ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১১৪ হিজরী : ৭৩২ খৃস্টাব্দ)

যাঁর প্রজ্ঞা ও হিকমতের অসি খায়েশ ও প্রবৃত্তিকে ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে। মহামনীষীদের মাঝে যিনি একজন যাহিদ। যাঁর ছায়া দেখে শয়তানও ভীত। টানা চল্লিশ বছর ধরে যিনি ইশার উযূ দিয়ে ফজরের নামায আদায় করেছিলেন। নিজের খায়েশ ও মন-চাওয়া বিষয়গুলো পদদলিত করেছিলেন। যাঁর আওয়াজ হৃদয়ের চাবিকাঠি। তিনি ওহাব বিন মুনাব্বিহ ইবনে কামিল আস্সানআনী। যাদেরকে পারস্যের বাদশাহ ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন তিনি তাদেরই বংশোদ্ভূত।হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. এর শাসনামলে সানা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। আহলে কিতাব তথা ইহূদী ও খ্রিস্টানদের কিতাবাদি পড়েন। তাদের বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তিনি বিখ্যাত তাবেঈ। ইবাদত ও দুনিয়াবিমুখিতায় যিনি খ্যাতি লাভ করেন। যার মুখ থেকে নিঃসৃত হতো হিকমত ও প্রজ্ঞার কথা। হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. যাঁকে সানা নগরীর বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

জবান অতি মার্জিত ছিল। ভাষা ছিল পরিশীলিত। কাউকে গালি দিতেন না। শয্যায় বিশ্রাম নিতেন না। স্বপ্নে কোন কিছু দেখলে ঊষার ন্যায় সত্যে পরিণত হতো। তিনি লোকদেরকে ওয়াজ-নসিহত করতেন। হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলো বেশ উদ্দীপ্ত ছিল। মন ছুঁয়ে যেতো। খায়েশ ও মন-চাওয়া বিষয়গুলো জবানের ঝাঁজে দগ্ধ হয়ে যেতো। তিনি লোকদের মাঝে বসে তারস্বরে বলতেন, যে ব্যক্তি নিজের খায়েশ ও প্রবৃত্তিকে নিজের পায়ের নীচে দাফন করতে পারবে শয়তান তার ছায়া দেখেও ভয় পাবে।

বুদ্ধির পরিপক্বতা আর বিনয়ের অপূর্ব সমন্বয় তাঁর মাঝে ছিল। আত্মপ্রতারণার নিগড় থেকে বেরিয়ে স্বল্পতার ময়দানে উত্তীর্ণ হয়ে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সস্তা প্রশংসা কুড়ানো তাঁর ধাতে ছিল না। তাঁর সঙ্গী-সাথী যখন চারপাশে বসতো তিনি তাদের শ্রুতিমধুর কথা বলতেন। তিনি বলতেন, কেউ যখন তোমার মাঝে যে গুণ নেই সেই গুণ নিয়ে প্রশংসা করবে তাহলে তুমি তাকে নিরাপদ মনে কর না যে, যে দোষ তোমার মাঝে নেই সেই দোষ দিয়ে তোমাকে নিন্দা করবে।

যখন কেউ তাঁর প্রশংসা করতো এবং তাঁর মর্যাদার কথা লোকদের মাঝে ফলাও প্রচার করতো, তিনি দ্রুত বলতেন, আমি আমার আখলাক তলিয়ে দেখি; কিন্তু মোহিত করার মতো কোন কিছু তো খুঁজে পাই না। একদিন তিনি তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে রাত যাপন করেন। রাতের বেলায় ওহাব বিন মুনাব্বিহ নিজের ওযীফা আদায় করতে লাগেন। যিকিরের গুঞ্জনে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যেতে লাগলো। বাড়িওয়ালা জেগে গেল। চেয়ে দেখে ওহাব বিন মুনাব্বিহ যিকিরে মশগুল। চারপাশে জ্যোতির একটি বৃত্ত তাঁকে ঘিরে আছে। ছায়াময় সেই নূরের মাঝে তিনি অবস্থান করছেন। সকাল বেলায় মেজবান হযরত ওহাব বিন মুনাব্বিহ রহ.-কে বলল, গত রাতে দেখলাম, আপনার চারপাশে নূরের বেষ্টনী। মনে হল আকাশ থেকে নেমে আসা একটি চেরাগ। এ কথা শোনে ওহাব বিন মুনাব্বিহ রহ. মাথা ঝুঁকিয়ে রাখলেন। অতি বিনয় ও আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, আপনি দেখে ফেলেছেন!!

হযরত ওহাব বিন মুনাব্বিহ রহ. বসে আছেন। লোকদেরকে ওয়াজ-নসিহত করছেন। নানা রকম কথাবার্তা বলছেন। এমন সময় এক লোক এসে চিৎকার দিয়ে বলল, হে ওহাব বিন মুনাব্বিহ! আপনি এমন এক লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করেছেন যে আপনাকে গালি দিচ্ছে এবং খিস্তিখেউর করছে। এ কথা শোনে তাঁর চেহারায় বিবর্ণ রঙ ধারণ করলো। খুব রেগে গেলেন। লোকটির দিকে করুণা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, শয়তান কি দূতিয়ালির জন্য তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে পায়নি? তিনি আর সেই মজলিস থেকে উঠেননি। যে লোকটি গালি দিয়েছিল সেই এসেছে। লোকটি এসে সালাম দিল। ওহাব বিন মুনাব্বিহ রহ. হাসিমুখে সালামের উত্তর দিলেন। মুসাফাহা করলেন এবং নিজের পাশে বসতে দিলেন।

ওহাব বিন মুনাব্বিহ রহ. এর নিকট একের পর এক সংবাদ আসতে লাগলো যে, আতা খুরাসানী রহ. রাজা-বাদশাহদের দরবারে আগমন করেন। পরবর্তীতে আতা খুরাসানীর সাথে যখন হযরত ওহাব বিন মুনাব্বিহ রহ. এর সাথে দেখা হল, তিনি অতি মায়াস্বরে উপদেশ দিলেন। বললেন, আতা, অনেক দুঃখের সংবাদ। জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার ইলম ও বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়ে রাজা-বাদশাহ এবং দুনিয়ার সন্তানদের দোআরে দোআরে ঘুরে ফিরছো। ওহে আতা! কত ক্ষতির কথা! তুমি ধরনা দিচ্ছো এমন এক দরবারের, যে দরবারের গেইট তোমার জন্য বন্ধ। যে দরবারে তোমার জন্য দারিদ্র্য প্রকাশ করে এবং প্রাচুর্য লুকিয়ে রাখে। ওহে আতা! কী সর্বনাশা কথা! তুমি বাদ দিচ্ছো এমন এক দরবার, যে দরবারের গেইট তোমার জন্য সর্বদা খোলা। যে দরবারের নিত্য ডাক, আমি দিতে প্রস্তুত। প্রাচুর্যও আছে দিতেও কার্পণ্য নেই। (তোমরা আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। সূরা মুমিন, আয়াত: ৬০)

ওহে আতা! কী দুর্ভোগ তোমার! তোমার জন্য যা যথেষ্ট তাই তোমার জন্য প্রাচুর্যময়। দুনিয়ায় প্রাচুর্য তোমার জন্য যথেষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ যদি তোমার মাঝে প্রাণপ্রাচুর্য না এনে দেয় তাহলে দুনিয়ার কোন কিছু নেই যা তোমার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।

জন্মভূমি সানা নগরীতে হিজরী ১১৪ সালে ওহাব বিন মুনাব্বিহ রহ. ইন্তেকাল করেন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it