ইমাম আবূ হানীফা নো’মান রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৫০ হিজরী : ৭৬৭ খৃস্টাব্দ)

সকল ফকীহ তাঁর ফিক্হের নিকট মুহতাজ। সবাইকে তাঁর কাছে দ্বারস্থ হতে হয়েছে। ফিকহশাস্ত্রের ইমাম ও প্রাণপুরুষ। তাকওয়ার জগতের তিনি এক আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তি। ইসলামী আইন ও ফিকহের তিনিই অগ্রপথিক। সুপ্ত মণিমাণিক্যের সন্ধানে তিনিই প্রথম বীরডুবুরী। ফিকহী আকরিক সম্পদ আহরণে তিনিই পথিকৃৎ, তিনিই আবিষ্কারক।
ইলম ও জ্ঞানের সায়রে তিনি সন্তরণ করেছিলেন। মাসায়িল ও সমস্যা সমাধানে ইসলামী নির্দেশনা লাভে সর্বাত্মক ও গলদ্ঘর্ম পরিশ্রম করেছিলেন। বিক্ষুব্ধ তরঙ্গায়িত মাসায়িলের ঢেউ উতরিয়ে উঠতে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মাসায়িলের অতলান্ত প্রান্তরে বিচরণ করে ফিকহের দুরূহ ও সারাংশ বিষয়াবলী লাভ করতে পেরেছিলেন। তিনি নু’মান বিন সাবিত। জ্ঞানশহরখ্যাত কুফা নগরীর অধিবাসী। ইমাম চতুষ্টয়ের তিনিই প্রধান। অনুজ ও কম বয়সের সাহাবা কেরামের জীবদ্দশায় যাঁর জন্ম। ইলমের ভালোবাসায় যাঁর পরান পুড়ে দগ্ধ। ইলমের সন্ধানে যিনি ঘুরে ফিরেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত। সর্বত্র বিচরণ করে দেখা মেলে উম্মতের বাঘা বাঘা আলেমদের সাথে। সংগ্রহ করেন মহামনীষীদের ইলমী রতœ। অবশেষে তিনিই ওঠেন ইসলামী ফিক্হশাস্ত্রের শেষ কথা।
শারীরিক অবয়বে ছিল সৌন্দর্য। গায়ের রং ছিল ফর্সা। দেখতে সুদর্শন। কথায় ভারি সুমিষ্ট। ব্যক্তিত্ব জুড়ে অনুপম, কথায় তিনি সুভাষী। মাঝারি গড়নের এক মানুষ। কাপড় বিক্রি করতেন আর ইলম হাসিল করতেন। কাপড়বিক্রেতা হয়েও তিনি তালিবুল ইলম। পরিপক্ব জ্ঞান লাভ করে যখন তিনি বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠলেন ব্যবসা ছেড়ে আত্মনিয়োগ করলেন শিক্ষাদানে। পরিণত হন জ্ঞানের এক মহীরূহে।
নিজের প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী, কথার মাঝে কখনও ‌আল্লাহ তাআলার নামে কসম খেলে তিনি (কাফফারা হিসেবে) এক দিরহাম দান করতেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুবারক রহ. নিজের গল্প বর্ণনা করেছেন, আমি কুফা নগরীতে প্রবেশ লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকহ বিশারদ কে? আমাকে বলা হল, আবূ হানীফা। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, এই শহরের সবচেয়ে বড় বুযর্গ ও যাহিদ কে? লোকজন বলল, আবূ হানীফা। আমি আবার জানতে চাইলাম, এই লোকালয়ের সর্বোচ্চ মুত্তাকী কে? এবারও আমাকে লোকজন জানালো, সেই মহান ব্যক্তি হলেন আবূ হানীফা।
ইয়াযীদ বিন হারূন বলেন, আবূ হানীফার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, চৌকস, চোখা, মর্যাদাবান এবং বুযর্গ ও মুত্তাকী আমি আর দেখিনি। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুবারক রহ. হযরত সুফইয়ান সাওরী রহ.কে শুধালেন, হে আবূ আব্দুল্লাহ্! কোন্ জিনিস আবূ হানীফাকে গীবত ও পরনিন্দা থেকে দূরে রেখেছে? কারণ আমি কখনও তাকে নিজের দুশমনকে নিন্দা করতে শুনিনি। নিজের শত্রুকে দোষারোপ করতে দেখিনি। শাইখ সুফইয়ান সাওরী রহ. বললেন, আবূ হানীফা একজন অতিশয় বুদ্ধিমান মানুষ। তার নেকী ও সওয়াবের কাজ নষ্ট করার মতো কোন বদআমলে লিপ্ত করতে প্রবৃত্তি তাকে প্ররোচিত করতে পারেনি। (গীবত ও পরনিন্দা করলে নিজের পুণ্যময় কাজগুলো নিন্দিত ব্যক্তির আমলনামায় দেয়া হবে। এভাবে পরনিন্দা করা যে চরম বোকামির লক্ষণ তা সহজেই অনুমেয়। ইমাম আবূ হানীফা রহ. একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি কীভাবে এমন বোকামির দ-ে দ-িত হবেন?)
হযরত ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, ‘ফিক্হশাস্ত্রে লোকজন আবূ হানীফার পোষ্য।’ কেয়ামত পর্যন্ত এ জগতে যাদের আনাগোনা ও বিচরণ হবে সবাইকে তার দ্বারস্থ হতে হবেই। তিনি বড় মুত্তাকী মানুষ ছিলেন। তাকওয়ার গুণে তিনি সাহাবা কেরামের ঊষালগ্নে পৌঁছে অন্তহীন এক ভালোবাসায় দগ্ধ হয়ে বিদগ্ধ হতে পেরেছিলেন।
হাফয ইবনে আব্দুর রহমান ছিলেন হযরত আবূ হানীফা রহ. এর (কোন কোন) ব্যবসার শরীকদার। হযরত আবূ হানীফা রহ. নিজেই এই পার্টনারকে কাপড় সামগ্রীর চালান যোগাড় করে দিতেন। একবার তিনি বিশাল এক চালান যোগাড় করে বলে দিলেন, এই এই কাপড়ে এই এই দোষ রয়েছে। বিক্রি করার সময় ক্রেতার নিকট দোষের বিষয় জানিয়েই বিক্রি করবে। কিন্তু হাফয রহ. সকল সামগ্রী বিক্রি করে দিলেন। কাপড়ের কোন দোষের কথা বলতে তিনি ভুলে গেলেন। হযরত আবূ হানীফা রহ. বিষয়টা জানলেন। কারা খুঁতযুক্ত কাপড় ক্রয় করেছে তা জানার উপায় না থাকায় তিনি পুরো চালানের বিক্রিমূল্য লাভসহ দান করে দিলেন।
তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল ‌আল্লাহ তাআলার ভয়ভীতি এবং রোনাজারি। রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করার সময় এবং কুরআন তেলাওয়াতকালে তিনি কাঁদতেন। হৃদয়ছোঁয়া ছিল সেই কান্নার আওয়াজ। এক রাতে তিনি শুধু একটি আয়াত তেলাওয়াত করে সারা রাত কাটিয়েছিলেন। আয়াতটি এই (অনুবাদ), ‘অধিকন্তু কেয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত কাল এবং কেয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্ততর।’ (সূরা কামার, আয়াত : ৪৬)।
সন্তানহারা মায়ের মতো ছিল তাঁর কান্না। রাতভর তিনি কাঁদতেন। সকাল পর্যন্ত কান্নার বিস্তৃতি ছিল। একদিন তিনি কুরআন তেলাওয়াত করছেন। সূরা যিলযাল পড়ার সময় তাঁর গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। হাত দিয়ে দাড়ি চেপে ধরলেন। রোনাজারি করে অশ্রুসজল হলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, হে মাবুদ! তুমিই তো অণু পরিমাণ সৎকর্মের বিনিময় উত্তম প্রতিদান দাতা। তুমি তোমার বান্দা নু’মানকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও। যে কাজ জাহান্নামের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা থেকে তা দূরে রাখো। ইয়া আরহামার রাহিমীন! তুমি তাকে তোমার বিস্তৃত রহমতে অন্তর্ভুক্ত কর।
আব্দুর রাজ্জাক রহ. হযরত আবূ হানীফা রহ. এর অবস্থা বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘যখন আবূ হানীফাকে আমি দেখিছি তখনই তার দু’চোখে ও গ-দেশে কান্নার চিহ্ন দেখতে পেয়েছি।’ হযরত আবূ হানীফা রহ. সহনশীল ব্যক্তি ছিলেন। ওয়ায-উপদেশ পছন্দ করতেন। তারিফ-প্রশংসা করা অপছন্দ করতেন। এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‌আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর। এ কথা শোনে তিনি চড়াই পাখির ন্যায় নড়ে ওঠলেন। বিবর্ণ হয়ে গেলেন। হাত-পা কাঁপতে লাগলো। নিজেকে সামলে বললেন, ‌আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। প্রতি মুহূর্তে এমন কথা শোনা মানুষের কত না দরকার! যা এইমাত্র আপনি বললেন।
তিনি বড় দানশীল ছিলেন। তাঁর দানের কথা সর্বত্র বিদিত। গোটা জীবন দান-অবদানে পরিপূর্ণ। তাঁর দানের ব্যাপারে বলা হয় যে, তিনি যে পরিমাণ নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করতেন ঠিক সেই পরিমাণ অন্যান্য গরীব-অসহায় লোকদের মাঝে দান করতেন। নতুন কোন কাপড় পরিধান করলে সেই মূল্যমানের কাপড় গরীব লোকদেরকে দিতেন। সাহল বিন মুযাহিম রহ. বলেন, আমরা হযরত আবূ হানীফা রহ. এর কাছে গেলাম। তার বাড়িতে একখানা চাটাই ছাড়া অন্য কোন কিছু আমরা দেখতে পেলাম না।
ইবাদত-বন্দেগীর জগতে তিনি যেমন বলিষ্ঠ ছিলেন ফিক্হশাস্ত্রেও তেমন ছিলেন। দিনের বেলায় রোযা রাখতেন এবং রাতের বেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ভোর রাতে ইস্তেগফার পড়তেন। একদিন পূর্বাহ্নের সময় হযরত আবূ হানীফা রহ. জড়ো হওয়া লোকদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, তারা তার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে ক্ষীণশব্দে বলছে, এই যে লোকটিকে তোমরা দেখতে পাচ্ছো। তিনি রাতে ঘুমান না। এই গুঞ্জন তার কানে আসামাত্রই নিজের ব্যাপারে আত্মগরিমার আশঙ্কা করলেন। আমি ‌আল্লাহ তাআলার কাছে যে অবস্থানে আছি মানুষের কাছে উল্টো অবস্থানে রয়েছি। কসম, এখন থেকে মানুষ আমার ব্যাপারে এমন কোন মন্তব্য করবে না যা আমি করিনি। আমৃত্যু আমি রাতের বেলায় আজ থেকে কখনও শয্যায় বিশ্রাম নিবো না। তখন থেকে তিনি রাত নামার সাথে সাথে যেখানে দুনিয়ার মানুষ ঘুমের ঘোরে নিমজ্জিত হয়ে যেতো সেখানে তিনি ‌আল্লাহ তাআলার দরবারে নিজেকে নিবেদন করে পড়ে থাকতেন।
বর্ণনায় পাওয়া যায়, তিনি চল্লিশ বছর ধরে ইশার উযূ দিয়ে ফজর নামায পড়েছেন। বেশি বেশি নামায পড়তেন। যে কারণে তাকে ‘কীলক’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। এক রাকাতে পুরো কুরআন শরীফ খতম করতেন।
মুসলিম জাহানে তখন সুদিন ছিল। ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়। যোগ্য ও মেধাবী লোকদেরকে শাসকশ্রেণি দু’হাতে বখশিশ দিতেন। এমন অবস্থা হয়েছিল যে, সর্বত্র হতে তাদের কাছে পারিতোষিক আসতো। কোত্থেকে আসছে তারা তা জানতো না। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা রহ. এসব থেকে নিজের ইলম এবং নিজেকে হেফাজত রেখেছেন। বখশিশের প্রতি নিজেকে লালায়িত না করে নিজে উপার্জনের জন্য সফর করেছেন এবং জীবিকার সন্ধানে ছুটেছেন। একদিন খলীফা মানসূর তাকে ডেকে নিলেন। খুব ইজ্জত-সম্মান করলেন। সমীহ করলেন। আবূ হানীফা রহ. যখন চলে আসার মনস্থ করলেন বাদশাহ তাকে ত্রিশ হাজার দিরহাম ভর্তি একটি ব্যাগ দিলেন। আবূ হানীফা রহ. উলামার তাকওয়ার জৌলুস দেখিয়ে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! এই বাগদাদ শহরে আমি একজন মুসাফির। এই ধনসম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমি নিরাপদ নই। এগুলো আপনি সরকারি কোষাগারে সংরক্ষণ করুন। দরকার হলে আমিই চেয়ে নিবো। বাদশাহ মানসূর তাঁর কথায় সাড়া দিলেন। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর জীবনাবসান হয়ে যায়। তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।
মৃত্যুর পর তার বাড়িতে কিছু গচ্ছিত ধনসম্পদ পাওয়া গেল। যেগুলোর পরিমাণ ত্রিশ হাজার দিরহামের চেয়ে কিছু বেশি। মানসূর মৃত্যুর কথা শোনে আসফোস করে বলল, ‌আল্লাহ তাআলা আবূ হানীফা রহ. এর প্রতি রহম করুন। আমাদের থেকে কিছু না নিয়ে চলে গেলেন। উল্টো আমাদেরকে ফেরত দিয়ে গেলেন।
বাদশাহ মানসূর হযরত আবূ হানীফা রহ.কে ডেকে পাঠালেন। তিনি আবূ হানীফা রহ.কে বিচারপতি হওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। মানসূর বললেন, আমাদের ন্যায় বাদশাহি করতে মন চায়? তিনি বললেন, যোগ্যতা রাখি না। মানসূর বললেন, নাহক কথা। আবূ হানীফা রহ. বললেন, আমি মিথ্যুক একথা তো এখন আপনিই ফয়সালা করলেন। সুতরাং মিথ্যুক কীভাবে যোগ্যতা রাখে? আর আমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকি তো আমি বলি, বাদশাহি করার যোগ্যতা আমার মাঝে নেই। মানসূর কসম খেয়ে বললেন, আপনাকে অবশ্যই বিচার বিভাগের দায়িত্ব নিতে হবে। আবূ হানীফা রহ.ও কসম খেয়ে বললেন, আমি বিচারক হবো। মানসূরের দারোয়ান রবী’ বলল, আমীরুল মুমিনীনের কসমের জবাবে আপনি যে কসম খাচ্ছেন? আবূ হানীফা রহ. বললেন, আমীরুল মুমিনীন আমার ডানপার্শ্বে রয়েছেন। তিনি আমার চেয়ে শক্তিধর। পরে তিনি আবূ হানীফা রহ.কে আঘাত করলেন এবং বাগদাদের কারাগারে বন্দী করলেন। কারাগারের বন্দীশালায় বন্দীদশায় হযরত আবূ হানীফা রহ. এর জীবনাবসান হয়। হিজরী ১৫০ সালে তিনি মারা যান।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it