সাঈদ ইবনে আমির আল্জুমাহী রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ২০ হিজরী : ৬৪১ খৃস্টাব্দ)
ঈমান ও বিশ্বাসের কিংবদন্তি, অনুকরণীয় আদর্শ ও স্তম্ভ। যাহেদ ও সাধকদের মধ্যে অন্যমত সাধক। সিপাহসালার এবং আমির-ধনাঢ্য হয়েও ইতিহাস যাঁর নাম রেকর্ড করেছে দীনদরিদ্রের তালিকায়। সাদামাঠা জীবনের আড়ালে থেকে যায় যাঁর মর্যাদা ও গুণাবলী। চাপা পড়ে আছে যাঁর অসংখ্য বিশেষণ। অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা আর বিনীত পোশাকে থাকতেন তিনি। হয়তো নিজেকে নস্যিই ভাবতেন তিনি। তাঁর জীবন-অভিধানে ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুহদ ও দুনিয়া বিমুুখিতা, আবূ বকর রা.-এর তাকওয়া-তাহারাত এবং উমর রা.-এর ন্যায়-ইনসাফ।
আমির ও রাহেব। ধনাঢ্য ও সাধক। খাইবার অভিযানের আগেই মুসলমান হন। খাইবারসহ পরবর্তী সকল সমর অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সাঈদ ইবনে আমির আলজুমাহী রা.। নেতৃস্থানীয় ও প্রধান প্রধান সাহাবাদের একজন। মর্যাদার মুকুট তাঁর মাথায়। দান-অনুগ্রহ আর দুনিয়া বিমুখিতায় প্রসিদ্ধ। পোড়খাওয়া ও অভিজ্ঞ মানুষ। মর্যাদা ও বিশেষণ কীভাবে অর্জিত তা ভালোভাবে জানতেন। রপ্ত করেছিলেন আদর্শ গুণাবলী।
নিজের ভাতা হাতে পাওয়ামাত্র নিজের পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনে অবশিষ্টটুকু দান করে দিতেন। তাঁর সহধর্মিণী বলতেন, অবশিষ্ট ভাতাটুকু কোথায়? তিনি বলতেন, আমার পরওয়ারদেগারকে ঋণ দিয়েছি।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর নিকট তাঁর শাসনামলের প্রথম দিকে এই সাহাবী গিয়ে হাজির। তারস্বরে গিয়ে বললেন, হে উমর! আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে বলছি, মানুষের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহ তাআলার বিধানে কোন মানুষ ও সমাজকে তোয়াক্কা করবেন না। অন্যথায় আপনার কথার সাথে কাজের মিল পাবেন না। কারণ শ্রেষ্ঠ কথা বলতে কাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কথাকে বুঝায়। হে উমর! যেসব মুসলমানদের কর্মকারে দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা উপর ন্যস্ত করেছেন তাঁদের ব্যাপারে সজাগ থাকুন। নিজের জন্য এবং নিজের পরিবারের জন্য যা পছন্দ করেন তাই সাধারণ মুসলমানদের জন্য পছন্দ করুন। নিজের জন্য এবং নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য যা অপছন্দ করেন সেই নজরে অন্যদের বেলায় দেখুন। সর্বদা সত্যের দিকে দৃষ্টি রাখুন।
উমর রা. বললেন, তখন দুশ্চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং দু’চোখে অশ্রু টলমল করছিল, সাঈদ, এমনটা কে পারবে? তিনি বললেন, আপনার মতো লোকই এমনটা পারবে। আল্লাহ তাআলা আপনাকে উম্মতি মুহাম্মাদির দায়িত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআলা আর আপনার মাঝে তৃতীয় কেউ নেই। সুতরাং…
সাঈদ ইবনে আমির রা.-এর ভালোবাসা আমীরুল মুমিনীনের অন্তরে বদ্ধমূল হয়েছিল। হৃদয়ে তাঁকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছিলেন। দুনিয়া বিমুখিতার ব্যাপারে যে সততা হৃদয়ে পোষণ করতেন তার জন্য তিনি বড় প্রশান্তি লাভ করেছিলেন। তাই তো উমর রা. সাঈদ ইবনে আমির রা.কে নেতৃত্বের যোগ্য মনে করতেন। আমীরুল মুমিনীনের মনোনীত ব্যক্তি হলেন। তিনি তাঁকে সিরিয়া পাঠালেন। হিমস শহরের দায়িত্ব তাঁর কাছে ন্যস্ত করলেন। যেখানে বাণিজ্য ও কুদরতি ধনৈশ্বর্যের প্রাচুর্য ছিল। যা দেখে বিচক্ষণ ব্যক্তিও ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতো। তাঁর মতো যাহেদ ও রাহেব, দুনিয়া বিমুখ ও সাধক ব্যতীত অন্য কেউ সামলাতে পারবে না।
উমর রা. বললেন, আমি আপনাকে পদস্থ কর্মকর্তা নিযুক্ত করতে চাই। এ কথা শোনে সাঈদ ইবনে আমির রা.-এর চেহারা বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে হয়ে উঠে এবং রীতিমতো কাঁপতে লাগেন। বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আমাকে পরীক্ষায় ফেলবেন না। উমর রা. বললেন, আমি আপনাকে এমন গোষ্ঠীর মাঝে পাঠাচ্ছি আপনি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন। আবার এজন্য পাঠাচ্ছি না যে, আপনি তাদেরকে উত্তম-মাধ্যম দিবেন এবং তাদেরকে বেআবরু করবেন। আমি আপনাকে পাঠাতে চাই তাদের দুশমন ও শত্রুবাহিনীর সাথে মোকাবেল করবেন এবং তাদের মাঝে যুদ্ধলব্ধ সম্পদরাজি বন্টন করে দিবেন।
এ কথা শোনে হযরত সাঈদ ইবনে আমির রা.-এর দু’চোখে পানি এসে যায়। অন্তরে প্রশান্তি জাগে। হযরত উমর রা. এর মুখনিঃসৃত কথাবার্তা শুনতে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং হযরত উমর রা.-এর প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। হযরত সাঈদ ইবনে আমির রা. কাঁধে লাঠি তুলে নিলেন এবং সিরিয়া দেশ অভিমুখে ছুটে চললেন।
রাতের পেছনে দিবসগুলো ছুটে চলেছ অবিরাম গতিতে। অনেক দিন পর সিরিয়া আসলেন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.। ঘুরে বেড়ালেন দেশের আনাচ-কানাচ। অবশেষে অবস্থান করলেন হিমস শহরে। বললেন, এই শহরের দীনদরিদ্র মানুষের নামের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য। তখন তাঁর কাছে দেয়া হল একটি তালিকা, যাতে নগরপাল হযরত সাঈদ ইবনে আমির-এর নামও ছিল। উমর রা. বললেন, সাঈদ ইবনে আমির কে? লোকজন বলল, আমাদের প্রধান ব্যক্তি, তিনি আমাদের আমীর। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তোমাদের নগরপাল কি গরীব? তিনি আমীর হয়েও কি দরিদ্র? তারা বলল, হাঁ। উমর রা. খুব বিস্ময়াভিভূত হলেন। বললেন, তোমাদের আমীর কীভাবে নিঃস্ব হন? তাঁর ভাতা কোথায়? তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মানি পান না? লোকজন বলল, যা কিছু পান সব গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।
একথা শোনে হযরত উমর রা. খুব কাঁদলেন। চোখের পানিতে দাড়িসিক্ত হয়ে গেল। আমীর ও নগরপালের জন্য এক হাজার দিনার বরাদ্দ দিলেন। দূতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, তুমি গিয়ে বলো, আমীরুল মুমিনীন আপনাকে সালাম দিয়েছেন আর বলেছেন, এগুলো আপনার প্রয়োজনে খরচ করার জন্য। বার্তা ও দিনারবাহক হযরত সাঈদ ইবনে আমির রা. এসে বললেন সব কথা। কিন্তু তিনি দিনার দেখে ইন্নালিল্লাহি….পড়তে লাগলেন। এখন তাঁর দুশ্চিন্তা আগের চেয়ে বেড়ে গেল। অবস্থা দেখে তাঁর সহধর্মিণী বললেন, কী হয়েছে? আমীরুল মুমিনীন কী মারা গিয়েছেন? বললেন, এর চেয়ে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে। বললেন, কী অসাধারণ বিয়োগান্তক ঘটনা? বললেন, এরচেয়ে ভয়ানক। স্ত্রী বললেন, কেয়ামত সংক্রান্ত কোন আলামত? বললেন, তার চেয়ে বড়। অধৈর্য হয়ে তাঁর স্ত্রী বলল, কী হয়েছে? কী সেই অঘটন? তিনি চেহারা থেকে দুশ্চিন্তার ছাপ মুছে বললেন, দুনিয়া আমার কাছে হাজির। আমার কাছে এসব দিনার এসে আমাকে ফেতনায় ফেলে দিয়েছে। বিবি বলল, যা ইচ্ছে করেন। তিনি দেখলেন, একদল মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী অভিযানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে চলছে। তিনি সেসব দিনার তাঁদের মাঝে বন্টন করে দিলেন।
সহধর্মিণী বলল, এগুলো রেখে দিলে তো আমাদের কাজে লাগতো। তিনি বললেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শোনেছি, (অনুবাদ) জান্নাতী কোন রমণী যদি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখে এতে গোটা পৃথিবী কস্তুরি ঘ্রাণে ভরে যাবে। তোমার চেয়ে আমার বেশি পছন্দ সেসব রমণী। এ কথা শোনে বিবি সাহেব একদম নীরব হয়ে গেল।
হিমস বাসিদের নিয়ে হযরত উমর রা. বৈঠকে বসলেন। তারা যাকাত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনেক নালিশ করলো। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে তোমাদের কোন অভিযোগ আছে কিনা? তারা বলল, তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের চারটা নালিশ রয়েছে। বেলা বাড়ার পর তিনি আমাদের মাঝে আসেন। রাতের বেলায় কারো প্রয়োজনে তিনি সাড়া দেন না। প্রতি মাসে একদিন তিনি আমাদের সাথে দেখা করেন না। মাঝে মাঝে তাঁর জ্ঞান হারিয়ে যায়। এসব কথা শোনে হযরত উমর রা. অস্থির হয়ে উঠলেন। কপাল ঘর্মাক্ত হয়ে হয়ে উঠল। একান্তে আল্লাহ তাআলার প্রতি মনোনিবেশী হলেন। মনে আহাজারি করতে লাগলেন। মাবুদ! তাঁর ব্যাপারে আমার সুধারণায় ব্যর্থতা দিবেন না। অল্প সময়ে তিনি হিমসের জনগণ ও সাঈদ ইবনে আমির রা.-কে মুখোমুখি করে বসার ব্যবস্থা করলেন। এরপর বললেন, বলো কী তোমাদের অভিযোগ? তারা বলল, তিনি বেলা বাড়ার পর আমাদের মাঝে আসেন। জবাবে হযরত সাঈদ ইবনে আমির রা. বললেন, কসম! আমিও সেটা অপছন্দ করি। কিন্তু আমি কী করব? আমার পরিবারের কোন কাজের লোক নেই। আমাকে আটার খামির বানাতে হয়। রুটি আমাকে বেলতে হয়। এসব কিছু সেরে উযূ করে আমি বের হই।
উমর রা. বললেন, তোমাদের আর কী অভিযোগ? তারা বলল, তিনি রাতের বেলায় আমাদের কোন প্রয়োজনে সাড়া দেন না। হযরত সাঈদ রা. বললেন, দিবস তো তাদের জন্য। আর রাতটা আমার পরওয়ারদেগার-এর জন্য। উমর রা. বললেন, আর কী তোমাদের অভিযোগ? মাসের একদিন তিনি আমাদের সাথে দেখাই করেন না। সাঈদ রা. বললেন, আমার কাপড় ধোয়ার কোন কাজের লোক নেই। তাছাড়া বাড়তি কোন কাপড়ও নেই। এমতাবস্থায় ধোয়া কাপড় না শুকানো পর্যন্ত আমি বের হতে পারি না। অগত্যা আমাকে শেষ বেলায় বের হতে হয়। হযরত উমর রা. বললেন, তোমাদের আর কী অভিযোগ? তারা বলল, তিনি মাঝে মাঝে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। সাঈদ ইবনে আমির রা. বললেন, মক্কা নগরীতে আমি হযরত খুবাইব ইবনে আদী আলআনসারী-এর মৃত্যুদণ্ড দেখেছিলাম। কুরাইশ লোকজন তাঁর গোস্ত কেটে লাকড়ির উপর রেখে বলেছিল, তুমি কি চাও মুহাম্মাদ তোমার স্থানে হোক? তিনি বলেছিলেন, কসম! আমি কখনও চাই না যে, আমি বাড়িতে আরামে থাকি আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীরে একটি কাঁটা লাগুক। তারপর উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, হে মুহাম্মাদ!! সে দিনের কথা মনে পড়ে, যে দিন আমি তাঁকে সাহায্য করিনি। আমার কাছে মনে হয় আল্লাহ তাআলা কখনও আমার সেই গুনাহ মাফ করবেন না। এ কথা মনে পড়লে এভাবে আমি মাঝে মুমূর্ষু মরণাপন্ন হয়ে যাই।
এসব কথা শোনে উমর রা. আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন, আলহামদুলিল্লাহ্! যিনি আমার দূরদর্শিতাকে ভুল প্রমাণিত করেননি। তারপর তাঁর কাছে তিনি এক হাজার দিনার পাঠালেন। বললেন, এগুলো নিজের কাজে লাগান। এতিম, বিধবা, আক্রান্ত এবং দারিদ্র্যপীড়িত লোকদের মাঝে বিতরণ করে দিবেন। সামান্য কিছু দিনার তাঁর সহধর্মিণীকে দিলেন। বললেন, এগুলো খরচ করো। এ কথা বলে নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলেন।
হযরত সাঈদ ইবনে আমির রা. শূন্যহাতে মারা গিয়েছিলেন। হিজরী ২০ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। তাঁর আমলনামা ছিল পরিষ্কার। দুনিয়ার ঝক্কিঝামেলা দিয়ে বোঝাই করেননি আমলের যানকে।