নেক আমল অগ্রাহ্য হয়ে যাওয়ার আশংকা আছে যদি এ বন্ধন ছিন্ন করা হয়। আমরা তো অনেকেই বন্ধু-বান্ধব আর সহকর্মীদের খুশি করতে ব্যস্ত। এমন কি অনেক দ্বীনি ভাই-ব্রাদারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গভীর। কিন্তু আত্মীয়তার বন্ধ ছিন্ন করে বসে আছি। ধনী হোক বা গরীব, যেমনই হোক সে, আমার আত্মীয়র প্রতি শ্রদ্ধাশীল, স্নেহশীল হওয়া ও তার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখা জরুরি। এটি কুরআন ও সুন্নাহর সুমহান শিক্ষা। এর বিপরীত করলে কঠিন গুনাহ। আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা। হায়াতের বরকত পর্যন্ত আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখার মধ্যে।

রাগ-গোস্বা: “আমি তো অহেতুক রাগ করি না!” আমাদের নফস কি এমনটাই বলে না? আমাদের সর্বসাধারণের রাগ-গোস্বার অধিকাংশই ক্ষতিকর। এই রাগ-গোস্বার ফলে জবান থেকে কত অযাচিত কথা বের হয়। কত ধরণের মিথ্যা, যুলুম, গীবত আর অপবাদ উচ্চারিত হয়। খুব বেশি সাবধানতা প্রয়োজন।

মিথ্যা কথা: বর্তমানে মিথ্যা কথা বলাকে গুনাহই ধরা হয় না। যা যখন যাকে যেভাবে বোঝানো যায়। আল্লাহর পানাহ। অতিসত্বর তওবা জরুরি। জঘন্য গুনাহসমূহের একটি; মুনাফিকের অন্যতম লক্ষণ। সত্য মুক্তি দেয়; মিথ্যা ধ্বংস ও বরবাদ করে। এক মিথ্যা হাজার মিথ্যার দোআর খুলে। মিথ্যা বলা, সত্য গোপন করা, ছল-চাতুরি করা, ধোঁকাবাজি, মাপে কম দেওয়া সবই অসত্য, সবই মিথ্যা। চিন্তা, কথা ও কাজে সত্যবাদী হতে হবে। আচরণে স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

গীবত: আহা, কেউ আমার বিরুদ্ধে কথা বললে তো আমি ক্ষিপ্ত, কিন্তু আমি যে…! দোষচর্চা, পরচর্চা, পরনিন্দা ছাড়া মজলিস কয়টি হচ্ছে? কারো নাম আসলেই সতর্ক হয়ে যেতে হবে। বহাল তবিয়তে ‘যেনা-ব্যভিচারের থেকেও মারত্মক’ এই পাপে লিপ্ত থাকছি; পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে — ভেবে দেখবার বিষয়। কুরআন মাজীদে যে গুনাহকে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ বলা হয়েছে, সেই করতে লোম শিউরে যাওয়া উচিত। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক যত অশান্তি তার অন্যতম কারণ হল এই গীবত।

লেনদেনে হারাম ও খারাবি: আমাদের সব লেনদেন কি ঠিকঠাক? কোনো সমস্যা নেই?! কারো সম্পদ মেরে খাইনি? কারো হক নষ্ট করিনি? কারো টাকা-পয়সা বেহাত করিনি? হুশিয়ার! এ হল আরেকটি মারাত্মক গুনাহ যাকে আমরা গুনাহ মনে করছি না। ইবাদত ও দোআ বরবাদ হয়ে করে দেওয়ার জন্য এ গুনাহ একাই যথেষ্ট! আল্লাহর পানাহ। সুদ, ঘুষ, আত্মসাৎ, পরের অর্থ, সম্পদ, মাল কুক্ষিত করা, ঋণ নিয়ে পরিশোধের নিয়ত না করা/যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া/টাল বাহানা করা অতি মন্দ কাজ; এগুলির পরিণতি অতি মন্দ।

অপাত্রে দৃষ্টি দান: চোখের লুকোচুরিও আল্লাহ তাআলা দেখেন। কোন নিয়তে কী দেখি, গোপনে কোথায় আমাদের দৃষ্টি থাকে — জানেন তিনি। মনে হয় যেন ছোট গুনাহ। ঈমানের মতন অমূল্য সম্পদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এই কুঅভ্যাসে। মোবাইল, ইন্টারনেটের কারণে এই গুনাহ মহামারির আকার ধারণ করেছে। অনেকে কত ছবি আর ভিডিও যে দেখে আর শেয়ার করে, কোনো হিসাব-নিকাশই করছে না কী দেখাচ্ছে, কী দেখছি আর (শেয়ারের মাধ্যমে) কী দেখাচ্ছি অন্যদেরকে।

বিদ্বেষ: অন্যের ভালো, ভালো লাগে না, অন্যের ভালো দেখলে অন্তর্জ্বালায় মন বিষিয়ে গেলে যা হয় — হিংসা বিদ্বেষে মন-দিল ভরে যায়। বিদ্বেষ আরেক বড় দোষ ও গুনাহ। এটি অনেক গুনাহর শিকড় ও ঈমান বিধ্বংসী। হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বাঁচতে হবে।

অহংকার: হামবড়া ভাব, অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং সর্বোপরি সত্যকে প্রত্যাখান করা। ইবলিসের মরদুদ হওয়ার কারণ। আল্লাহ তাআলার চাদর! এ নিয়ে টানাটানি!? আমরা যেন নিজেকে নিবৃত্ত রাখি এত বড় স্পর্ধা থেকে! নিজের পরিণতি চিন্তা করতে হবে। আমি, আমি, আমি — এই আমিত্ব মেটাতে হবে! এটা ফেরাউনি কথা। আমি অমুক, আমি সম্মানিত, আমার বংশ এই-সেই, আমাকে চেন?! — এইসব জঘন্য মানসিকতা ঝেটিয়ে বের করতে হবে।

কৃপণতা: বখিলী। আল্লাহ বলছেন দিতে, ছাড়তে আর আমরা ধরে রাখছি, দিচ্ছি না। কুক্ষিত করার কু-অভ্যাস আমাদেরকে জালেম বানাচ্ছে। অর্থ-সম্পদ, নেয়ামত — এগুলোর মালিক কি আমরা? প্রত্যেকে ভাবি। আমরা বলি কবরে নিতে পারব না। আরে ভাই, তার আগেই তো হাতছাড়া হবে। এগুলোর মালিক আল্লাহ। তাঁর আদেশমতন যাকাত, দান-অনুদান করতেই হবে! এখানে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই।

দুনিয়ার লালসা: সব গুনাহের মূল। শুধু এই চাই, ঐ চাই। সবই প্রয়োজন। সবই জীবনে জরুরি। এই চক্করে পড়ে আসল কাজ বাদ। নামায-রোযায় ঢিলেমি, আলসেমি। হারামে লিপ্ত। জুলুমে লিপ্ত। মিথ্যা কথায় লিপ্ত। বলতে গেলে, দুনিয়ার লোভ-লালসা সবরকম গুনাহর দরজা খুলে দিচ্ছে।

আসুন ভাই-বোনেরা। জীবনকে এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। সচেতন হয়ে যাই। তওবা-ইস্তেগফারে লেগে যাই। সংশোধনের জীবন গড়ার জন্য পাকা-পোক্ত মানসিকতা তৈরি করি। জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য যা করা লাগে করি। মৃত্যু আসছে। আল্লাহ তাআলার সম্মুখে হাজিরা দেওয়ার সময়টি আসছে।

হে আল্লাহ! সাহায্য কর। বাঁচাও। আমীন।

Last Updated on September 26, 2023 @ 10:18 am by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it