উয়াইস কারনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ৩৭ হিজরী : ৬৫৭ খৃস্টাব্দ)

মুখমণ্ডল ছিল কালো। বংশীয় কৌলিন্য বলতে কোন কিছুই ছিল না। লোকসমাজে অখ্যাত ও গুরুত্বহীন এক ব্যক্তি। এসব কিছু সত্ত্বেও ইতিহাস তাঁর নামটি মনীষী ও মহান ব্যক্তিদের সারিতে লিপিবদ্ধ করেছে। পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দাদের নিকট তিনি অজ্ঞাত। কিন্তু আকাশবাসীদের নিকট খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুস্মরণ যাঁকে আনন্দ দেয়নি। মহানবী ﷺ যাঁর প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলেন ওহীর স্মৃতিতে। যে লোকটি দোআর হাতে ধুয়েছিলেন পাপরাশি। তিনি উয়াইস ইবনে আমির ইবনে জায্ ইবনে মালিক আলকারনী। আটজন বিখ্যাত বুযূর্গদের তিনি একজন। প্রবীণ দরবেশ শ্রেণির তিনি অন্যতম। শীর্ষ তাবেঈদের মাঝে তিনি উল্লেখযোগ্য। ইয়েমেন বংশোদ্ভূত। গাঁও-গেরামে থাকতেন। ধুলোবালিতে বসবাস। যাযাবরি জীবন। মহানবী ﷺ-এর জীবদ্দশায় যিনি দুনিয়ার বুকে অবস্থান করেছিলেন। মায়ের সেবা আর মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে নবীজীর দরবারে হাজির হতে পারেননি। প্রিয়নবী ﷺ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন কিন্তু দেখতে পেলেন না তাঁকে। পরবর্তীতে মদীনায় আসেন কাফেলা নিয়ে।

পরিবারের লোকজন তাঁকে পাগল মনে করতো। তারা উয়াইস কারনীর জন্য বাড়ির গেইটের কাছে একটি ঘর বানিয়ে দিয়েছিল। বছর কি বছর সেখানে কাউকে দেখা যেতো না। কুড়িয়ে পাওয়া খেজুরের আঁটি বিক্রি করতেন। সামান্য খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। সবকিছুতে যুহদ ছিল। নিজের দায়িত্ব থেকে জাগতিক ধুলোবালি ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। সর্বদা পরকালের আগ্রহে থাকতেন। মহানবী ﷺ সাহাবা কেরামের নিকট উওয়াইস কারনীর বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি তাঁর মর্যাদার কথা বলেছেন, (অনুবাদ) উওয়াইস কারনী নামের লোকটি শ্রেষ্ঠ তাবেঈ। তাঁর মা রয়েছে। লোকটির শ্বেত রোগ রয়েছে। তোমাদের কারও সাথে তাঁর দেখা হলে সে যেন তোমাদের জন্য দোআ চায়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৫৪২)

মহানবী ﷺ-এর পবিত্র মুখ থেকে এই বাণী বের হওয়ামাত্রই কথাটি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর হৃদয়পটে বদ্ধমূল হয়ে যায়। তখন থেকে ইয়েমেন থেকে যখনই কোন কাফেলা মদীনা আসতো তখনই হযরত উমর রা. তাদের জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের মধ্যে উওয়াইস ইবনে আমির নামের কেউ আছে? একবার ঠিকই উওয়াইস কারনী মদীনা আগমন করলেন। হযরত উমর রা. বললেন, আপনি কি উওয়াইস ইবনে আমির? তিনি বললেন, হাঁ। উমর রা. বললেন, আপনার কি শ্বেত রোগ ছিল যা এখন প্রায় ভাল? উওয়াইস কারনী বললেন, হাঁ। উমর রা. বললেন, আপনার মা আছে? তিনি বললেন, হাঁ। হযরত উমর রা. বললেন, মহানবী ﷺ-কে বলতে শোনেছি যে, ইয়েমেন থেকে তোমাদের নিকট একটা কাফেলা আসবে। তাঁদের মধ্যে উওয়াইস ইবনে আমির আলকারনীও থাকবে। তাঁর শ্বেত রোগ ছিল যা পরবর্তীতে প্রায় সেরে গিয়েছিল। তাঁর মা রয়েছে, যাঁর সাথে উওয়াইস কারনী সদ্ব্যবহার করতো। লোকটি যদি আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে কসম খেয়ে বলে সেটি বাস্তবে রূপান্তরিত হবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। তোমরা যদি পারো তাহলে তাঁকে দিয়ে নিজের জন্য দোআ চেয়ে নিবে। এরপর উমর রা. দোআ চান। তিনি হযরত উমর রা.-এর জন্য দোআ করেন। হযরত উমর রা. বললেন, কোথায় যাবেন? বললেন, কুফা নগরী। উমর রা. বললেন, আপনার জন্য সামান্য উপঢৌকনের কথা গভর্নরকে লিখে দিবো? উওয়াইস করনী রহ. বললেন, অসহায় ও দুর্বল মানুষের মাঝে গণ্য হতে অধিক পছন্দনীয়।

পরবর্তী বছর উওয়াইস করনীর গোত্রের জনৈক লোক হজ্জ্ব করতে আসে। লোকটি হযরত উমর রা. এর নিকট আসলে তিনি উওয়াইস করনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, উওয়াইস করনীকে কেমন দেখে আসলে? লোকটি বলল, খুব টানাটানির মাঝে দিনাতিপাত করছে। বাড়ি-ঘর ভাঙাচুরা, সহায়-সম্পত্তি কম। তখন লোকটির কাছে হযরত উমর রা. মহানবী ﷺ-এর হাদীস শরীফ শোনালেন। লোকটি কুফা শহরে এসে হযরত উওয়াইস করনীর নিকট আসে। তাঁকে চুমু খেয়ে তাঁর প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অশ্রুসিক্ত নয়নে বলতে লাগে, আমার জন্য মাগফেরাত করুন। উওয়াইস করনী বললেন, তুমি সাম্প্রতিক সময়ে মোবারক সফর করে এসেছো। হারামাইন শরীফাইন যিয়ারত করে এসেছো। বরং তুমি আমার জন্য মাগফেরাত কর। তারপর উওয়াইস করনী জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথে কি হযরত উমর রা.-এর সাক্ষাত হয়েছে? লোকটি বলল, হাঁ, দেখা হয়েছে। তিনি আমার জন্য মাগফেরাতের দোআ করেছেন। এবার আপনি আমার জন্য মাগফেরাতের দোআ করুন। উওয়াইস করনী রহ. বললেন, আমি তোমার জন্য দোআ করব এই শর্তে যে, আগামীতে এমন কাজে আমাকে আর তুমি বাধ্য করবে না এবং আমার ব্যাপারে হযরত উমর রা. এর মুখে যে কথা শুনেছো সে কথা আর কারো নিকট বলতে পারবে না। লোকটি বলল, ঠিক আছে। এরপর উওয়াইস করনী রহ. লোকটির জন্য মাগফেরাতের দোআ করলেন। পরবর্তীতে সে ঘটনা কুফা নগরীতে ফাঁস হয়ে যায়। হযরত উওয়াইস করনী রহ. সম্পর্কে মহানবী ﷺ-এর বাণী কুফা নগরীর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন বানের গতিতে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করে। নিজেদের জন্য মাগফেরাতের দোআ করিয়ে নিতে আঁতিপাঁতি করে অনুসন্ধান করতে থাকে উওয়াইস করনীকে। উদ্ভ্রান্ত হয়ে খুঁজে কেউ তাঁর সন্ধান পেল না।

তাঁর হৃদয়গ্রাহী কথায় জাদুর মতো আকর্ষণ ছিল। আসীর ইবনে জাবির বলেন, উওয়াইসের কথা হৃদয়ে রেখাপাত করতো। আমি তাঁকে খোঁজে বের হলাম। তাঁর গোত্রের জনৈক ব্যক্তি বলল, হাঁ আমি তাঁকে চিনি। আমি বললাম, তুমি তাঁর বাড়ি চিনো? সে বলল, হাঁ। সে আমাকে নিয়ে গেল একটা ছোট কামরার নিকট। সেখান থেকে তিনি বের হলেন। আমি বললাম, ভাইজান, আপনি কেন বের হন না? উওয়াইস করনী বললেন, পরিধেয় কাপড়ের স্বল্পতার দরুন আমি বের হচ্ছি না। তিনি তাঁকে একটি চাদর দিলেন।

উওয়াইস করনী নিজের পরিধেয় কাপড় দান করে দিতেন। কখনও জুমার নামাযে শরীক হওয়ার মতো সুন্দর কাপড় থাকতো না। মাটি থেকে রুটির টুকরা কুড়িয়ে নিতেন। অর্ধেক আহার করতেন এবং বাকি অর্ধেক দান করে দিতেন।

এমন দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও রাতের আঁধারে, রজনীর তিমিরে রাজ্য ছেয়ে গেলে তিনি রোনাজারি করতেন। আকাশের দিকে তুলে ধরতেন দু’হাত। কায়মনোবাক্যে দোআ করতেন, পরওয়ারদেগার! আজ আমি তোমার কাছে মিনতি করে ওজরখাহি করছি এবং কৈফিয়ত দিচ্ছি ক্ষুধার্ত জঠর থেকে। আমার জঠরের আহার্য ছাড়া আর কোন খাবার আমার বাড়িতে নেই। আমার গায়ের পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত আর কোন কাপড় আমার নেই।

হারিম ইবনে হাইয়্যান গেলেন উওয়াইস করনীর নিকট। বললেন, আমাকে উপদেশ করুন। উওয়াইস করনী বললেন, শোয়ার সময় মৃত্যুকে বালিশ বানিয়ে নাও। ঘুম থেকে ওঠে আল্লাহ তাআলার নিকট দোআ কর তিনি যেন তোমার হৃদয় ও নিয়ত পরিশুদ্ধ করে দেন।

তাঁর জীবনের শ্লোগান ছিল, সত্যের জন্য ঝুঁকি গ্রহণ কর। বাতিলের সাথে বাগানে বিচরণ কর না। এজন্য দেখা গেছে, যেখানে সত্য দেখেছেন সেটার জন্য লালায়িত হয়েছেন। সিফ্ফীন যুদ্ধের দামামা যখন বেজে ওঠল এবং উভয় পক্ষ হাতিয়ার নিয়ে সম্মুখে অবতীর্ণ তখন হযরত আলী রা. এর বাহিনীকে লক্ষ্য করে সিরিয়া অধিবাসী জনৈক লোক বলে ওঠল, তোমাদের মাঝে কি উওয়াইস করনী আছেন? তারা বলল, হাঁ আছেন। তুমি কী চাও? লোকটি বলল, আমি মহানবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, উওয়াইস করনী শ্রেষ্ঠ তাবেঈদের একজন আন্তরিক তাবেঈ। এ কথা বলে মুয়াবিয়া রা. এর দলছেড়ে হযরত আলী রা. এর বাহিনীতে যোগদান করেন।

মৃত্যুস্মরণে তাঁর আনন্দ-বিনোদন বিদায় নিয়েছিল। মনে ছিল না কোন খুশি। সারাটা জীবন ভয়তরাসে ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় কাটিয়েছেন। এক ব্যক্তি হযরত উওয়াইস করনীকে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন? তিনি বললেন, ভালো আছি। আলহামদুলিল্লাহ্। সময় কেমন যাচ্ছে? উওয়াইস করনী বললেন, সেই ব্যক্তির সময় আর কেমন যাবে যার সকালে মনে হয় সন্ধ্যার আগে দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে। সন্ধ্যায় মনে হয় আর বুঝি সকালে উপনীত হওয়া যাবে না। সে তো জান্নাতের সুসংবাদ বা জাহান্নামে দুঃসংবাদের মাঝে দিনাতিপাত করছে। ভাই! মৃত্যু ও মৃত্যুস্মরণ মুমিনকে আনন্দিত হতে দেয় না।

হযরত উওয়াইস করনীর অনেক কারামাত আছে। সেসব লোকাতীত ঘটনা গালগল্পের মতো মনে হয়। অলৌকিক বিষয়াদির অনেকগুলো জীবদ্দশায় আবার অনেকগুলো মরণের পর ঘটেছিল। আব্দুল্লাহ্ ইবনে সালামা ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন, আমরা আযারবাইজান সমর অভিযানে বের হলাম। সাথে অনেকের মতো হযরত উওয়াইস করনীও আছেন। পথিমধ্যে উওয়াইস করনী অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা তাঁকে তুলে নিয়ে বহন করে চললাম। এরই মধ্যে তিনি মারা গেলেন। আমরা নামলাম। হঠাৎ দেখি, তাঁর কবর প্রস্তুত খনিত। পাত্রে পানি ঢালা। সেখানে কাফরের কাপড় পর্যন্ত তৈরী। আমরা গোসল দিয়ে কাফনের কাপড় পড়ালাম। জানাযার নামায পড়িয়ে দাফন দিয়ে ফেললাম। আমাদের কেউ কেউ এক জন অন্যকে বলল, চলো তাঁর সমাধি যিয়ারত করে আসি। মাগফেরাতের দোআও চেয়ে আসবো। ফিরে এসে দেখি, কোন কবর নেই এমনকি কবরের চিহ্নও নেই। মতান্তরে তিনি সিফ্ফিন যুদ্ধে মারা যান।