যাইনুল আবেদীন আলী ইবনুল হুসাইন رحمة الله عليه (মৃ. ৯৪ হিজরী : ৭১২ খৃস্টাব্দ)

নিজের উষ্ণ উদারতা ও দানশীলতায় যিনি দীনদরিদ্রদের অশ্রু মুছেছিলেন এবং অসহায় মানুষের দুশ্চিন্তা দূরীভূত করেছিলেন। যে কেউ তাঁকে দেখবে তার কাছে মনে হবে তিনি কোন নবীর বংশধর। যাঁর ধমনি ও শিরা-উপশিরায় নবী-রাসূলদের রক্ত প্রবহমান। মন-মানস যেমন পরিচ্ছন্ন, বংশমর্যাদা ও কৌলীন্যেও রয়েছে বনেদি পরিবারের ছাপ। যাঁর দানশীলতা দরিদ্র লোকদের দোআরে দোআরে ঘুরে ফিরেছে। নবী ﷺ-এর বংশের অন্যতম যাহিদ ও দুনিয়াত্যাগী। আলে রাসূলের একজন আখেরাতমুখী বুযূর্গ। তিনি যাইনুল আবেদীন আলী ইবনুল হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবূ তালিব আলহাশেমী। বিশিষ্ট দরবেশ ও মুত্তাকী। সহনশীলতা ও দানশীলতার কিংবদন্তী। নিজের বৈশিষ্ট্যে ও বিশেষণে মানুষের হৃদয়গ্রাহী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। নিজের কাজেকর্মে নয়নকাড়া মানুষ হয়েছিলেন। তিনি ছোট আলী। যাঁর থেকে হযরত হুসাইন রা. এর বংশধারা জারি ছিল। তিনি হুসাইন রা. এর বংশচেরাগ।

তিনি গোপনে দান করার একজন আদর্শ মানব ছিলেন। তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দৈনিক তিনি এক হাজার রাকাত নামায পড়তেন। এই আমল মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। যাঁদেরকে তিনি গোপনে অর্থকড়ি দিতেন মৃত্যুর পর দেখা গেল সেসব পরিবারের সংখ্যা প্রায় একশত। মদীনা বাসীদের বক্তব্য হল, যাইনুল আবেদীনের মৃত্যুর পর গোপন দানের ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে গেছে। ইমাম যুহরী বলেছেন, কুরাইশ বংশের দানশীলদের মধ্যে আলী ইবনুল হুসাইনের মতো উত্তম আর কেউ মারা যায়নি। যাইনুল আবেদীন বলতেন, আল্লাহ তাআলার বন্টন ও ভাগ-বাটোয়ারায় যে লোক সন্তুষ্ট সেই প্রকৃত ধনী। ইমাম যুহরী বলেন, আলী ইবনুল হুসাইন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তিকে আমি দেখিনি। ইমাম মালেক রহ. বলেন, আহলে বাইতে তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ ছিল না। তিনি ছিলেন অনুপম এক আদর্শ ব্যক্তি।

জনৈক ব্যক্তি হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. এর নিকট এসে বলল, অমুক ব্যক্তি অপেক্ষা অন্য কোন পরহেযগার ও মুত্তাকী লোক আমি দেখিনি। ইবনুল মুসায়্যিব মুচকি হাসি দিয়ে লোকটিকে বললেন, আলী ইবনুল হুসাইনকে দেখেছো? লোকটি বলল, না। ইবনুল মুসায়্যিব রহ. বললেন, তাঁর চেয়ে বুযূর্গ ব্যক্তি আমি দেখিনি। তিনি থাকতেন কুফা নগরীতে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, উযুর পর তাঁর চেহারা হলদে বর্ণের হয়ে যেতো। তাঁর শরীরের কম্পন শুরু হয়ে যেতো। কেউ জিজ্ঞেস করলো, হে নবীর বংশধর! উযু করলে আপনার এমন অবস্থা কেন হয়? তিনি বললেন, তোমরা কী জানো আমি কার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি? কার দরবারে কথা বলতে যাচ্ছি?

একদিন এক বাড়িতে অগ্নিকাণ্ড লাগে। যে বাড়িতে আলী ইবনুল হুসাইনও ছিলেন। তখন তিনি সেজদাবনত। লোকজন চেঁচিয়ে বলল, হে রাসূলের বংশধর! আগুন! আগুন! হে রাসূলের বংশধর! আগুন! তিনি কিন্তু সেজদায় পড়ে রইলেন। সেজদা থেকে মাথা উঠালেন না। এক পর্যায়ে আগুনই নিভে গেল। কেউ জিজ্ঞেস করলো, আগুন থেকে কোন্ জিনিস আপনাকে নির্লিপ্ত করলো? বললেন, যখন তাঁর কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে, পরকালের আগুনের চিন্তায় দুনিয়ার আগুনের কথা ভুলে গেছি।

রাতের বেলায় তিনি পিঠে রুটির বস্তা নিয়ে ঘুরতেন। সেগুলো দান করতেন। বলতেন, গোপন সাদাকা পরওয়ারদেগারের রাগ নিভিয়ে দেয়। যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন, লোকজন গোসল দেয়ার সময় দেখে তাঁর পিঠে কালো কালো দাগ। তারা জিজ্ঞেস করলো, এগুলো কীসের চিহ্ন? উত্তরে বলা হল, মদীনার গরীব বাসিন্দাদের জন্য রাতের বেলায় আটার বস্তা পিঠে বহন করার কারণে এসব কালো দাগ সৃষ্টি হয়েছে।

তাঁর আখলাক ও চরিত্র নবী-রাসূলদের চরিত্রের সাথে মিল ছিল। একদিন তিনি মসজিদের বাইরে ছিলেন। মদীনার বহিরাগত এক আগন্তুক লোকের সাথে তাঁর ধাক্কা লেগে যায়। এতে লোকটি যাইনুল আবেদীনকে চিনতে না পেরে গালি দিতে লাগল। অবস্থা দেখে যাইনুল আবেদীনের গোলামরা ক্ষিপ্ত হয়ে লোকটিকে মারতে উদ্যত হল। যাইনুল আবেদীন তাঁদেরকে বারণ করলেন। অতঃপর নম্র ভাষায় ধীরে বললেন, তোমার কোন প্রকার সাহায্যের প্রয়োজন আছে? যাইনুল আবেদীনের এমন আচরণ দেখে লোকটি লজ্জিত হল। নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি তাকে নিজের আলখেল্লাটি দিলেন এবং এক হাজার দিরহাম দেওয়ার জন্য বললেন। লোকটি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে উঠল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি রাসূলের বংশধর।

দারিদ্র্যের চিন্তা না করে দান করতেন। নবী ও রাসূলদের আদব ও শিষ্টাচারের কাছাকাছি তাঁর আদবকায়দা ছিল। তিনি যখন কোন দরিদ্রকে দান করতেন, দান করার আগে সেটা নিজে চুমু খেতেন এরপর দিতেন। একদিন তিনি মুহাম্মাদ ইবনে উসামা ইবনে যায়েদকে দেখতে গেলেন। তখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। শুয়ে শুয়ে তিক্ততার কান্না কাঁদছেন। যাইনুল আবেদীন বললেন, কেমন আছেন? কাঁদছেন কেন? মুহাম্মাদ ইবনে উসামা বললেন, আমার কিছু ঋণ আছে। যাইনুল আবেদীন বললেন, ঋণ কতো? বললেন, পনেরো হাজার দীনার। যাইনুল আবেদীন বললেন, সেগুলো আমি আদায় করে দিবো।

যাইনুল আবেদীন রহ. বলতেন, আমার কাছে লজ্জা লাগে, আল্লাহ তাআলাকে কীভাবে মুখ দেখাবো যে, আমি আমার কোন ভাইয়ের জন্য জান্নাতের দোআ তো করি; কিন্তু দুনিয়ার বিষয়ে কার্পণ্য করি। একবার তিনি হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধলেন। তালবিয়া পড়ার সময় চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। কোন কথাই তিনি বলতে পারছেন না। জিজ্ঞেসিত হলেন, তালবিয়া পড়ছেন না কেন? বললেন, তখন তাঁর গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি ঝরছে, আমার আশঙ্কা হয়, আমি বলবো লাব্বাইক (অর্থাৎ পরওয়ারদেগার, আমি একদম তোমার দরবারে দেহমনে হাজির), আর ওপার প্রান্ত হতে বলবে, না, তোমার লাব্বাইক গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি লাব্বাইক বলতে না বলতেই বেহুঁশ হয়ে বাহন থেকে পড়ে গেলেন। এই অবস্থায় থেকে পুরো হজ্জ্ব আদায় করলেন।

যাইনুল আবেদীন রহ. মৃত্যুশয্যায় ঘুমালেন। কাঁদলেন। চোখের পানি ঝরছে। তাঁর ছেলে বলল, বাবা কাঁদছেন কেন? বললেন, বৎস! কেয়ামত দিবসে কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা থাকবে না এবং প্রেরিত কোন নবীও থাকবে না। সেদিন স্রেফ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা থাকবে। তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। যাকে ইচ্ছা মাফ করে দিবেন। এ কথা বলে তিনি দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। হিজরী ৯৪ সালে তিনি মারা যান। জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে সমাহিত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it