সাইয়্যেদুনা হযরত মুহাম্মদ ﷺ
সাইয়্যেদিনা হযরত মুহাম্মাদ ﷺ
(পরলোকগমন: ১১ হিজরী ॥ ৬৩৩ খৃস্টাব্দ)
হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাটি ও পানির মাঝে জন্ম-এর প্রক্রিয়ায় তখনও তিনি নবী। (প্রিয় পাঠক!) তুমি যদি কোন দিন উৎসবে মেতে উঠতে চাও তবে তা যেন হয় নবীজীর কোন আনন্দ-এর দিনে। তাঁর জীবনচরিত লিখে লিখে কলম শুকিয়ে গেছে। কলম-এর যত কীর্তি তাঁর সীরাত-ই স-এরা। তারপরও সত্য-এর নিক্তি-সাগরে এক ফোঁটাও মেশাতে পারেনি এই কলম। প্রশংসা করে ইতিহাস ধন্য করেনি মহানবীকে; বরং নবীজীর আলোচনায় খোদ ইতিহাস ধন্য হয়েছে, শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছে।
পদচারীদ-এর স-এরা, তাবৎ জাতির প্র-এরিত রাসূল-এর শ্রেষ্ঠ, ন্যায় ও ইনসাফ-এর অনুপম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনকারী। হাতে তাসবিহ’র দানা যিকিরে মশগুল, উপল-বৃক্ষ সালাম দিতে অবনত, উট-ক্রমেলক অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে উপস্থিত, খেজুর ডাল যাঁর বিরহে কেঁদে কেঁদে হয় সারা, আঙ্গুল-এর ফাঁক দিয়ে প্রবহমান নির্ঝরণী, নেকড়ে সাক্ষ্য দেয় রেসালত-এর, যাঁর বরকত-এর প্রাচুর্য দেখা দেয় খাদ্যসম্ভারে, বিষমাখা বকরির সামন-এর পায়া কথা বলে অনায়াসে, মেঘমালা ছায়া দেয় যাঁকে এবং পাখপাখালি কথা কয় তাঁর সনে।
মনোনীতদ-এর স-এরা ও দীনবন্ধু। আল্লাহ যাঁর হৃদয়কে উন্মোচিত করেছেন। তাঁর আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন। যাঁর মর্যাদা উতুঙ্গ করেছেন। অসহায় মানুষ-এর গালগল্প-এর আসর-এর সাথী। ইমামুল মুরসালীন। মানুষ-এর মাঝে শ্রেষ্ঠ দানশীল ও উদার। কথায় সত্যবাদী। হঠাৎ দেখে যে কেউ অবনমিত হবে। মেলামেশা ও ওঠাবসা করলে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে। সদাশয়, কোমল আচরণশীল। হৈচৈ-শোরগোল যাঁর ধাতে নেই। কঠোর নয়। অতিশয় সুন্দর ও নরম মেজাজ-এর মানুষ। মোলায়েম ও পেলব আচার-আচরণ যাঁর। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও হাসিমুখ। কোন কিছুকে নিন্দা করে না। কাউকে দোষারোপ করে না। সদ্ব্যবহার তাঁর শ্লোগান, তাকওয়া যাঁর বিবেক এবং নবুওয়াত-এর মোহরাঙ্কন তাঁরই দু’কাঁধ-এর মাঝে।
আল্লাহ তাআলা যাঁকে সকল নবীদ-এর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তাই তো তাঁকে প্র-এরণ করেছেন শ্রেষ্ঠ দল ও গোষ্ঠীর অন্তর্গত করে। তাঁর গোত্র স-এরা, তাঁর বংশ স-এরা। মানুষ-এর মাঝে তিনি অনুপম ও অদ্বিতীয়। তাঁকে তিনি প্র-এরণ করেছেন গোটা মানব জাতির নিকট। সৃষ্টিকুল-এর তিনি রাসূল। তাঁকে দিলেন শ্রেষ্ঠ স্বল্পশব্দ-এর অর্থবহুল কথার মালা। সামান্য শব্দ-এর মাঝে নিগূঢ় তথ্যসমৃদ্ধ অর্থ। যাঁর জন্য হালাল হল গনীমত-এর সম্পদ। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হালাল হওয়া তাঁরই কৃতিত্ব। গোটা পৃথিবীর মাটি মসজিদ। যে কোন মাটি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করার মহাসুযোগ তাঁরই মাধ্যমে উম্মত-এর হস্তগত হয়। এক মাস-এর দূরত্বে শত্রুবাহিনীকে অজানা আতঙ্কে রেখে তাঁকে সাহায্য করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর উম্মত-এর নামায-এর সারিকে ফ-এরেস্তাদ-এর সারির ন্যায় মর্যাদাবান করেছেন। আল্লাহ তাআলার কালাম তাঁর জন্য মোজেযা-লোকাতীত বিষয়। তাঁর রিযেক-এর ফয়সালা রেখেছেন বর্শার নিচে। যে তাঁর বিরোধিতা করবে তার জন্য রেখেছেন অপমান-অপদস্ততা। ভূ-গর্ভস্থ যাবতীয় সম্পদ তাঁর করতলগত। তিনি তাঁকে দিয়েছেন সাত আয়াতবিশিষ্ট ‘সূরাতুল ফাতিহা’। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন নবী-রাসূলদ-এর আগমন-এর ধারাবাহিকতা। তিনি সকল নবী ও রাসূলদ-এর পরিপূর্ণতা।
কেয়ামত দিবসে তিনি বনী আদম-এর প্রধান ব্যক্তি। হাশর-এর মাঠে মাটি ভেদ করে তিনিই সর্বপ্রথম ওঠবেন। তিনি প্রথম সুপারিশকারী। তাঁর শাফায়াত প্রথম গৃহীত হবে। জান্নাত-এর কড়া তিনিই প্রথমে নাড়বেন। আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক প্রিয় মানুষ। হাশর-এর মাঠ-এর জনসমুদ্রে তাঁর হাতে থাকবে প্রশংসার নিশান। তিনি নিশানবরদার। তাঁর পতাকাতলে সকল নবী ও রাসূলদ-এর আশ্রয় ও ঠাঁই। দলে দলে লোকজন-এর তিনি প্রতিনিধিপ্রধান। হতাশায় কবলিত গণমানুষ-এর তিনিই আশা জাগানিয়া। তাঁর অনুসারীদ-এর মিছিল সর্বাধিক দীর্ঘ। তিনি শাফায়াত-এর প্রতিভূ। তিনি অসিলার মালিক। তিনি থাকবেন মহান আরশ-এর ডান পার্শ্বে।
তোমরা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, কেমন ছিল তাঁর নামায? বলবো, নামায পড়তে পড়তে তাঁর কদম মোবারক ফুলে যেতো। কেমন ছিল তাঁর দুনিয়া বিমুখিতা? তিনি ছিলেন অতুলনীয় দুনিয়াবিমুখ। কেমন ছিল তাঁর দানশীলতা? তিনি দু’হাতে দান করতেন, ছিলেন বড় দানশীল। কেমন ছিল তাঁর আখলাক ও চরিত্র? ছিলেন অসাধারণ চরিত্রবান। কেমন ছিল তাঁর বংশ? তিনি ছিলেন কুলীন। কেমন ছিল তাঁর ঘামস্বেদ? কস্তূরি ও সুরভিত মেস্ক। কেমন ছিল তাঁর মুখম-ল? উদ্ভাসিত একটি চাঁদ। কেমন ছিল তাঁর দু’চোখ ? কালো রঙ-এর কাজল মাখা যুগল চোখ। কেশরাশি কেমন? পেলব-কোমল-মসৃণ সিল্ক। পদযুগল কেমন ছিল? দীর্ঘ রজনী দাঁড়িয়ে থাকা পায়-এর কাহিনী সর্বজনবিদিত। কথা কেমন? মুক্তাঝরা আলোময় মুখনিঃসৃত বাণী। তাঁর আসর কেমন ছিল? যিকির আর তাসবীহ ভরা মজলিস। কেমন ছিল তাঁর নীরবতা? চিন্তা ও গবেষণাপূর্ণ দীর্ঘ সময়-এর নীরবতা তাঁর ভূষণ ছিল। তাঁর সহনশীলতা ছিল মায়াভরা। দুঃসাহসী অভিযান-এর বীরসেনানী ছিলেন। তাঁর সাহসিকতা ছিল অসম সাহসী সিংহ-এর ন্যায়। মনুষ্য সমাজ-এর সত্যিই এক নরশার্দূল। তাঁর মুবারক নাম কি? তিনি প্রশংসিত, তিনি মুহাম্মাদ, তিনি মাহমূদ।
তোমরা যদি আমার কাছে জানতে চাও তোমরা তাঁর ব্যাপারে কী বলবে? (আমি বলবো) তোমরা তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠ করো। আল্লাহ’র নবীর সাহাবী আরব কবির ভাষায়:
وَ أَكْرَمُ مِنْكَ لَمْ تَرَ قَطُّ عَيْنِي * وَ أَجْمَلُ مِنْكَ لَمْ تَلِدِ النِّسَاءُ
خُلِقْتَ مُبَرَّءًا مِنْ كُلِّ عَيْبٍ * كَأَنَّكَ قَدْ خُلِقْتَ كَمَا تَشَاءُ
আঁখি মোর করেনি দর্শন সুন্দর কিছু তোমার চেয়ে,
তোমার চেয়ে সুন্দর মানব জন্মেনি কোন মায়-এর পেটে।
অথবা
আমার নয়ন জুড়ে দেখেনি কখনও তোমার চেয়ে সুন্দর,
তোমার চেয়ে সুন্দর কোন নারী প্রসব করেনি কোন সন্তান।
জন্ম নিলে নিষ্কলুষ, হয়েছো যে সব দোষমুক্ত,
সৃষ্টিঅবয়বে তুমি যেন তোমার-ই কাক্সিক্ষত ॥
যতই তোমার মাহাত্ম-এর যশমালা গেয়ে বেড়াক শিল্পী-গায়করা কেমন যেন তুমি আপন স্থানে স্থির চিরভাস্বর। আর তা হবেই কেন যেখানে তাঁর প্রশংসার দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামীন? তিনি মেধা ও প্রতিভা নিকষিত হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন এই শব্দে:
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى () (তোমাদ-এর সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়।) (সূরা নাজ্ম; আয়াত: ২)। তিনি তাঁর জবান সাফাই গেয়েছেন এই বলে: وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى () (এবং তিনি মনগড়া কথা বলেন না।) (সূরা নাজম; আয়াত: ৩)। তিনিই তাঁর সঙ্গীর কথা এভাবে বিবৃত করেছেন: عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى () (তাকে শিক্ষাদান করে শক্তিশালী।) (প্রাগুক্ত; আয়াত: ৫)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর হৃদয়-এর কথা নিকষিত করেছেন এমন শব্দে: مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى () (যা সে দেখেছে তার অন্তকরণ তা অস্বীকার করেনি।) (প্রাগুক্ত; আয়াত: ১১)। তিনি তাঁর চোখ-এর সাফাই’র বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন: مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى () (তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুত হয়নি।) (প্রাগুক্ত; আয়াত: ১৭)। আল্লাহ তাআলা নবীজীর বক্ষ-এর কথা এই শব্দগুচ্ছে বর্ণনা করেছেন: أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ () (আমি কি আপনার বক্ষ উন্মোচিত করেনি? (সূরা ইনশিরাহ; আয়াত: ১)। রাসূল-এর আদ্যন্ত বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা করেছেন যে, নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্র-এর উপর অধিষ্ঠিত রয়েছেন। وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ () (নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।) (সূরা কলম; আয়াত: ৪)। কবির ভাষায়:
مُبَرَّأُ الْقَلْبِ مِنْ رَيْبٍ وَ مِنْ دَنَسٍ * وَ كَيْفَ وَهُوَ بِمَاءِ الْخُلْدِ مَغْسُوْلُ
শোবা-সন্দেহ, কলুষিতা থেকে যাঁর হৃদয় পবিত্র,
হবে না কেন যিনি শাশ্বত পানি দ্বারা প্রক্ষালিত ॥
রাসূল-এর মাঝে সমাহার ঘটেছে মাহাত্ম-এর এমন যাবতীয় গুণ ও বিশেষণ যা অন্যান্য নবী-রাসূল-এর মাঝে ছড়িয়ে রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদ-এর নবী ﷺকে দিয়েছেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর বাছাই-পবিত্রতা, হযরত শীছ-এর জন্ম-নিষ্কলুষতা, হযরত নূহ-এর বীরত্ব, হযরত ইব্রাহীম-এর সহনশীলতা, হযরত ইসমাঈল-এর জবান, হযরত ইসহাক-এর সন্তুষ্টি, হযরত সালেহ্’র বাগ্মিতা, হযরত লুকমান-এর প্রজ্ঞা, হযরত ইয়াকুব-এর সুসংবাদ, হযরত ইউসুফ-এর সৌন্দর্য, হযরত আইয়ুব-এর ধৈর্য, হযরত মূসার শক্তি-তাকত, হযরত ইউনুস-এর তাসবীহ, হযরত ইউশা’র জিহাদ, হযরত দাঊদ-এর নেয়ামত, হযরত সুলাইমান-এর শ্রদ্ধা-মিশ্রিত ভয়, হযরত ইল্ইয়াস-এর গাম্ভীর্য, হযরত খিযির-এর ইলম-জ্ঞান, হযরত ইয়াহ্ইয়া’র তাকওয়া-পরহেযগারি এবং হযরত ঈসা’র যুহ্দ-দুনিয়া বিমুখতা ও অনাম্বড়তা। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষণ সকলকে ছাড়িয়েছে এবং তাঁর নূর ও জ্যোতি সকল আলো থেকে সমুন্নত হয়েছে। কবির ভাষায়:
فَاقَ النَّبِيِّيْنَ فِيْ خَلْقٍ وَ خُلُقٍ * وَ لَمْ يُدَانُوْه فِيْ عِلْمٍ وَ لاَ كَرَمِ
তিনি ছাড়িয়েছেন নবীদ-এর, সৃষ্টি-অবয়বে ও জ্ঞান-গুণে,
ইলম ও প্রজ্ঞায় তাঁর কাছেও ঘেঁষেনি, তাঁদ-এর কেউ (ভুলে) ॥
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব আল্হাশেমী। জীবন-সূচনায় ও আয়ুষ্কাল-এর প্রভাত-সমীরণে এতিম ও অনাথ অবস্থায় কেটেছে শৈশবকাল। জীবন-প্রারম্ভে দুনিয়ার আলো-বাতাস গ্রহণ করার আগেই পিতৃহারা এক সন্তান। অনাথ-জীবন-এর বাধা-বিপত্তি বাদ সাধেনি তাঁর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যত-এর। তাঁর জন্ম ছিল মানবজাতির জন্য নতুন করে পুনর্জন্ম। র্শিক ও পৌত্তলিকতা রজনী-ঢাকা ঊষার তিনিই প্রভাতফ-এরি। যাঁর বাল্যতা নিয়ে এসেছে চরিত্র-মাধুর্য, পবিত্রতা ও কোমল আচরণ-এর শ্রেষ্ঠ অনুপম কসীদা।
মূর্তি-পূজার তিমির থেকে যোজন দূরে থেকে বেড়ে ওঠেছেন তিনি। ইতিহাস-এরর অন্ধকার থেকে নবুওয়ত-এর পুনরুদ্ধারে তাঁর প্র-এরণ। মানব ও চরিত্র-অশুচিতার মাঝে ব্যবধান-প্রাচীর স্থাপন-এর উদ্দেশ্যে তাঁর মাধ্যমে এসেছে নবুওত-এর বার্তা। তিনি নিজ-এর কওম ও গোত্র-এর মাঝে নিখুঁত ও সঠিক বার্তাবাহক। তাঁর নিকষিত বার্তায় কুরাইশদ-এর আক্কেল গুড়–ম আর আক্কেল সেলামির হিড়িক পড়ে যায়। দেখা দেয় বারবার বোকামির লক্ষণ, হোঁচট খায় তাদ-এর কথিত প্রজ্ঞার বেসাতি। অবস্থার ঢাকঢাক গুড়গুড় হওয়ায়, পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তারা লেলিয়ে দেয় তাঁর বিরুদ্ধে হাবাগবা নিম্নশ্রেণির মানুষদ-এরকে। তারা রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বারবার। ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রোধ-এর শ্বাপদ নখর নিয়ে। কিন্তু তিনি দেখালেন ধৈর্য-এর পরাকাষ্ঠা, ছাড়লেন দেশ-আপন মাতৃভূমি, বহন করে চললেন নবুওত-এর গুরু দায়িত্ব।
আলোয় উদ্ভাসিত তাঁর জীবন-এর পুরোটা। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত, আমৃত্যু জীবনকাল ইতিহাস-এর আয়নায় আজও জ্বলজ্বল অধ্যায়। তাঁর ফযীলত ও মাহাত্ম নিত্য দিন-এর নতুনত্ব। বানালেন মদীনায় নতুন রাষ্ট্র। গোড়াপত্তন করলেন স-এরা দেশ, ইতিহাস আজও গায় যার গল্প-কাহিনী।
যুহ্দ ও সাদামাঠা জীবনাদর্শ-এর তিনিই প্রথম মুয়াল্লিম, সাধকদ-এর পথিকৃত তিনি। তিনিই একক ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি ওহীর কলম দিয়ে আঁকলেন আখলাক-এর মানচিত্র। তাঁর দ্বারা সাধিত হয়েছে পার্থিব স্বল্পতার বিধি-বিধান। যাঁর কথার ছোঁয়ায় হৃদয় হয়ে যায় বিধৌত, যাঁর কথা মানব-মন কাঁড়ে।
মন-এর মণিকোঠায় গেঁড়ে বসা দুনিয়ার তীর থেকে তাঁর কথা ব-এর করে আনে মুক্তির সনদ। জীবনকাল কাটিয়েছেন যিনি দুনিয়া নাড়িনক্ষত্র ব-এর করার কাজে; পার্থিব জৌলুস-এর হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেখিয়েছেন বিশ্ববাসীকে অযথা প্রতিযোগিতার অসারতা। সাবধান করেছেন শুধু শুধু মাথা না ঘামাতে জাগতিক মোহে পড়ে। কখনও চড়েছেন মিম্বরে। বলেছেন হৃদয়নাড়ানো শ্রুতিমধুর কথা। স্মরণ করিয়ে গেছেন সেই মহাসত্য কথা:
وَإِنِّي لَسْتُ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوا وَلَكِنِّي أَخْشَى عَلَيْكُمْ الدُّنْيَا أَنْ تَنَافَسُوهَا ‘আমি তোমাদ-এরকে নিয়ে শিরক ও পৌত্তলিকতার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করছি না। আমার আশঙ্কা, তোমরা জাগতিক বিষয়াদি নিয়ে লালায়িত হবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪০৪২, ৬৪২৬)
একবার মদীনা শরীফে বাহরাইন থেকে প্রচুর ধন-সম্পদ আসল। সাহাবী আবূ উবাইদা রা. পাঠিয়েছেন। লোকজন রাসূল-এর চারপাশ-এর ভিড় ভিড় করতে লাগল। তাদ-এরকে দেখে নবীজী ﷺ মৃদু হাসলেন। পরে বললেন: মনে হয় তোমরা শোনেছ যে, আবূ উবাইদা বাহরাইন থেকে কিছু নিয়ে এসেছে ? তারা বলল, হাঁ। তিনি বললেন:
فَأَبْشِرُوا وَأَمِّلُوا مَا يَسُرُّكُمْ فَوَاللَّهِ مَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمْ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُلْهِيَكُمْ كَمَا أَلْهَتْهُمْ.
‘সুসংবাদে আনন্দিত ও আশাবাদী হও। কসম! আমি তোমাদ-এর ব্যাপারে দারিদ্র্য নিয়ে শঙ্কিত নই। আমার আশংকা তোমাদ-এর মাঝে দুনিয়ার প্রাচুর্য দেখা দেবে যেমনটি হয়েছিল তোমাদ-এর পূর্ববর্তী (উম্মত ও সম্প্রদায়-এর) মাঝে। তারা যেভাবে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে লালায়িত হয়ে মজেছিল তোমরা তাদ-এর ন্যায় দুনিয়ার প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়বে এবং মজে থাকবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪২৫)
কখনও তিনি দুনিয়ার চাকচিক্য থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে বলেছেন: كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ ‘তুমি দুনিয়ায় পরদেশি বা পথিক-এর ন্যায় থাকো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪১৬)। রাসূল ﷺ গোটা জীবন কাটিয়েছেন চরম সাদাসিধে ও সাদামাঠাভাবে। যুহ্দ ও অনাড়ম্বরতার এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁর জীবন সাধনাপূর্ণ অধ্যায়। হাতে নেই দুনিয়ার সামগ্রী। একদিন খেলে পর-এর দিন জঠর-জ্বালায় কাতর। তিনি বলে গেছেন এই কাতরতার কথা। তা ছিল তাঁর স্বেচ্ছায় ও আত্মপ্রণোদিত বিষয়। শোনিয়েছেন সেই বাণী, যা আজও হৃদয়-এর মণিকোঠায় শিহরণ জাগায় আপন শক্তিতে।
(عرض عليَّ ربي ليجعل لي بطحاء مكة ذهبًا ، قلت: لا يارب ولكن أشبع يومًا وأجوع يومًا ، فإذا جعت تضرعت إليك وذكرتك ، وإذا شبعت شكرتك وحمدتك)
“আল্লাহ তাআলা আমার নিকট মক্কার ‘বাত্হা’ এলাকাকে সোনায় পরিণত করে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। আমি বলেছিলাম: মাবুদ, না আমার দরকার নেই। বরং তৃপ্তি ভরে একদিন খাবো আরেকদিন ক্ষুদায় থাকবো। খিদে পেলে তোমার কাছে কাকুতি-মিনতি করবো। তোমাকে স্মরণ করবো। আর পরিতৃপ্ত হলে তোমার কৃতজ্ঞতায় প্রশংসা করবো।” (তিরমিযী, হাদীস: ২৩৪৭)
নবীজী ﷺ বলতেন: اللَّهُمَّ ارْزُقْ آلَ مُحَمَّدٍ قُوتًا ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ-এর পরিবার-এর রিযিক দিন আনে দিন খায় এমন করে দাও। (বা) মুহাম্মাদ-এর পরিবারকে বেঁচেবর্তে থাকতে দাও।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৬০)। আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন:
مَا شَبِعَ آلُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُنْذُ قَدِمَ الْمَدِينَةَ مِنْ طَعَامِ بُرٍّ ثَلَاثَ لَيَالٍ تِبَاعًا حَتَّى قُبِضَ ‘মুহাম্মাদ-পরিবার মদীনায় আসার পর আমৃত্যু কখনও টানা তিন দিন গম-এর খাবার পরিতৃপ্ত হয়ে খায়নি।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৫৪)। তিনি আরও বলেন: مَا أَكَلَ آلُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَكْلَتَيْنِ فِي يَوْمٍ إِلَّا إِحْدَاهُمَا تَمْرٌ ‘মুহাম্মাদ-পরিবার একদিনে দু’বার খাবার খায়নি তবে একটি ছিল খেজুর-আহার্য।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৫৫)। সাইয়্যেদুনা উমর রা. নবীজীর উপবাস-এর বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন:
رأيت رسول الله صلى الله عليه و سلم يلتوي في اليوم من الجوع . ما يجد من الدقل ما يملأ به بطنه ‘রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর অনাহার-এর অস্থিরতা আমি দেখেছি। উদরপূর্তি করার মতো নিম্নমান-এর রদ্দি খেজুরও তিনি পাননি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৪১৪৬)। সাইয়্যেদুনা আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. বলেন:
كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يبيت الليالي المتتابعة طاويا وأهله لا يجدون عشاء وكان أكثر خبزهم خبز الشعير ‘রাসূল ﷺ লাগাতার কয়েক রাত ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত যাপন করতেন। তাঁর পরিবার-এর লোকজন রাত-এর খাবার-এর আয়োজন করতে পারতেন না। তাঁদ-এর অধিকাংশ রুটি ছিল যব-এর রুটি।’ (তিরমিযী, হাদীস: ২৩৬০)। একবার সাহাবা ক-এরাম-এর একটি দল বসে আছে। সবাই উপোস-উপবাস-এর নালিশ করলো। তাঁরা তাদ-এর পেটে বাঁধা পাথরটি দেখানোর উদ্দেশ্যে কাপড় ওঠালো। তখন নবীজী তাদ-এরকে দেখালেন তাঁর উদরে বাঁধা উপলদ্বয়। তিনি বেঁধেছিলেন দু’টি পাথর। (তিরমিযী, হাদীস: ২৭৩০)
সাইয়্যেদুনা আয়েশা রা. নবীজী ﷺ-এর জীবন-কষ্ট-এর বর্ণনা উরওয়া ইবনে যুবায়-এর’র নিকট দিতে গিয়ে বলেন: ভাগ্নে, আমরা লক্ষ্য রাখতাম একে একে তিনটি নতুন চাঁদ আকাশে উদিত হয়েছে। অথচ নবীজীর বাসা-বাড়িতে আগুন জ্বলেনি। উরওয়া জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কী খেতেন? উত্তরে হযরত আয়েশা রা. বললেন, দুই কালো জিনিস। খেজুর আর পানি। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৫৯)। আয়েশা ছিদ্দীকা রা. বলেন, রাসূলে আকরাম যখন ইহলক ত্যাগ করেন তখন আমার ঘরে সামান্য যব ছাড়া কোন প্রাণী খেতে পারে এমন কোন খাবারই ছিল না। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩০৯৭; মুসলিম, হাদীস: ৭৬৪১)। তিনি আরও বলেন:
لَقَدْ مَاتَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَمَا شَبِعَ مِنْ خُبْزٍ وَزَيْتٍ فِى يَوْمٍ وَاحِدٍ مَرَّتَيْنِ. ‘রাসূলুল্লাহ্ ﷺ আমৃত্যু কখনও একদিনে দু’বার রুটি ও ব্যঞ্জন দিয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করেননি।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৭৬৪৩)। মাত্র ত্রিশ সা’ যব-এর বিনিময়ে নিজ-এর লৌহবর্ম এক ইয়াহুদির নিকট বন্ধক রেখেছিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৪৬৭)
নবীজী ﷺ’র পুরনো জীর্ণ সাধারণ চাটাই দুনিয়ার জাঁকজমক-এর বিপরীতে অবস্থান করছে। তিনি নিজেকে অসার, সস্তা ও ভঙ্গুর পার্থিব ভোগবিলাস আর আরাম-আয়েশ-এর বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত করেছেন। দারিদ্র্য-এর লেলিহান অগ্নির দগ্ধতায় নিজেকে করেছেন বিদগ্ধ। ঝালিয়েছেন নিজেকে। করেছেন নিকষিত।
একদা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. নবীজী ﷺ-এর হুজরা মোবারকে প্রবেশ করলেন। নবীজীকে পেলেন জীর্ণ, ছেঁড়া ও পুরনো চাটাইয়ে শুইয়ে আছেন। চাটাইয়-এর দাগ লেগে গেছে তাঁর পার্শ্বদেশে। খেজুর ডাল-এর ছাল-এর তৈরী বালিশ তাঁর মাথার নিচে। মাথার উপর ঝুলে আছে উট-এর চামড়া। হুজরার একপার্শ্বে এক সা’ পরিমাণ একমুষ্ঠি যব। দেয়াল-এর নিচে রাখা আছে চামড়া পাকা করার কিছু ঘাস। এসব কিছু দেখে সাইয়্যেদুনা উমর-এর দু’চোখ বেয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। নবীজীর বিনীত অবস্থা দেখে কান্না চেপে রাখতে পারলেন না। নবীজী ﷺ উমর-এর পড়ন্ত চোখ-এর পানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে খাত্তাব-এর ছেলে কাঁদছো কেন? উমর রা. অশ্রু ও আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ! আমি না কেঁদে পারি কিভাবে (?), এই চাটাইয়-এর দাগ আপনার মোবারক পার্শ্বদেশে, আপনার সহায়-সম্বল বলতে যা কিছু তা আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে। অথচ রোম ও পারস্য-এর রাজা-বাদশাগণ সোনার খাট-পালঙ্কে, রেশম ও সিল্ক-এর কোমল মসৃণ দুগ্ধফেননিভ শয্যায়, রকমারি বাহারি ফল-ফলাদির আনন্দে মজে আছে। আপনি আল্লাহর নবী ও মনোনীত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও এই করুণ অবস্থা! নবীজী মুচকি হাসির ঝলক নিয়ে বললেন:
يا عمر إن أولئك قد عجلت لهم طيباتهم وهي وشيكة الانقطاع وإنا قوم قد أخرت لنا طيباتنا في آخرتنا أما ترضى ان تكون لهم الدنيا ولنا الآخرة قال عمر بلى قال فإنه كذاك
উমর, তারা তাদ-এর ভালো কাজ-এর সুফল দুনিয়ার জীবনে ভোগ করে নিচ্ছে। যা অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। আমাদ-এর নেক ও ভালো কাজ-এর ফল পরকালে। তোমার কি পছন্দ নয় যে, তাদ-এর জন্য দুনিয়া আর আমাদ-এর জন্য আখ-এরাত? উমর রা. বললেন, অবশ্যই আমি তা পছন্দ করি। তিনি বললেন, বিষয়টা এমনই। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস: ৭০৭২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ১২৪৪০)।
অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, সাইয়্যেদুনা উমর রা. প্রস্তাব করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এর চেয়ে কোমল শয্যা যদি গ্রহণ করতেন? নবীজী ﷺ বিনয়-এর সঙ্গে বললেন:
ما لي وما للدنيا ما أنا في الدنيا إلا كراكب استظل تحت شجرة ثم راح وتركها ‘আমার সাথে দুনিয়ার কি সম্পর্ক? পৃথিবীতে আমি আছি এক আরোহীর ন্যায় যে একটি গাছ-এর ছায়ায় ক্ষণিক-এর বিশ্রাম নিয়ে আর ফিরে না আসার মানসে চলে গেছে।’ (তিরমিযী, হাদীস: ২৩৭৭)
নবীজী ﷺ-এর আখলাক-চরিত্র সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ। তাঁর যুহ্দ ও অনাড়ম্বরতা দান-এর ন্যায় সুসংহত। দানশীলতা ধৈর্য-এর ন্যায়। শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা সহনশীলতার মতো। এভাবে কুদরত-এর অপার মহিমায় তিনি ছিলেন শাশ্বত সুবিন্যস্ত আখলাখ-এর প্রতিচ্ছবি। হেদায়াত-এর আলোকচ্ছটায় সবকিছু তার মাঝে সুষম মাত্রায় ছিল।
সাইয়্যেদুনা আয়েশা ছিদ্দীকা রা. নবীজী ﷺ-এর চরিত্র-এর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে, তাঁর চরিত্র ছিল আল্কুরআন। পবিত্র কুরআন-এর আদর্শিক প্রতিচ্ছবিই হচ্ছে রাসূল-এর জীবন ও আচরণ। রাসূল ﷺ অশ্লীলভাষী ছিলেন না। অশ্লীলতা তাঁর ধাতেও ছিল না এবং তিনি ইচ্ছা করেও অশ্লীলতা উচ্চারণ করতে পারতেন না। তিনি বাজারে হৈচৈ করতেন না। অন্যায় ও অসৎ আচরণ-এর বিপরীতে তিনি দুরাচার-মন্দ আচরণ করতেন না। তিনি মাফ করতেন। ক্ষমা ছিল তাঁর আদর্শ। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৭৪৬; তিরমিযী, হাদীস: ২০১৬)। নবীজীর খাদেম হযরত আনাস রা. বলেন, দশ বছর ধরে নবী ﷺ-এর সেবা করেছি। তাঁর চরিত্র ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। সফর ও আবাসে তাঁর সাথে ছিলাম। কসম, কখনও তিনি আমার কৃত কাজে বলেননি, কেন এটা এভাবে করলে? কিংবা এটা এভাবে কেন করলে না? তিনি কখনও আমাকে গাল দেননি, প্রহার করেননি, ধমক দেননি, বকা দেননি। কখনও আমার দিকে চেয়ে তাঁর চেহারায় ভ্রƒকুটি করেননি। কেউ তাঁর সাথে হাত মেলালে তিনি আগে হাত সরাতেন না যে পর্যন্ত সেই ব্যক্তি হাত না সরাতো। দেখা করতে আসা লোক চেহারা না সরালে তিনি চেহারা মোবারক সরাতেন না। সঙ্গী-সাথীদ-এর দিকে পা মেলে বসতেন না। একজন সাধারণ দাসী পর্যন্ত তাঁর হাত ধরে নিরিবিলি কথা বলতে পারতো। সামান্য দাসীর কথাও শোনেছেন হেঁটে গিয়ে।
বড়দ-এর বিনয়-এর উদ্দেশ্যে গোড়াপত্তন করলেন প্রথম পাঠশালা। হৃদয়-এর অহঙ্কার মাড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হল মাদ্রাসাতুল সুফ্ফাহ। বিনয়-এর মূর্তপ্রতীক হয়ে প্রবেশ করলেন হৃদয়-এর মণিকোঠায়। সাদাসিধেভাবে স্থান করে নিলেন আপন মহিমায়।
রিসালাত-এর সূর্যোদয়-এর সাথে সাথে রাসূলে আকরাম ﷺ-এর নিকট জিব্রাঈল আ. এর সঙ্গে পাঠালেন জনৈক ফ-এরেশ্তা। জিজ্ঞেস করলেন, বিনীত সাধারণ নবী হতে চান নাকি পরাক্রমশালী বাদশাহ হয়ে নবী হতে চান? মহানবী ﷺ আসমানি শিষ্টাচার ঢঙে উত্তর দিলেন, আমি তো বান্দা হয়ে নবী হতে চাই। (আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৬/৫০)। পূর্বাহ্ন-এর সময় জনৈক ব্যক্তি নবীজী ﷺ’র সামনে বসে রীতিমতো কাঁপছে এবং ভয়ে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তাকে মহানবী ﷺ বুঝালেন স্থূল স্বরে, শান্ত হও। আমি কোন বাদশাহ নই। আমি কুরাইশী এক নারীর সন্তান, যে বাতাসে রৌদ্রে গোস্ত শুকিয়ে খায়।
মহানবী ﷺ নিজ-এর জুতো নিজেই সেলাই করতেন। নিজ-এর বকরী দোহন করতেন। বাসা-বাড়ি টুকিটাকি কাজ পরিবার-এর লোকজন-এর সাথে নিজেও করতেন। পশম-এর কাপড়-চোপড় পরিধান করতেন। গাধা চড়াতেন। বাহন-এর পেছনে অন্য কাউকে উঠাতেন। তিনি বাচ্চাদ-এর সাথে আনন্দ-বিনোদন করতেন। তাদ-এর প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। মদীনায় আনাস বিন মালেক রা. এর আবূ উমাইর নামে এক ভাই ছিল। সদ্য মাই ছাড়ানো ছোট অবুঝ। নুগাইর নাম-এর ছোট পাখি নিয়ে সে খেলতো। মহানবী ﷺ তার পাশে দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলতেন: আবূ উমাইর ! নুগাইর-এর খবর কি? তাঁর মনে বংশীয় প্রীতি ও ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রশমিত হয়ে গিয়েছিল। সেখানে স্থান করেছিল সহনশীলতা ও মানুষ-এর প্রতি মায়া-মমতা ও ভালোবাসা। তাই তিনি মন্দ-এর বিনিময়ে সদাশয় হয়ে মহৎ আচরণ প্রদর্শন করতেন।
সাইয়্যেদুনা আয়শো ছিদ্দীকা রা. বলেন, মহানবী ﷺ কখনও নিজ-এর কোন ব্যাপারে কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে কেউ যদি আল্লাহ তাআলার সীমারেখা লঙ্ঘন করে তবে তা নিতান্তই আল্লাহ’র মর্যাদার খাতিরে তিনি প্রতিশোধ নিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩৫৬০)। তিনি হুনাইন’র সময় কিছু লোকজনকে কিছু উট দিয়েছিলেন কুদরতি প্রজ্ঞার খাতিরে। এতে জনৈক ব্যক্তি বলে উঠল, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা’র সন্তুষ্টি কামনা করা হয়নি। কথা বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে তা নবীজী পর্যন্ত গড়াতে থাকে। তিনি শোনে বললেন, আল্লাহ তাআলা সাইয়্যেদুনা মূসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি রহম করুন। তাঁকে তো আমার চেয়ে বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে। (প্রাগুক্ত, হাদীস: ৪৩৩৬)
যখন নবীজীকে বিষমাখা বকরী দেওয়া হয়েছিল বকরী বলে উঠলো আমি বিষাক্ত। মহানবী ﷺ শুধু এতটুকু কথা বললেন, এ কাজ তুমি কেন করলে? সে বলল, আমার পরীক্ষা করার ইচ্ছা ছিল। আপনি যদি সত্য নবী হয়ে থাকেন আল্লাহ আপনাকে জানিয়ে দিবেন। আর যদি ভুয়া নবী হয়ে থাকেন লোকজন আপনার থেকে নিস্তার পেয়ে যাবে। এ কথা শোনে তিনি তার থেকে কোন প্রতিশোধ নিলেন না। (প্রাগুক্ত, হাদীস: ২৬১৭)। যে কুরাইশ সম্প্রদায় মহানবী ﷺকে বিতাড়িত করলো, যারা মহানবী ﷺ-এর হত্যাকা- ঘটাতে চেয়েছিল এদ-এরকে আবার মক্কা বিজয়-এর দিন সাধারণ ক্ষমা করে দিলেন মহান উদারতায়। ‘যাও তোমরা সবাই মুক্ত ও স্বাধীন।’
একবার মহানবী ﷺকে বলা হল, দাওস গোত্র-এর লোক-এরা নাফরমান ও উদ্ধত। আপনি তাদ-এর প্রতি বদদোআ করুন। নবীজী বদদোআর পরিবর্তে কিবলামুখী হয়ে কাতর হয়ে দু’হাত তুলে দোআ করতে লাগলেন: হে আল্লাহ ! দাওস গোত্রকে হিদায়াত দান কর। কল্পনার বাইরে তিনি দয়া ও স্নেহ করতেন। তাঁর শিরা-উপশিরায় কোমলতা ও দয়ার রক্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। মহানবী ﷺ বলেন, আমি নামায শুরু করি। মুসল্লীদ-এর নিয়ে নামায দীর্ঘায়িত করতে মনে চায়। কিন্তু পরক্ষণে কানে আওয়াজ আসে শিশুর কান্নার আওয়াজ। তখন আমি নামায সংক্ষিপ্ত করে নিই। কারণ আমি জানি, আমাদ-এর সাথে নামাযে অংশগ্রহণ করেছে অনেক নারী। তাদ-এর মধ্যে এই বাচ্চার মাও রয়েছে। কান্নার আওয়াজ শোনে তার মায়-এর কেমন ব্যথা মনে অনুভূত হয় তা আমার জানা তাই নামায সংক্ষিপ্ত করে সমাপ্ত করে ফেলি। (প্রাগুক্ত, হাদীস: ৭০৯, ৭১০)
মহানবী ﷺ-এর হৃদয়-গহিনে স্থান করে নিয়েছে তাকওয়া-তাহারাত ও পূত-পবিত্রতা। যা প্রতিধ্বনিত হয়েছে তবলার চেয়ে সশব্দে তাঁর কাজেকর্মে। তাই তিনি বিনিদ্র থেকেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে অস্থির ছিলেন। কাটিয়েছেন উদ্বিগ্ন সময়। উৎকণ্ঠায় পার করেছেন বিভিন্ন আনন্দ-এর মুহূর্তগুলো।
মহানবী ﷺ বিছানায় শুতে গেলেন। পার্শ্বদেশ-এর নিচে খেজুর পেয়ে তিনি তা খেলেন। কিন্তু সে রাতে তিনি আর ঘুমাতে পারলেন না। বিনিদ্র রজনী কাটালেন বড় অস্থিরতায়। সহধর্মিণী বললেন, এই রাতে তো আপনি জেগেই রইলেন? তিনি রাগত চেহারায় বললেন, বিছানায় খেজুর পেয়ে তা খেলাম। যাকাত-এর খেজুরও তো আমাদ-এর বাসায় আছে। না জানি যাকাত-এর খেজুর খেয়ে ফেললাম। এ নিয়ে শঙ্কিত। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৬৮২০)
মহানবী ﷺ-এর দৌহিত্র সাইয়্যেদুনা হাসান ইবনে আলী রা. একবার যাকাত-এর খেজুর খেয়ে ফেলেছিলেন। নবীজী ﷺ তা তার মুখ থেকে ব-এর করতে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি আওয়াজ দিলেন ছিঃ! ছিঃ! এ তো যাকাত-এর খেজুর!
মহান আল্লাহ তাআলা ছিলেন মহানবীর প্রাণকেন্দ্র, তিনিই ছিলেন তাঁর আবর্তনকীলক। হৃদয়-এর টান পুরোটাই ছিল তাঁর দিকে। তাই তাঁর উপর ছিল আদ্যন্ত নির্ভরতা। সর্বাবস্থায় তাঁর প্রতি থাকতো প্রাণ-এর তাওয়াক্কুল।
একবার কাঠফাটা রোদ-এর তীব্রতা থেকে বাঁচতে মহানবী ﷺ একটি গাছ-এর নিচে আশ্রয় নিলেন। তিনি গভীর ঘুমে শায়িত। গাছে ঝুলিয়ে রেখেছেন তরবারি। এই ফাঁকে এক বেদুঈন হাতে তরবারি নিয়ে কোষমুক্ত করে নবীজীর ﷺ-এর মুখ-এর উপর বলে উঠল: এখন তোমাকে আমার কবল থেকে কে বাঁচাবে? তিনি আল্লাহর উপর ভরপুর ভরসা রেখে বললেন, আল্লাহ !! (কথা শোনে) যাযাবর-এর হাত থেকে তরবারি খসে পড়ে গেল। (এবার) মহানবী ﷺ তরবারি হাতে নিয়ে তাকে বললেন, এবার তোমার আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? যাযাবর বলল, হে মুহাম্মাদ কল্যাণকামী তরবারির ধারক হও! মহানবী ﷺ তাকে ছেড়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৯১০)
আল্লাহ তাআলার ভয়ে কান্নাকাটি করা মহানবী ﷺ-এর ইবাদত। তিনি ছিলেন অশ্রুপ্রবণ ব্যক্তি। হৃদয়বিদারক বা করুণ কোন কিছু দেখলে কিংবা সত্য কোন উপদেশ কানে শুনতে পেলে ঝরঝর করে চোখ বেয়ে পানি পড়তো। একদা তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. কে বললেন: আমাকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাও। ইবনে মাসঊদ রা. বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনার উপর কুরআন নাযিল হয় আর আমি কিনা আপনাকে কুরআন তেলাওয়াত শোনাব!? মহানবী ﷺ বললেন, অন্যদ-এর থেকে আমি শুনতে চাই। ইবনে মাসঊদ রা. সূরা নিসা থেকে কুরআন তেলাওয়াত করতে লাগলেন। যখন এই আয়াত তেলাওয়াত করতে লাগলেন: فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا () ‘যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হতে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকে তাদ-এর বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থি করব তখন কী অবস্থা হবে?’ (সূরা নিসা, আয়াত: ৪১)। তখন নবীজী তাকে ছোট শব্দে বললেন, ব্যস! ইবনে মাসঊদ রা. বলেন, চেয়ে দেখি তাঁর অশ্রুসজল। কপোল বেয়ে চোখ-এর পানি ঝরছে।
তাঁর হাত-এর তালু ছিল অতিশয় কোমল। দেদার খরচ করতেন। শুধু দিতেন, দান করতেন দু’হাতে। গ্রহণ করতেন না কখনও। মরুভূমির বায়ুর সাথে পাল্লা দিতেন খরচ করার জন্য। দারিদ্র্যচিন্তা নেই এমন ব্যক্তির ন্যায় ছিল তাঁর দান-এর হাত। সাইয়্যেদুনা ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মানুষ-এর মাঝে তিনি ছিলেন সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি। তাঁর দান-এর মাত্রা সর্বোচ্চ পরিমাণে ছিল মাহে রমাযানে যখন তাঁর সাথে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাত হতো। রমাযান-এর প্রতি রাতে সাক্ষাতে তিনি তাঁর সাথে কুরআন ‘দাওর’ করতেন। পরস্পর কুরআন শোনাতেন। বসন্ত-এর সমীরণ চেয়ে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-এর দান-এর শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬, ১৯০৪, ৩৫৫৪, ৪৯৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৬১৪৯)
সাইয়্যেদুনা জাব-এর রা. বলেছেন, রাসূল-এর কাছে কখনও কোন কিছু চাওয়া হয়েছে আর তিনি বলেছেন নেই-এমন কখনও হয়নি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৬১৫৮, ৬১৬০)। মহানবী ﷺ খুব অসুস্থ। সাতটি স্বর্ণমুদ্রা তাঁর কাছে, যেগুলো তিনি সহধর্মিণী হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা রা.’র কাছে রেখে দান করে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আয়েশা রা. আনমনে দান করতে ভুলে গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তাঁর সম্বিত ফিরলে তিনি বললেন, (স্বর্ণমুদ্রাগুলো) দান করেছিলে? তিনি বললেন, আপনার অবস্থা দেখে ফুরসত পায়নি। তিনি বললেন, নিয়ে এসো। তিনি সেগুলো হাতে নিয়ে বললেন, এই স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আমি যদি মারা যাই, এ অবস্থায় আল্লাহ’র সাথে আমার দেখা হয়-আমার কী হবে? (মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ, হাদীস: ১৭৭৬০)।
মলিনবেশে নগ্নপদে জনৈক ব্যক্তি রাসূল-এর কাছে এসে কিছু চাইল। তিনি তাকে দিলেন। সে আবার চাইল। নবীজী ﷺ তাকে লজ্জাজনিত কারণে ফ-এরত দিতে পারলেন না। তিনি হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় বললেন, আমার কাছে দেওয়ার মতো এ মুহূর্তে কিছু নেই। আমার নামে কোন কিছু কিনে নাও। পয়সা আসলে আমি তা পরিশোধ করে দিবো। এ দৃশ্য দেখে সাইয়্যেদুনা উমর রা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনি তো তাকে দিয়েছেন। এখন সাধ্য-এর অতিরিক্ত আবার দেওয়া আল্লাহ তাআলা আপনার উপর ওয়াজিব করেননি। এ কথা শোনে নবীজীর মুখম-লে বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। জনৈক আনসারী সাহাবী বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি দান করতে থাকেন। আল্লাহ তাআলার কাছে অপ্রতুল-এর আশঙ্কা করবেন না। লোকটির কথায় নবীজীর মোবারক ঠোঁটে হাসির ঝলক দেখা দেয়। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ৩৪৮)
সাহাবাদ-এর সুরভিত দল-এর মাঝে রাসূলে আকরাম ﷺ বসে আছেন। জনৈক মহিলা সুন্দর একটি কাপড় নিয়ে হাজির। নিবেদন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এই কাপড়টা আপনাকে পরাতে এসেছি। নবীজী তা নিলেন। এ কাপড় তখন তার দরকার ছিল। তিনি তা পরিধান করলেন। জনৈক সাহাবী সেই কাপড় পরিহিত অবস্থায় নবীজীকে দেখে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! বেশ চমৎকার কাপড়! আমাকে দেন আমি পরিধান করি। নবীজী ﷺ মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। মজলিস থেকে উঠে যাওয়ার সময় তিনি সে কাপড় তাকে খুলে দিয়ে গেলেন। অথচ তার চেয়ে বেশি দরকার নিজ-এর। (কানযুল উম্মাল, হাদীস: ১৮৬৩৮)
একবার এক বেদুঈন নবীজীকে তাঁর চাদর ধরে এমন হেঁচটা টান দিয়েছিল যে, তাঁর গলায় দাগ পড়ে গিয়েছিল। ঘাড় দিয়ে রক্ত ব-এর হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যাযাবর গলার চাদর ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে অমার্জিত ভাষায়: ‘হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আল্লাহ তাআলা’র যে সম্পদরাজি আছে আমাকে সেখান থেকে সম্পদ দাও। তুমি তোমার সম্পদও দিবে না এবং তোমার বাপ-এর অর্থকড়িও দিবে না।’ এ কথা শোনে তিনি মৃদু হেসে দিয়ে তাকে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে দিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৮০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৮১৯)
সকল ইবাদত-এর মাঝে বিশেষ করে নামাযে নবীজী ﷺ-এর নয়নপ্রীতি ছিল। রাত-এর অনাকার অন্ধকারে প্রাণ-এর স্পন্দন খুঁজে পেতেন নামাযে। জীবন-অভিধান পুরোটাই সালাতে পরিপূর্ণ। তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে থাকতেন। থাকতে থাকতে তাঁর কদম মোবারক ফুলে যেতো। কখনও পদযুগল ফেটে যেতো। মা আয়েশা ছিদ্দীকা রা. তাঁকে বলতেন, আল্লাহ তাআলা কি আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ-খাতা মাফ করে দেননি? তিনি তাঁর কৃতজ্ঞতাবিধৌত মুখম-ল নিয়ে বলে উঠলেন: (أَفَلاَ أَكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا؟!) আমি কি আল্লাহ তাআলা কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১১৩০; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৮১৯)
নবীজী ﷺ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তাঁর রব-এর সান্নিধ্য। বরণীয় ও সমাদৃত হয়েছে তাঁর নিকট মাওলা বরহক-এর সংস্পর্শ। হিজরী ১১ সাল-এর দোসরা রবীউল আউয়াল সোমবার তিনি চলে যান তাঁর আপন প্রতিপালক-এর নিকট। যেখানে জীবনাবসান হয়েছিল সেখানেই সোমবারে সমাহিত হন। আমরা শুধু কবির এই চরণগুলোই আবৃত্তি করছি:
وَ لَئِنْ مَدَحْتُ مُحَمَّدًا بِمَقَالَتِيْ * فَلَقَدْ مَدَحْتُ مَقَالَتِيْ بِمُحَمَّدِ
মুহাম্মাদ হয় যদি প্রশংসিত মোর কথামালায়,
যশগাথা হয় যে প্রশংসিত সেই মুহাম্মাদে ॥