উপলক্ষ ও সংস্কৃতিহজ্ব ও উমরাহকুরবানী

মহব্বতের আমল: হজ্ব ও কুরবানী | সতর্কতা প্রয়োজন

বায়তুল্লাহর পানে এখন ছুটে চলছে কত মানুষ। লাখ লাখ মুসলমান। হ্যাঁ – বায়তুল্লাহ – আল্লাহ তাআলার ঘর। আল্লাহ তাআলার বান্দারা যাচ্ছে তাঁর ঘরের দিকে।

হজ্ব। একটি উঁচু পর্যায়ের ইবাদত। এ ইবাদতটি ভিন্ন রকমের। ইশক আর মহব্বতের ইবাদত। দুনিয়ার হায়াতে আল্লাহ তাআলার দরবারে উপস্থিতির এক আজীব ব্যবস্থা। কে করলেন? স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন! তিনিই মেজবান। তাঁর বান্দারা মেহমান। আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দারা কোনো আইনী বাঁধনে নয়, আল্লাহ পাকের মহব্বতে সেখানে ছুটে যায়। মাহবুবের ঘর দেখে তাদের চোখ ও মন-দিল জুড়িয়ে যায়। আখেরাতের আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়। আল্লাহ তাআলার সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। আরাফায় অবস্থান, সাফা-মারওয়ায় দৌঁড়ানো, মীনাতে শয়তানকে পাথর মারা – সবই কেমন যেন শোনায়। কিন্তু যে আল্লাহ তাআলাকে পেতে চায়, পেতে চায় তাঁর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি – সে মন-দিল উজাড় করেই হজ্বের পবিত্র সফর করে থাকে। মক্কা-মদীনার স্মৃতি তাকে সারাজীবন হাসায় আর কাঁদায়। কাবা ঘর, রাসূলে কারীম ﷺ-এর পবিত্র রওযা শরীফ, মাকামে ইব্রাহীম, উহুদের ময়দান, আবে যম-যম, জান্নাতুল মুয়াল্লাহ, জান্নাতুল বাকী – এগুলো ছেড়ে চলে আসা কি চারটি-খানি কথা? আরে কে বলে বান্দা এগুলো ছেড়ে এসেছে? এসবইত বান্দার হৃদয়ের আসনে বহু সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আল্লাহ তাআলার ও তাঁর রাসূলের মহব্বত।

আল্লাহ তাআলা হযরত ইব্রাহীম َلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর কুরবানীকে, অর্থাৎ আত্মত্যাগকে ভালবেসেছেন। এত ভালবেসেছেন যে, তার দোআর ও ত্যাগের বরকত দেখাচ্ছেন শ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ ﷺ-এর শ্রেষ্ঠ উম্মতকে। কেয়ামত পর্যন্ত শেষ উম্মত এই বরকত অনুভব করতে থাকবে। আত্মত্যাগের এত মূল্য আল্লাহ তাআলার কাছে। আর ইব্রাহীম َلَيْهِ ٱلسَّلَامُ একাই আল্লাহ তাআলার পথে আত্মত্যাগকারী নন, উনার বিবি ও সন্তানও আল্লাহ তাআলার পথে জীবন উৎসর্গকারী। সেই ইব্রাহীম َلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর উত্তরসূরী ও দোআর ফলাফল শ্রেষ্ঠ নবী রাসূলে কারীম ﷺ ও তার উম্মত।

আল্লাহ তাআলার পথে রাসূলে কারীম ﷺ ও তার সাহাবাগণ رضي الله عنهم -এর কুরবানী অবর্ণনীয় – অপরিসীম। আজো প্রত্যেক হাজী সাহেব সে উপলব্ধির বিস্ময়কর সুযোগ পান মক্কা-মদীনা-মীনার প্রান্তরে। আর ঈমানদীপ্ত যে কেউ বুঝতে পারে মহব্বত ও ইশক-এর দাবি কী। যদি আনুষ্ঠানিকতা, সম্মেলন, একত্রিত হওয়া – এগুলোই উদ্দেশ্য হত, তাহলে হজ্ব -এর কি দরকার? বাস্তবিকই, ইসলাম কোনো রেওয়াজ বা রসমকে প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম শেখায় কিভাবে বান্দা আল্লাহ পাকের ডাকে তাঁর বাতলে দেয়া নিয়মানুযায়ী সাড়া দিবে। আল্লাহ তাআলার হুকুমের সামনে নতি স্বীকার করাই একজন মুসলমানের জন্য সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আল্লাহ তাআলার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে মন মত কাজ করা যায় না। আল্লাহ তাআলার, যিনি আসমান-যমীন এবং সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা – তার দরবারের কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। সেগুলিকে মাথা পেতে নেয়া অতি জরুরি।

একজন মুসলমান মাত্রই কোনো আমল বা ইবাদতকে মন মত করার দুঃসাহস করতে পারে না। আল্লাহ পাকের কাছে আত্মসমর্পণই যে তাকে মুসলমান বানিয়েছে এটা তার জানা আছে। যেমন সে জানে যে, মালিকের কোনো হুকুম পালন না করা এক মহাবিপদ, তেমন সে এও জানে যে, মালিকের হুকুম মন মত পালন করা বৃথা। স্বজ্ঞানে যে কিনা কোনো ইবাদত মন মত করে নেয়, আশঙ্কা আছে, তার সব শ্রম বেকার ও পন্ড হয়ে গেল। মানুষের মন (নফস) এবং শয়তানের চাহিদা হল মন মত কাজ করার। শয়তান যখন দেখে আমল থেকে মানুষকে বিরত রাখা যাচ্ছে না, তখন সে এই পথ অবলম্বন করে। ঠিক আছে, আমল বান্দা করুক। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবে যেন না করে সেই কুমন্ত্রণা সে অন্তরে ঢেলে দেয়। সেজন্যই তো দেখা যায় ইবাদতে মানুষ লেগে যায়, কিন্তু তারপর ইবাদত করে মন মত। এটা দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক। এ থেকে বিরত থাকতে হলে নিয়তের পরিশুদ্ধতাও লাগবে ও নিজেকে সত্যের কাছে নতও করতে হবে। আমি সুন্নাহ পদ্ধতি জানব ও সেই অনুযায়ীই আমল করব।

হজ্ব -এর মত এত বড় এক ফরয আমল যদি আমরা মন মত পালন করি তাহলে ক্ষতিটা যে কত ব্যাপক হবে তা বলাই বাহুল্য। কাবার চারদিকে ঘুড়ে আল্লাহ তাআলার কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছি আর শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে যে প্রমাণ করতে চেয়েছি যে, আমি শুধু এক আল্লাহ তাআলার গোলাম – তারই গোলামি করি, শয়তানের পথে চলার বা তার আহ্বানে আমি কখনই সাড়া দেব না। মন মত হজ্ব-এর আহকাম  (হুকুমগুলো) পালন করে বাস্তবে এর কী প্রতিফলন ঘটবে? যদি আমি নেক আমল কবুলের বাহ্যিক শর্তগুলোই পূরণ না করি, তাহলে কি আসলে লাভের আশা করা যায়?! আজ দেখা যায় এত পবিত্র সফরে গিয়ে মানুষ ছবি তোলে, এবং এমন বহু অহেতুক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। এটা কত আফসোসের বিষয়।

এও দেখা যাচ্ছে, সামর্থ্য আছে, শক্তিও আছে – আমি এখনো হজ্ব করছি না, ঠিক মত নিয়তও করিনি। বিভিন্ন টাল-বাহানা-ওজর। এ কত বড় লজ্জা এবং পরিতাপের বিষয়। সর্বপরি ভয়ের ব্যাপার। এ অবস্থায় মৃত্যু হয়ে গেলে আল্লাহ তাআলার কাছে কী জবাব দিব? এবারও গেলাম না, গাফলতি করলাম। আল্লাহ তাআলার কাছে বিশেষভাবে ক্ষমা চেয়ে, সামনের বার যাব, দৃঢ় নিয়ত করে দোআ করতে শুরু করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করুন ও সবাইকে কবুল করুন। আমীন।

তারপর ইনশাআল্লাহ আমরা যে কুরবানী করব, এ বিষয়টি লক্ষ করি। নিয়ত থেকে নিয়ে গোশত খাওয়া পর্যন্ত – কুরবানীর উদ্দেশ্য, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিয়ম-নীতি যা আছে, কমপক্ষে মৌলিক যে বিষয়গুলি রয়েছে, সেগুলি উপেক্ষা করে কুরবানী করলে কি তা আল্লাহ পাকের কাছে কবুলের আশা করা যায়?

এ বিষয়গুলো উলামা-মাশায়েখগণ বারবার সতর্ক করছেন আমাদের। প্রত্যেকেরই উচিত ভ্রুক্ষেপ করা, নতুবা ক্ষতি আমাদের নিজেদেরই।

Last Updated on August 15, 2022 @ 11:20 am by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it