আমির ইবনে আবদি কাইস رحمة الله عليه (মৃ. ৫৫ হিজরী : ৬৭৫ খৃস্টাব্দ)

নবী-ওয়ালা আমল নিয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাত করবেন যিনি। এমন মনোবাসনা লালন করেন যিনি। সিংহ যার কাপড় চুমু খেয়েছিল। ইবাদত-বন্দেগী করেছেন আল্লাহ তাআলাকে প্রত্যক্ষ করার মানসে। আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা তাঁর শরমে বাধতো। মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি ঘনিষ্ঠতার জ্যোতি লাভে যিকির ছিল তাঁর প্রধান মাধ্যম। এই উম্মতের রাহেব, দুনিয়া বিরাগী ও আখেরাত অনুরাগী। তাঁকে উম্মতের সর্বশেষ আদর্শ আখেরাতপ্রেমিক মনে করা হয়। তিনি ওলীকুল শিরোমণি আমির ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আবদি কাইস আলআম্বরী, আবূ উমর। আলআম্বর গোত্রের এক জন তাবেঈ লোক। বসরা নগরীর আবেদ তাবেঈদের মাঝে তিনিই প্রথম পরিচিত আবেদ ও পরহেযগার। বিখ্যাত সাহাবী আবূ মূসা আল্আশআ’রী রা. থেকে পরকালপ্রেমের সবক গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর শিষ্য। তাঁর থেকে কুরআনের জ্ঞান লাভ করেছেন। আখেরাতের সাথে যাঁর হৃদয় লেগে থাকে সর্বক্ষণ। আশা ও অভিলাষের বাগ-বাগিচায় যাঁর স্বপ্নসাধ দোল খায়।

মালিক ইবনে দীনার রহ. বলেন, আমির ইবনে আবদি কাইস ছিলেন এই উম্মতের রাহিব। দুনিয়াবিমুখ এক ব্যক্তি। মনের রাজ্যে বিরাজ করতো আল্লাহভীতি। যিকিরের সময় চড়াই পাখির মতো কাঁপতেন। তিনি বলতেন, যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে তিনি সবকিছুকে সেই ব্যক্তির প্রতি আতঙ্কিত করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে না সে ব্যক্তিকে সবকিছুর প্রতি আতঙ্কিত করে তোলেন। একদিন তিনি নামায পড়তে দাঁড়ালেন। ইবলিস শয়তান সাপের আকৃতিতে তাঁর সামনে হাজির। জামার নিচের অংশ দিয়ে ঢুকে পড়ে। বুকের দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আমির ইবনে আবদি কাইস সাপের এই আনাগোনায় একটুও নড়লেন না এবং সামান্য আতঙ্কিতও হলেন না।

তিনি বলতেন, আল্লাহকে লজ্জা করি। লজ্জার আবেদনে অন্য কাউকে ভয় করতে পারি না। মাবুদকে ভয় করি আবার অন্য কাউকে ডরাই, তা তো স্ববিরোধী বিষয়। কসম, কখন সাপ প্রবেশ করলো আবার কখন বের হল তা আমি টের-ই পায়নি। রাত জেগে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর পছন্দনীয় বিষয় ছিল। মনকে সাধনায় দগ্ধ করতে ভালোবাসতেন। ভোর থেকে আসর পর্যন্ত বিভিন্ন নামাযে মশগুল থাকতেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পদযুগল ফুলে যেতো। তিনি বলতেন, মন! এ কাজ করার জন্য আমি সৃজিত হয়েছি। এই লক্ষ্যে আমাকে তৈরী করা হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, আমির ইবনে আবদি কাইস দৈনিক এক হাজার রাকাত নামায পড়তেন। সর্বপ্রথম তিনিই মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং তিনিই সর্বশেষ মসজিদ থেকে বের হতেন। লোকজন তাঁকে দেখতে পেলে তিনি নামায সংক্ষিপ্ত করতেন।

মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি অতিশয় ভরসাকারী ছিলেন। তাঁর প্রতি অধিক আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর পরিশ্রমের কাছে বড় বড় পর্বতের পর্যন্ত মাথা হেঁট হয়ে যেতো। একদিন তাঁকে বলা হল, আপনার বাড়ির পাশে আগুন লেগেছে। তিনি বললেন, বাদ দাও। আগুন তো আদিষ্ট। সেও নির্দেশমাফিক চলে। এরপর নামায পড়তে লেগে গেলেন। যেন কোন কিছুই ঘটেনি। মনে হল অগ্নিকাণ্ডের কথাগুলো তাঁর কর্ণকুহরে পৌঁছেইনি। আগুনের ফুলকি তো এগিয়ে চলছে তো চলছেই। কিন্তু কুদরতের কী কারিশমা, তাঁর ঘরের কাছে গিয়ে আগুনের মোড় অন্য দিকে ফিরে গেল।

সম্পদের কোন মূল্য তাঁর কাছে ছিল না। দারিদ্র্য নিয়ে যার কোন চিন্তা নেই তার মতো খরচ করতেন। দানে ধন কমে না-এ কথায় যাঁর পূর্ণ বিশ্বাস তার ন্যায় অর্থকড়ি বিলাতেন। হযরত আমির ইবনে আবদে কাইস যখন দান করতে ইচ্ছে করতেন তখন তিনি অর্থকড়ি কাপড়ের আঁচলে নিয়ে নিতেন। পথে যে কোন দীনদরিদ্রের সাথে দেখা হতো তাকে দান করতেন। কেউ একবার পাওয়ার পর আবার তাঁর বাসায় আসলে তিনি তার দিকে অর্থকড়ি ছুঁড়ে ফেলতেন, কেমন যেন তাকে আগে দান করেননি।

সূর্য ডোবার সাথে সাথে আমিরের ভাতিজি পেয়ালায় দুধ নিয়ে আমির ইবনে আবদি কাইসের নিকট হাজির। সেই দুধ দিয়ে তিনি ইফতার করবেন। কিন্তু এরই মধ্যে ভিক্ষুক এসে হাঁক পাড়ল। আছে কেউ ক্ষুধার্ত জঠরে আহার্য দান করবে? ভিখারির কথায় আমির প্রভাবিত হয়ে বললেন, ভাতিজি! এই দুধ কি আমার জন্য নয়? যা ইচ্ছে তা করার ক্ষমতা আমার কি নেই? মেয়েটি বলল, অবশ্যই। এ কথা শোনে তিনি পেয়ালাটি ভিখারিকে দিলেন। এতে ভাতিজির চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আমির ভাতিজিকে বললেন, অন্য কিছু নিয়ে আসো। সে খেজুর নিয়ে আসল। আমির সেই খেজুর খেয়ে পানি পান করলেন। এরপর বললেন, ভাতিজি! উদর একটি পাত্র। কিছু একটা দিয়ে ভরলেই হল। কিন্তু আজকের দান-ছদকা আগামী দিনের সঞ্চয়।
তাঁর বাড়িতে জাগতিক সামগ্রী ছিল না। স্বল্পমূল্যের সামান্য কিছু পাথেয় ব্যতীত। ইবনে কুদামার কাজের লোক আমির ইবনে কাইসের নিকট হাজির। তখন তিনি নামায পড়ছিলেন। বাড়ির গেইটে অনুমতি চাইলে আমির উচ্চস্বরে তাসবীহ পাঠ করে নামাজের জানান দেন। পরে বাড়িতে প্রবেশ করে দেখেন সামান্য পানি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। গায়ে বিনীত পোশাক। তিনি দাঁড়িয়ে নামায আদায়ে মশগুল। হযরত আমির ইবনে কাইস যখন বাজারে ফলের দোকানের নিকটবর্তী হয়ে গমন করতেন তখন তিনি বলতেন, নিষিদ্ধ ও বৃক্ষকাটা। (এ কথা বলে ফল খাওয়ার অভিলাষ অঙ্কুরে দমন করতেন)।
আমির ইবনে কাইস আসন পেতে বসে মুক্ত মনে লোকদের সাথে কথা বলছেন। জাগতিক জীবনের গল্প ও চাকচিক্যের বিষয়ের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছেন। মানুষের জীবন চার জিনিসের মাঝে আবর্তিত হতে দেখলাম। কাপড়-চোপড়, নারী, ঘুম ও আহার। জামা-কাপড় ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল, সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। সতর ঢাকার মতো কাপড় থাকলেই হল। কাপড় আছে তো কাঁধে নিয়ে চললাম। সেটা কি পশমের না অন্য কোন কিছুর, সেটা আমার লক্ষ্য করার বিষয় নয়। আর নারী, আমার দৃষ্টি দেয়ালে পড়ল নাকি নারীর শরীরে পড়ল সেটাও ভ্রূক্ষেপ করি না। রয়ে গেলে ঘুম ও আহার। এ দু’টো আমার চেয়ে প্রবল। তাই আমি আহার গ্রহণ করি এবং ঘুমাই। কসম, আগামী জীবনে এ দু’টো নিয়ন্ত্রণ করে নিবো। হাসান বসরী রহ. বলেন, আমৃত্যু তিনি তাই করে গেছেন।

একদিন আমির ইবনে আবদি কাইস রহ. বসে বসে অঝরে কাঁদছেন। কেউ বলল, আপনি কেন কাঁদছেন? তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, অবাক লাগে সেই রাতের যার সকালে কেয়ামত দিবস নাড়া দেয়। একদিন তিনি জবাইকৃত চড়াই পাখির মতো কাঁদছেন আর ছটফট করছেন। বুকে চাপা গুঞ্জন। ভাজনকড়াইয়ে শস্যদানার ন্যায় তিনি অস্থির। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহ! জাহান্নামের ভয়ে আমি ঘুমাতে পারি না। আমাকে ক্ষমা কর।

তিনি ছোট আশা করতেন। তাঁর কাছে মনে হতো, জুতার ফিতার চেয়ে মৃত্যু আরও নিকটে। তাই তো তাঁর কাছে এক লোক আসলো। তখন তিনি নামাযে মশগুল। আগন্তুকের জন্য তিনি নামায সংক্ষিপ্ত করলেন। এরপর লোকটির দিকে ফিরে বললেন, তুমি তোমার প্রয়োজনের কথা বলো। আমাকে মুক্ত কর। আমার তাড়া আছে। লোকটি বলল, কীসের তাড়া? তিনি বললেন, মালাকুল মওতের তাড়া আছে। আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি রহমত করুন। লোকটি প্রয়োজন সেরে চলে যেতে লাগল। এদিকে আমির ইবনে আবদি কাইস রহ. পুনরায় নামায পড়তে লাগলেন।

বসরার গভর্নর লোক ডেকে পাঠালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, আমির, আপনি যে বিয়ে করছেন না? আমির ইবনে আবদি কাইস রহ. উত্তরে বললেন, বিয়ের পয়গাম আমি ছেড়ে দেয়নি। আমি মহিলাদেরকে বরাবর বিয়ে প্রস্তাব দিয়েই যাচ্ছি। (এ কথার উদ্দেশ্য জান্নাতী রমণী)। গভর্নর পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আমীরের দরবারে কেন আসেন না? আমির ইবনে আবদি কাইস রহ. বললেন, আপনাদের দ্বারে অনেক অভাবী লোকেরা তাদের অভাব ও প্রয়োজন নিয়ে আসে। আপনারা তাদের অভাব ও প্রয়োজন পূরণ করুন। আর যাদের প্রয়োজন নেই তাদেরকে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো। মূলত যারা আসে না তাদের প্রয়োজন নেই বিধায় আসে না।

একদিন আমির ইবনে আবদি কাইস রহ. মজলুম যিম্মীকে (মুসলিম দেশের অমুসলিম নাগরিক) দেখলেন। তিনি তার গায়ে নিজের চাদর জড়ালেন। এরপর তিনি তারস্বরে বললেন, আমি জীবিত থাকতে আল্লাহ তাআলার নিরাপত্তা ব্যাহত হোক তা দেখতে চাই না। এভাবে তিনি তাকে জুলুম থেকে উদ্ধার করলেন। জুলুমও দূর করলেন। একবার আমির ইবনে আবদি কাইস রহ. প্রচণ্ড রোগে আক্রান্ত হলেন। তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। লোকজন তাঁকে দেখতে আসতে লাগলো। তিনি কাঁদলেন। কেউ জিজ্ঞেস করলো, কেন কাঁদেন? বললেন, কুরআনের একটি আয়াতে কথা স্মরণ করে কাঁদছি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন (অনুবাদ) অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের করবানী কবুল করেন। এভাবে তিনি ব্যথায় ব্যথিত। মৃত্যুমুখে হাজির। খুব কাঁদলেন। জিজ্ঞাসিত হলেন, কেন কাঁদছেন? ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমি মৃত্যুর ডরে কাঁদছি না। দুনিয়ার লোভেও কাঁদছি না। দুপুরের তৃষ্ণা ও শীতের রাতের জাগরণ এবং দীর্ঘ সফর হওয়া সত্ত্বেও সামান্য পাথেয় হওয়ায় কাঁদছি। আমি তো এই সন্ধ্যায় হয় জান্নাতে না হয় জাহান্নামে। শেষ পরিণাম কী হবে তাও জানি না। এ কথা বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। হিজরী ৫৫ সালে তিনি বাইতুল মাকদিসে মারা যান।