ইব্রাহীম আন্নাখয়ী رحمة الله عليه (মৃ. ৯৬ হিজরী : ৭১৫ খৃস্টাব্দ)
নিজের থেকে শয়তানের ধোঁকা দূরীভূত করতে পেরেছিলেন। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা তাঁকে আনুগত্যের সম্মান দিয়েছিলেন। যাঁর হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাকওয়ার দৌলত প্রবহমান। নিজেকে বিনয়ী করে দ্বীনকে সমুন্নত করেছেন। খোদাপ্রেমিক। জীবনযুদ্ধে বিজয়ী এক ব্যক্তি। সাধনায় নিজেকে দগ্ধ করেছিলেন। তিনি ইব্রাহীম ইবনে ইয়াযিদ ইবনে কাইস ইবনুল আসওয়াদ আন্নাখয়ী, আবূ ইমরান। ইরাকের ইসলামী আইনজ্ঞ ও ফকীহ। নেক ও মহৎ ব্যক্তি। শীর্ষস্থানীয় তাবেঈ। কুফা নগরীর হাফেযে হাদীস। যাহিদ, দুনিয়াবিরাগী ও পরিশীলিত ব্যক্তিত্ব। পোড়খাওয়া ও অভিজ্ঞ লোক। প্রাজ্ঞ ও বিদ্যাসাগর। বিনয়ী মানুষ। সুনাম-সুখ্যাতি এবং ফতওয়া প্রদান করাকে অপছন্দ করতেন। উঁচু স্থানে বসতেন না। কোন মাসয়ালা ও দৈনন্দিন কোন বিষয় জিজ্ঞাসা করা হলে জিজ্ঞাসিত বিষয় ছাড়া অন্য কিছু উত্তরে বলতেন না। স্বল্প ও মিতভাষী। প্রশ্ন করা হলে কথা বলতেন। অন্যথায় চুপ থাকতেন। (এই উম্মতের জালিম শাসক) হাজ্জাজের ইন্তেকালের খবর পেয়ে শুকরিয়াস্বরূপ সেজদা করেছেন। শাহী প্রভাব ছিল। কিন্তু উলামা কেরামের বিনয়ে বিশেষিত ছিলেন।
হযরত মুগীরা বলেন, বাদশাহর ন্যায় ইব্রাহীমকে আমরা ভয় করতাম। কুফাবাসী হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর রা. এর চারপাশে বসে আছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁকে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করছে। (কেমন যেন) তাদের প্রশ্নবানে তিনি জর্জরিত। আমার কাছে অবাক লাগে, তোমাদের মাঝে ইব্রাহীম থাকা সত্ত্বেও আমাকে ফতওয়া জিজ্ঞাসা করছো।
সিংহের থাবা থেকে পলায়নপর ব্যক্তির ন্যায় তিনি সুনাম থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। সুখ্যাতির প্রতি তিনি বিরাগভাজন ছিলেন। যদি জানতেন যে, এ পথে সুনাম আছে তখন তিনি ভিন্ন পথে হাঁটতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহ তাআলা হেফাজত করলে বাঁচা সম্ভব; অন্যথায় অঙ্গুলি নির্দেশিত ব্যক্তির জন্য দ্বীন ও দুনিয়া উভয় জাহানে তার অনিষ্ট ও ক্ষতি অনিবার্য। হযরত যাবীদ রহ. বলেন, যখনই আমি ইব্রাহীম রহ.কে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি তাঁর মুখমণ্ডলে বিরাগের ছাপ লক্ষ্য করেছি। একবার তিনি কোন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতে আসলেন। ইব্রাহীম রহ. তাকে বললেন, প্রশ্ন করার মতো আমি ছাড়া অন্য কাউকে পাওনি?
একদিন তিনি কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে চলেছেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি প্রবেশ করল। তিনি কাপড় দিয়ে কুরআন শরীফ ঢেকে ফেললেন। বললেন, আমি চাই না সে আমাকে প্রতি মুহূর্তে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেখুক। রাতের বেলায় যখন লোকজন বাড়িঘরে বিশ্রাম নিতে থাকে তখন তিনি সুগন্ধি লাগিয়ে ভালো জামাকাপড় পরিধান করে মসজিদে চলে যেতেন। সেখানে ভোর পর্যন্ত অবস্থান করতেন। সকাল বেলায় রাতের ব্যবহৃত কাপড় খুলে ফেলতেন। এরপর মসজিদে যেতেন। ইব্রাহীম নাখয়ী রহ. এর স্ত্রী মারা গেলেন। তিনি কিছু অর্থকড়ি রেখে মারা গেলেন। ইব্রাহীম নাখয়ী রহ. সেগুলো তার পরিবারের লোকজনকে দিয়ে দিলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি কি আপনাকে দিয়ে যাননি? বললেন, না। অসুস্থ অবস্থায় আমাকে যা দেওয়ার দিয়েছেন। অবশিংষ্টাংশ তার ওয়ারিসগণের।
ইব্রাহীম নাখয়ী রহ. তাকওয়ার মূর্তপ্রতীক ব্যক্তি ছিলেন। হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতার কারণে সব ধরনের সংশয় ও খায়েশ দূরীভূত করেছিলেন। ইব্রাহীম নাখয়ী রহ. একবার একটা বাহন ভাড়া নিলেন। তাঁর হাত থেকে বেত পড়ে গেল। তিনি নামলেন এবং বাহন বাঁধলেন। এরপর ফিরে এসে বেত উঠিয়ে নিলেন। তাঁর এ কাজে লোকজন তাজ্জব বনে গেল। তারা বলল, বাহনটি বেত পড়ার স্থানে ফিরিয়ে নিলে তো আপনার জন্য অধিক সহজ হতো! তিনি বিনীত স্বরে বললেন, আমি এতটুকু স্থান অতিক্রম করার জন্য বাহন ভাড়া করেছি। ফেরত আসার জন্য ভাড়া নেয়নি।
মৃত্যুমুখে পতিত। লবেজান। ইব্রাহীম নাখয়ী কাঁদলেন। গণ্ডদেশ বেয়ে চোখের পানি বেয়ে পড়ল। জিজ্ঞাসিত হলেন, কেন কাঁদছেন? বললেন, না কেঁদে পারি? আমি তো মালাকুল মওতের অপেক্ষায় আছি। মৃত্যুর ফেরেশতা আমাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয় নাকি জাহান্নামের দুঃসংবাদ দেয়, আমি তো তা জানি না। তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় বারবার পড়তে লাগলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শরীকালাহ লাহুল মুল্কু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাইয়িন কাদীর। মৃত্যুযন্ত্রণা বেড়ে গেলে বলতে লাগলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াদাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্। পরক্ষণে মারা গেলেন। ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক এর শাসনামলে হিজরী ৯৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর।