ইবরাহীম ইবনে আদহাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৬১ হিজরী : ৭৭৮ খৃস্টাব্দ)

দুনিয়াত্যাগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আখেরাত অনুরাগীদের কিংবদন্তী। দুনিয়ায় যার আমৃত্যু শ্লোগান ছিল তাকওয়া আর পরহেযগারি। মোলায়েম সূক্ষè কাপড় ছেড়ে মোটা কাপড়েরর আড়ালে ছিলেন। পুরনো জীবন-অভিধান ছুড়ে ফেলে উন্মুক্ত করেছেন অমর জীবন-অভিধান। পৃথিবীর বুকে যারা অমর হয়ে থাকবেন তিনি তাদেরই একজন।
ঐ দলের তিনি সদস্য যাঁরা দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে করেছেন, যারা আত্মত্যাগের অতি চমৎকার পাঠ রেখে গেছেন। তিনি আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবনে আদহাম ইবনে মানসূর তামীমী বালখী। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, যাহিদ ও দুনিয়াত্যাগী, আদর্শ অনুকরণীয় বুযর্গ ব্যক্তি। দুনিয়াবিমুখদের প্রধান। ‘মাদরাসাতুল ওরা’ তথা তাকওয়া স্কুলের তিনি উস্তাদ। পরহেযগারি মতাদর্শের তিনি শীর্ষ ও অগ্রবর্তী ব্যক্তি। বিখ্যাত দুনিয়াবিরাগী মানুষ। ইতিহাসে যার স্থান। শাহজাদা। সোনার চামচ মুখে দিয়ে যার জন্ম। আদরে লালিত-পালিত ধনীর ছেলে।
তাঁর বাবা ছিলেন বাদশাহ। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি বনেদি জমিদারের ছেলে। আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়ার আনন্দ-বিনোদনে গা না ভাসিয়ে তওবা করার তাওফীক দান করেছিলেন। ধনৈশ্বর্য পশ্চাতে ফেলে দিলেন। ইলম, ফিকহ ও তাকওয়ার সন্ধানে তিনি দেশ-বিদেশ ঘুরতে লাগলেন। বিখ্যাত এই বুযর্গ ফসল কাটা এবং বাগান প্রহরা দিয়ে নিজের জীবিকা চালিয়েছেন। হাদীসশাস্ত্রে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী। বুৎপন্ন ফকীহ ও ইসলামী আইনজ্ঞ। তার অনেক কারামাত ও লোকাতীত আজব ঘটনা রয়েছে। তার দোআ কবুল হতে বলে তাকে মুস্তাজাবুদ্দা’ওয়া বলা হয়।
দুনিয়ার স্মরণ থেকে নিজের জিহ্বা হেফাজত করেছেন। কল্যাণ ও পুণ্যময় কাজ ও ফিকিরে নিজের হৃদয়কে উন্মুক্ত বিচরণ করার সুযোগ দিয়েছেন। আনুগত্য ও বন্দেগীর বদৌলতে নিজেকে আল্লাহ তাআলার বিরাগ ও দুনিয়াবী তুচ্ছতা থেকে আড়ালে রাখতে পেরেছেন। সুফইয়ান সাওরী রহ. বলেন, ইব্রাহীম খলীল আ. এর সাথে ইব্রাহীম ইবনে আদহামের মিল ছিল। সাহাবা কেরামের মধ্যে থাকলে তিনি অন্যতম ব্যক্তিতে পরিণত হতেন।
একদিন তিনি বসে শুষ্ক রুটির টুকরা খাচ্ছেন। মনে বড় প্রশান্তি। ইবরাহীম ইবনে আদহাম বললেন, রাজা-বাদশাহ এবং তাদের সন্তানরা যদি জানতো আমরা কেমন আরাম-আয়েশ এবং ফুর্তি-আমোদে আছি তাহলে তারা সারাজীবন আমাদেরকে তরবারির আঘাতে জর্জরিত করে ফেলতো।
তিনি যুহদ ও দুনিয়াত্যাগের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, যুহদ ফরয। দুনিয়াবিমুখিতা নিরাপদ। জাগতিক মোহত্যাগ মর্যাদা ও ফযীলত। হারামের ক্ষেত্রে যুহদ করা ফরয। সংশয়-সন্দেহের ক্ষেত্রে যুহদ করা নিরাপদ এবং হালাল বিষয়ক যুহদ করা ফযীলত ও মর্যাদার বিষয়। তিনি লোকদেরকে হালাল রিযিকের ব্যাপারে ওয়ায-নসিহত করতেন। তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতেন। বলতেন, হালাল খাও। যা ইচ্ছে আল্লাহ তাআলার কাছে চাও। (অর্থাৎ আহার হালাল হলে বান্দার যে কোন দোআ আল্লাহ তাআলার নিকট গৃহীত হয়)।
এক ব্যক্তি ইব্রাহীম ইবনে আদ্হামের নিকট গিয়ে দাঁড়াল। তার বুক ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। বলল, হে আবূ ইসহাক! অন্তর কেন আল্লাহ তাআলা থেকে আড়াল হয়ে যায়? ইবরাহীম ইবনে আদহাম আবেগঘন কণ্ঠে উত্তরে দিলেন। অন্তর যখন এমন বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যেগুলো প্রতি আল্লাহ তাআলা নারাজ তখন অন্তর ও আল্লাহ তাআলার মাঝে আড়াল সৃষ্টি হয়। মাওলার বিরাগভাজন দুনিয়া যখন হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে তখনই তাঁর মারেফত থেকে অন্তর আড়ালে-আবডালে হয়ে যায়। দুনিয়ার প্রতি আসক্ত এবং ধোঁকার জগতের প্রতি লালায়িত হওয়াই তার প্রধান কারণ।
ইব্রাহীম ইবনে আদহাম সামুদ্রিক সফরে বের হলেন। প্রচ- বাতাস শুরু হল। ঢেউ প্রবলভাবে তরঙ্গায়িত হতে লাগলো। পর্বতসম ঊর্মিমালা দোল খেতে লাগলো। আরোহীরা মৃত্যুমুখে পতিত হল। সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ইবরাহীম ইবনে জেগে ওঠলেন। লোকজন কাঁদছেন, বিলাপ করছেন। ইবরাহীম ইবনে আদহাম মাথা তুললেন। আল্লাহ তাআলার কাছে রোনাজারি করে কাঁদলেন। কায়মনোবাক্যে দোআ করলেন। বললেন, হে আল্লাহ! তুমি তোমার কুদরত দেখালে। এবার তুমি তোমার ক্ষমা দেখাও। মুহূর্তের মধ্যে উত্তাল সমুদ্র শান্ত গেল। একদম নিথর নিস্তব্ধ। সবকিছুই মহান আল্লাহ তাআলার কুদরতের অপার মহিমায়।
হৃদয়জুড়ে শুধু ঈমান আর ঈমান। মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর আস্থা। এক ব্যক্তি তার কাছে পোষ্য শিশুর বেশি হওয়ার অভিযোগ করলো। ইবরাহীম আদহাম তাকে বললেন, বন্ধু, তোমার বাড়ির সকল লোকের দিকে চেয়ে দেখো। তাদের মধ্যে যার রিযিক আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত নয় তাকে তুমি আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। (এমন তো কেউ নেই যার রিযিক আল্লাহ তাআলার দায়িত্বে নেই)।
দুনিয়া ও জাগতিক আরাম-আয়েশ তার নিকট কোন গ্রাহ্যতা পায়নি। লোকজন মৃত্যু থেকে যেভাবে পালিয়ে বেড়ায় তিনিও ঠিক সেভাবে এড়িয়ে গেছেন। এক আগন্তুক খুরাসান থেকে আসল। এসে লোক সমাগমে চেঁচিয়ে বলল, তোমাদের মধ্যে ইবরাহীম ইবনে আদ্হাম কে? লোকজন বলল, এই তো তিনি। লোকটি বলল, আপনার ভাইয়ের আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছে। ইবরাহীম ইবনে আদহাম নিজের ভাইয়ের কথা শুনতে পেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার হাত ধরে দূরে নিয়ে গেলেন। বললেন, কেন তুমি আসছো? লোকটি বলল, আমি আপনার গোলাম। এই খচ্চর আপনার। আমার কাছে দশ হাজার দিরহাম রয়েছে। এগুলো আপনি নিজের জন্য খরচ করবেন এবং আপনি বলখ শহরে যাবেন।
ইবরাহীম ইবনে আদহাম বললেন, তুমি যদি সত্য বলে থাকো তাহলে তুমি আযাদ। তুমি মুক্ত। এই খচ্চর তোমার। আর এই অর্থ তুমিই তোমার জন্য খরচ কর। এরপর ইবরাহীম ইবনে আদহাম বলতে লাগলেন, দারিদ্র্য চাইলাম। কিন্তু ধনাঢ্যতা পিছু ছাড়ছে না। লোকজন অর্থ-বিভব চাইছে; কিন্তু অভাব-দারিদ্র্য তাদের পিছু ছাড়ছে না।
ইতিহাসের মহান এই মনীষী ইবরাহীম ইবনে আদহাম ১৬১ হিজরীতে আরব উপদ্বীপে মারা যান। ইন্তেকালের পর তাকে সুর শহরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি সমাহিত হন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it