মুতাররিফ ইবনে শিখ্খীর رحمة الله عليه (মৃ. ৮৭ হিজরী : ৭০৬ খৃস্টাব্দ)
যাঁর হাতে বেত তাসবীহ পাঠ করেছে। চেয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী নেয়ামত। মৃত্যুর আগে নিজের কবরে কুরআন খতম করেছিলেন। যাঁর তাকওয়ার পদতলে দুনিয়া বিভিন্ন রূপে ঘুরঘুর করেছিল। যাঁর চোখে যাবতীয় লজ্জত ও মজা ছিল মরীচিকা ও বৃথা আশার ছলনা। যাঁর ছিল অসংখ্য লোকাতীত ঘটনা। তিনি ছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাআলা যাঁকে দিয়েছিলেন ঈমান ও প্রতিভা। তিনি মুতাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে শিখ্খীর আলহারাশী আলআমেরী। আবূ আব্দুল্লাহ্। শীর্ষ তাবেঈদের একজন বুযূর্গ তাবেঈ। মহানবী ﷺ-এর যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বসরা নগরীতে কাটিয়েছিলেন জীবনকাল। আল্লাহ তাআলার যিকির করতেন বেশি বেশি। অতি বিনয়ী ছিলেন। নিজের জীবনকে কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখতেন। হৃদয়-বিগলিত ব্যক্তি। অন্তর থাকতো প্রাণবন্ত যিকিরে।
আল্লাহ তাআলার ভালোবাসায় মজে থাকতেন। নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করতেন। তিনি বলতেন, যে কেউ কখনও আমাকে প্রশংসা করেছে এতে আমার কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়েছে। একবার তিনি হজ্জ্বে গিয়েছিলেন। আরাফাহ ময়দানে তিনি অতি বিনয়ে সাথে দু’হাত তুলে দোআ করতে লাগলেন। হৃদয়ের গহিনে আবেগী কণ্ঠে বলতে লাগলেন, মাবুদ, আমার কারণে গোটা ময়দানের লোকদেরকে ফিরিয়ে দিবেন না।
দুনিয়াটা নিজের কাছে এক পয়সা পরিমাণ মূল্যবান মনে হতো না। গোটা পৃথিবী তার কাছে মাছির ডানার মূল্যও রাখতো না। একদিন তিনি নিজের বন্ধু-বান্ধবের কাছে ভঙ্গুর দুনিয়ার আসল রূপের কথা বলতে গিয়ে বললেন, গোটা পৃথিবীটা যদি আমার হতো। আল্লাহ তাআলা যদি আমার মালিকানা সেই দুনিয়া মাত্র এক ঢোঁক পানির বিনিময়ে গ্রহণ করেন যে পানির ঢোঁক তিনি আমাকে কেয়ামত দিবসে পান করাবেন, তাহলেও মনে করবো তিনি দুনিয়ার মূল্য দিয়েছেন।
মুতাররিফ রহ. পশমের মোটা কাপড় পরিধান করতেন। গরীব-অসহায় লোকদের সাথে উঠাবসা করতেন। এ বিষয়ে কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বলেন, আমার বাবা একজন প্রভাবশালী ছিলেন। আমার একান্ত মনের ইচ্ছা, আমি আমার পরওয়ারদেগারের সামনে বিনয়ী হই।
মৃত্যু ছিল তাঁর প্রধান কাঙ্ক্ষিত বিষয়। পানাহার ও কাপড়চোপড় নিয়ে কখনও আরাম-আয়েশ করেননি। তিনি বলতেন, এই মৃত্যু বিলাসী মানুষের বিলাসিতা শেষ করে দিয়েছে। এমন নেয়ামত খোঁজ কর যা অবিনশ্বর, যা কখনও শেষ হওয়ার নয়।
একবার জনৈক ব্যক্তি কোন কিছু চেয়ে তাঁর কাছে আসলো। মুতাররিফ রহ. দয়ামিশ্রিত ভাষায় বললেন, তোমার প্রয়োজন হলে আমাকে সে ব্যাপারে কথা বলার দরকার নেই। তুমি শুধু একটু লিখে দিলেই হবে। চিরকুটটা আমার কাছে পাঠিয়ে দিলে চলবে। তোমার চেহারায় ভিক্ষার কদর্য রূপ দেখতে আমার বড় খারাপ লাগে। তিনি দোআ করতেন। তাঁর দোআ কখনও ব্যর্থ হতো না। আকাশের হৃদয়কাঁপা কণ্ঠে দোআ করতেন। কাকুতি মিনতি করে দোআ করা শুরু করলে তা কবুল হতো। একবার মুতাররিফ ও এক ব্যক্তির সামনে একটি কিছু ছিল। লোকটি মুতাররিফের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দিলো। অনেক নাহক কথা বলল। মুতাররিফ দু’হাত আকাশের পানে তুলে মজলুমের ভাঙাহৃদয়ে বলতে লাগলেন, তুমি মিথ্যুক হলে আল্লাহ তাআলা তোমার জীবনের লীলাখেলা এ মুহূর্তে শেষ করে দিন। আশ্চর্য! লোকটি সাথে সাথে সেখানে মরে গেল। অকুস্থলেই সে অক্কা পেল।
মুতাররিফ লোকাতীত ঘটনাবলী অনেক এবং সুবিদিত। সেগুলো ছিল তাঁর পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের কারণে। একবার তিনি ও তাঁর ভাতিজা রাতের আঁধারে গমনকালে হাতের ছড়ি আলো দিতে লাগে এবং তা হতে তাসবীহ পড়ার আওয়াজ শোনা যায়। তিনি বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথে বাড়ির পাত্র ও তৈজসপত্র তাসবীহ পড়তো। যখন তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং হাত-পা অবশ হয়ে আসে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের যে বিষয় তোমার সিদ্ধান্ত তা মনোনীত করে দাও। এরপর আশেপাশের লোকজনকে বলল, আমাকে কবরে নিয়ে যাও। মৃত্যুর আগে কবর শোয়ে শোয়ে কুরআন শরীফ এক খতম করে। হিজরী ৮৭ সালে ইরাকে প্রাদুর্ভূত মহাগ্রাসী মহামারীর পর হাজ্জাজের শাসনকালে তিনি মারা যান। বসরা শহরে সমাহিত হন।