আমর ইবনে উতবা রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ৩২ হিজরী : ৬৫৩ খৃস্টাব্দ)
নামাযের মুসল্লায় দাঁড়িয়ে থেকে রাত জাগা যাঁর খুব পছন্দনীয়। রাতের আঁধার ভেঙে যিনি রোনাজারি করতেন। যাঁর দোআ ছিল রহমতের চাবিকাঠি, রুকু ছিল রাতের চেরাগ এবং রোযা ছিল দিবসের আহার। অন্যকে ভয় করা যিনি আল্লাহ সকাশে লজ্জা বোধ করতেন। ইবাদতগুজার ও দরবেশ, অতি বিনয়ী ও অনুগত। তিনি আমর ইবনে উতবা ইবনে ফারকদ আস্সুলামী। কুফা নগরীর আবেদ। ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকায় যিনি হাদীস বর্ণনার ফুরসত পাননি। নিজের গোটা জীবন কাটিয়েছেন যিকির, রোযা আর রাত জেগে নামায আদায়ে। অতি আস্থাভাজন ব্যক্তি। নিজের সঙ্গী-সাথীদের জিহাদের সময় তাদের নৈশপ্রহরার প্রয়োজন হতো না তাঁর অধিক নামায পড়ার রাত জাগরনে। যুহদ ও আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভের ব্যাপারে তাঁর অনেক বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে। পাঠক ও শ্রেুাতার নিকট সেগুলো উপকথা ও রূপকথা মনে হবে। আমর ইবনে উতবা রহ. এর আজাদকৃত গোলাম বলেন, গ্রীষ্মের একদিন আমি দুপুরের সময় ঘুম থেকে উঠলাম। তখন নিদাঘ দুপুর। আমর ইবনে উতবাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে দেখি তিনি এক পাহাড়ে সিজদা অবস্থায় আছেন। তাঁর উপর একখ- মেঘমালা ছায়া দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, তাঁকে দেখলাম এক রাতে নামায পড়ছেন। এমন সময় সিংহের আওয়াজ শোনে আমরা পালাতে লাগলাম। কিন্তু তিনি আগের অবস্থায় নামাযে মশগুল। সামান্য নড়লেন না। আমরা বললাম, আপনি কী সিংহকে ভয় পান না? দুনিয়া নির্লিপ্ত লোকটি সৌম্য-শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কাউকে ডরালে তাঁর কাছে মুখ দেখাবো কীভাবে? অন্যের ভয় মনে থাকলে আল্লাহ তাআলার প্রতি আমার শরম লাগে। প্রত্যেক দিন আহারের জন্য তাঁর দু’টি রুটি ছিল। একটি দিয়ে সেহরি খেতেন আর অন্যটি ইফতারের সময় খেতেন।
আমর ইবনে উতবা রহ. যার পর নেই চেষ্টাচরিত্র করেছিলেন নিজের পরকালের পাথেয় সংগ্রহে। সাধ্য-সাধনায় দগ্ধ হয়েছিলেন নিজেকে গড়তে। যুহদ ও তাকওয়ার দরিয়ায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। দুনিয়ার প্রতি বিরাগ, আখেরাতের প্রতি অনুরাগ ছিল যাঁর অগাধ। তাঁর বাবাও চাইতেন ছেলে এমন ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকুক। তাই তিনি লোক পাঠিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এমন সাহায্য-সহযোগিতা দেখে আমর ইবনে উতবা বলতেন, বাবা! আমি তো একজন গোলাম। (জাহান্নাম থেকে) নিজেকে মুক্ত করার জন্য আমল করে থাকি। সুতরাং আমার কাজ আমাকে নিজে করতে দিন। তাঁর বাবা কেঁদে বললেন, বৎস, আমি তোমাকে দ্বিগুণ ভালোবাসি। এক তো আল্লাহ তাআলার জন্য ভালোবাসি। দ্বিতীয়ত তুমি আমার সন্তান। সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমর ইবনে উতবা রহ. বললেন, বাবা, আপনি তো আমাকে সত্তর হাজার দিরহাম দিয়েছেন। আপনি চাইলে সেগুলো নিতে পারেন। সেগুলো এখানে আছে। আর যদি ফেরত না নেন আমি সেগুলো দান করে দিবো। তাঁর বাবা বললেন, তুমি সেগুলো দান করে দিতে পারো। আমর ইবনে উতবা রহ. সেগুলো দান করে দিলেন। একটি দিরহামও নিজের কাছে রাখলেন না।
একবার আমর ইবনে উতবা রহ. চার হাজার দিরহাম দিয়ে একটি ঘোড়া কিনলেন। তিনি তা ছেড়ে দিলেন। ঘোড়া ফি সাবীলিল্লাহ্ দৌড়াতে লাগলো। লোকজন ধমক দিলেন। এতে তো মূল্য বেড়ে যাবে। তিনি বললেন, ঘোড়ার প্রতিটি পদক্ষেপ আমার নিকট চার হাজার দিরহাম অপেক্ষা প্রিয়।
রাতের বেলায় ঘোড়ায় চড়তেন। কবরে গিয়ে দাঁড়াতেন। উচ্চকণ্ঠে বলতেন, হে কবরবাসী, তোমাদের আমলনামা বন্ধ হয়ে গেছে। তোমাদের কর্ম ও আমল সংরক্ষিত হয়ে আছে। এভাবে বলে কাঁদতেন। কবরের পায়ের কাছে বসে সকাল পর্যন্ত ভয় ও দুঃখের সাথে বিলাপ করতেন। সকালে আবার ফজরের নামাযে শরীক হতেন। তিনি ছিলেন ‘মুসতাজাবুদ্দাওয়াত’, দোআ করামাত্র আল্লাহ তাআলার দরবারে কবুল হয়ে যেতো। হৃদয় ছিল পরিচ্ছন্ন। কথায় দাগ কাটতো। দোআ করা নিজের কল্যাণের অংশ মনে করতেন।
আমর ইবনে উতবা রহ. বলতেন, আমি আল্লাহ তাআলার দরবারে তিনটি জিনিস চেয়েছি। তিনি আমাকে দু’টি জিনিস দিয়েছেন। তৃতীয়টির অপেক্ষায় আছি। আল্লাহ তাআলার কাছে দুনিয়ার যাহেদ হতে চেয়েছি। দুনিয়ার প্রতি বিরাগী হওয়ার প্রার্থনা করেছি। দুনিয়ার কি আসলো আর কি গেলো তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। জাগতিক বিষয় নিয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। আল্লাহ তাআলার দরবার দোআ করেছি, তিনি যেন আমাকে নামাযে শক্তি দান করেন। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আমাকে এই দু’টি জিনিস দান করেছেন। তৃতীয় শাহাদতের কামনা। আমি আশায় আছি তিনি আমাকে সেটাও দান করবেন।
আমর ইবনে উতবা রহ. জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হলেন। সাদা জুব্বা পরিধান করলেন। এরপর বললেন, কসম, এই পোশাকের উপর দিয়ে রক্ত বয়ে গেলে অনেক ভাল। ঠিকই যুদ্ধ তীব্র হয়ে গেল তিনি বর্শাঘাত খেয়ে জখম হলেন। ইবরাহীম ইবনে আলকামা রহ. বলেন, যেখানে তাঁর হাত রাখা ছিল সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. এর শাসনামলে তিনি আযারবাইজানে শহীদ হন। হিজরী ৩২ সালে তাঁর শেষ তামান্না অনুযায়ী মারয এলাকায় সমাহিত হন।