মানসূর ইবনে আম্মার রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ২২৫ হিজরী : ৮৪০ খৃস্টাব্দ)
যাঁর কথায় আকাশ অশ্রুপাত করেছে। জননীর দুগ্ধপানের সাথে যুহ্দ ও কোমলতা ছিল যাঁর অনুপান। নামায ও সিয়ামসাধনার জন্য যাঁর হায়াত ও জীবনকাল উৎসর্গিত। দেশ বিদেশ ঘুরে ওয়ায-নসিহত করতেন। তাকওয়া ও আনুগত্য বিষয়ে লোকজনকে অনুপ্রাণিত করতেন। নাফরমানি এবং দুনিয়ামুখিতার পরিণতিতে আল্লাহ তাআলার দূরত্ব সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতেন। তিনি মানসূর ইবনে আম্মার, আবুস সারা। সালমী আলখুরাসানী। যাহিদ, দুনিয়াত্যাগী, মুত্তাকী, অতুলনীয় এক মনীষী। যার ওয়াযে হৃদয়ের দোআরে কড়া নাড়ে। তার কথা শোনার জন্য লোকজন চারদিকে জড়ো হতো। কোমল-মধুর ছিল তার কথাবার্তা। কণ্ঠস্বরে ছিল বলিষ্ঠতা। যুহদ ও খোদাভীতিতে হৃদয়-সায়র টইটুম্বর ছিল।
মানসূর ইবনে আম্মার সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলে গেলেন মিসরে। খোদায়ী রহমতের আশায় তিনি বলীয়ান। প্রবেশ করলেন মিসর দেশে, যেখানে দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি জেঁকে বসেছিল। জান-মাল সমূলে শেষ করে দেওয়া ছিল সেই আকালের প্রধান টার্গেট। মসজিদে জুমার নামায শেষে লোকজনের কান্নার আওয়াজে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠল। প্রার্থনার হাতগুলো রোনাজারিতে সম্প্রসারিত হল। এমন সময় প্রশান্তচিত্তে মানসূর ইবনে আম্মার দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন। মসজিদ চত্বরের মাঝে আসলেন। আল্লাহ তাআলার হামদ-সানা এবং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠ করতে রইলেন। এরপর বললেন, হে মানুষ! দান-সাদাকা করে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভে এগিয়ে আসো। দান-সাদাকা করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম পন্থা। এ কথা বলে নিজের গায়ের চাদর খুলে ফেললেন। বললেন, এটা আমার শেষ চেষ্টা। এখন তোমরা তোমাদের সাধ্যমতো দান-সাদাকা কর।
লোকজন দান-সাদাকা করতে লাগলো। সবাই দান করলো। এমনকি মহিলারা তারা তাদের গহনা-গাঁটি খুলে দান করতে লাগলো। এক পর্যায়ে দান-সাদাকায় চাদর ভরে গেল। আকাশ থেকে বৃষ্টি নামল। লোকজন মসজিদ থেকে বের হল তখন রাস্তাঘাট কাদামাটিতে ভরে গেল। মানসূর ইবনে আম্মার রহ. এর নিকট দু’জন লোক আসলো। তারা বলল, শাইখ লাইস আপনাকে স্মরণ করেছেন। তিনি লাইসের নিকট গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, মসজিদে আপনি কথা বলেছিলেন? মানসূর ইবনে আম্মার রহ. বললেন, হাঁ। লাইস রহ. বললেন, যে কথাগুলো মসজিদে বলেছিলেন সেগুলো আমাকে একটু শোনান। শাইখ মানসূর সেগুলো তাকে শোনালেন। ওয়াযের কথা বললেন। কথা শোনে লাইস কাঁদলেন। উচ্চস্বরে কাঁদলেন।
মানসূর ইবনে আম্মার মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া গেলেন। তিনি সেখানের দুর্গে হাঁটছিলেন। এমন সময় এক লোক অপাঙ্গে তাকিয়ে বলল, ব্যাপার কী? জুমার দিন আপনিই কথা বলেছিলেন? তিনি বললেন, হাঁ। লোকটি বলল, তাহলে তো এখানে সমস্যা বেধে গেছে। মানুষ বলতে শুরু করেছে যে, হযরত খাজা খিযির দোআ করেছেন তাই দোআ কবুল হয়েছে। তার মুখম-লে দুঃখের ছাপ, তিনি বললেন, না। আমিই সেই গুনাহগার বান্দা।
শাইখ মানসূর ইবনে আম্মার রহ. বাদশাহ হারূনুর রশীদের দরবারে গেলেন। ওয়ায করে কাঁদালেন। হারূনুর রশীদ বললেন, এসব ওয়ায কোথা থেকে লাভ করেছেন? মানসূর বললেন, স্বপ্নযোগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার মুখে থুথু দিয়েছেন। তাঁর মুখের পানির বরকত!! তিনি আমাকে বলেছেন, মানসূর! বলো!!
একবার মানসূর হাজীদের কাফেলা নিয়ে চলেছেন। রাত নেমে আসল। অন্ধকার ছেয়ে গেলো। তিনি নামাযের প্রস্তুতি নিয়ে বের হলেন। হঠাৎ আকাশ বাতাস ভারী করা একটি চিৎকার, কান্নার রোল। মাবুদ! তোমার ইজ্জতের কসম! গুনাহ করে তোমার বিরোধিতা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। পাপ করেছি কিন্তু তোমার আযাব সম্পর্কে আমি অজ্ঞ নই। তারপরও একটি গুনাহ! যা আমাকে দিয়ে করিয়েছে আমার দুর্ভাগ্য। তোমার পর্দা আমাকে ভুলিয়েছে। এখন আমাকে কে উদ্ধার করবে? রেহাই কে দিবে?
মানসূর ইবনে আম্মার রহ. উচ্চস্বরে এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, (অনুবাদ) ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে রক্ষা কর। যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর।’ (সূরা তাহরীম, আয়াত : ৬)। আয়াতটি তেলাওয়াত শেষ না হতেই মানসূর মাটিতে কোন কিছু পড়ার শব্দ পেলেন।
সকালে দেখা গেল, সেখানে একটি মৃত লোক পড়ে আছে। একজন বৃদ্ধ মহিলা, যিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, বলছেন, গতরাতে এখানে এক লোক একটি আয়াত তেলাওয়াত করেই মরে গেল। হিজরী ২২৫ সালের দিকে তিনি মারা যান।