ইবনু আবী যি’ব রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৫৮ হিজরী : ৭৭৪ খৃস্টাব্দ)
যিনি জীবদ্দশায় রাজা-বাদশাহদের পায়ের তলার মাটি কাঁপাতেন। যার কথায় হৃদয়তন্ত্রী ঝঙ্কৃত হতো। হৃদয়ে ছিল শুধু আখেরাতের চিন্তা-ভাবনা। তিনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রাহমান ইবনুল মুগীরা ইবনুল হারিস ইবনে আবী যি’ব রহ.। শাইখুল ইসলাম আবুল হারিস কুরাশী আমেরী মাদানী। ফকীহ, মুহাদ্দিস ও যাহিদ। কথাবার্তায় এবং চালচলনে যিনি বিখ্যাত তাবঈ সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. এর মতো ছিলেন।
অনেক বড় মুত্তাকী মানুষ। অনর্থক কথা ও কাজ থেকে যোজন মাইল দূরে থাকতেন। মানুষের প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করতেন। দানশীল ছিলেন। দীন-দরিদ্র লোকদেরকে প্রচুর দিতেন। তার হৃদয়ছোঁয়া কথায় মনোমুগ্ধতা সৃষ্টি করতো। আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং ফযীলতপূর্ণ আমলের ব্যাপারে অতি অগ্রগামী ছিলেন।
একদিন পর পর রোযা রাখতেন। রুটি আর যয়তুন খেতেন। বিনয়ী ও সাদামাঠা জীবন-জীবিকা ছিল। ফিতনা-ফাসাদ থেকে দূরে থাকতেন। হক ও সত্যের ব্যাপারে দুঃসাহসিক ছিলেন। সত্য কোন কিছু সামনে আসলে অন্য কিছুকে ভয় করতেন না। রাজা-বাদশাহগণ যাকে ভয় করতো।
ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, কোন শহর বা গ্রাম, দেশ বা বিভূঁই কোথাও তার মতো মানুষ পাওয়া যায়নি। তিনি অতি মুত্তাকী এবং সত্যের ব্যাপারে অতি সাহসী ব্যক্তি ছিলেন।
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, কাউকে হারিয়ে বা অসাক্ষাতে আমার তেমন আফসোস হয়নি যেমনটা হয়েছিল ইবনে আবী যি’ব’কে হারিয়ে।
তিনি বড় ইবাদতগুজার ও মুত্তাকী ছিলেন। রাতভর নামায পড়তেন। মেহনত ও পরিশ্রম করে ইবাদত-বন্দেগী করতেন। এমনকি যদি বলা হয় যে, আগামী দিন কেয়ামত তারপরও তার ইবাদত আর বাড়বে না। তিনি সর্বোচ্চ পরিমাণ বাড়িয়ে ইবাদত করতেন। সত্যের ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাদশাহগণ পর্যন্ত তার কথায় নড়েচড়ে বসতেন। তার কথায় তাদের পায়ের তলায় মাটি সরে যেতো।
হযরত ইবনে আবী যি’ব ও আনাস বিন মালিককে নিয়ে বাদশাহ আবূ জা’ফর হজ্বে গেলেন। ইবনে আবী যি’বকে ডাকলেন। একসাথে বসলেন পরামর্শসভায়। বাদশাহ বললেন, মদীনার আমীর হাসান বিন যিয়াদ সম্পর্কে আপনি কী বলেন? বললেন, ন্যায় ও সুবিচারের চেষ্টা করে। আবূ জা’ফর বললেন, আমার ব্যাপারে কী বলেন? ইবনে আবী যি’ব বললেন, এই কা’বা ঘরের প্রতিপালকের কসম! নিঃসন্দেহে আপনি একজন জালিম। একথা শোনে বাদশাহ আবূ জা’ফরের দারোয়ান রবী তার দাড়ি ধরে ফেলে। আবূ জা’ফর চিৎকার দিয়ে বলে, ছাড়ো! তার দাড়ি। এরপর ইবনে আবী যি’ব এর জন্য তিনশত দীনার দিতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ইবনে আবী যি’ব সেই দীনার গ্রহণ করেননি।
বাদশাহ মাহদী হজ্বের বছর মদীনা শরীফে আসলেন। মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। ইবনে আবী যি’ব ছাড়া মসজিদে তখন যত লোক ছিল সবাই বাদশাহ’র সম্মান দাঁড়িয়ে গেল। ইবনে যুহাইর রহ. তাকে বললেন, দাঁড়ান। এই তো আমীরুল মুমিনীন। ইবনে আবী যি’ব রহ. পর্বতসম দৃঢ়তা নিয়ে বললেন, মানুষ তো কেবল বিশ্বজগতের প্রতিপালকের উদ্দেশেই দাঁড়াবে। মাহদী বললেন, তখন তার গ-দেশ শ্রদ্ধায় ঘর্মাক্ত, বাদ দাও। ওকে নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তার আচরণে আমার মাথা চুল খাড়া হয়ে গেছে।
ইবনে আবী যি’ব রহ. বাদশাহ মানসূরের চাচা মদীনার গভর্নর আব্দুস সামাদ ইবনে আলী এর নিকট গেলেন। কোন এক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। আব্দুস সামাদ বললেন, আমার দৃষ্টিতে আপনি লৌকিকতার আশ্রয় নিচ্ছেন। আপনি রিয়াকার। ইবনে আবী যি’ব রহ. একটি শলাকা হাতে নিলেন। সেটি তিনি আব্দুস সামাদের সামনে তুলে ধরলেন। বললেন, কী দেখতে পাচ্ছেন? লোকজন আমার নিকট এই শলাকা থেকেও তুচ্ছ। মহান এই মনীষী হিজরী ১৫৮ সালে মারা যান।