আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৮১ হিজরী : ৭৯৭ খৃস্টাব্দ)

তাকওয়া ও যুহদ দিয়ে যিনি দুনিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। হৃদয় কুঠরিতে ছিল যিকিরের চেরাগ এবং দানের স্টোর। যাঁর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছিল সব ধরনের ভালো ও কল্যাণমূলক কাজ। এমন এক ব্যক্তি যাঁর অন্তরে দুনিয়ার সুখ্যাতি শক্তি হারিয়ে আহত শার্দূলে পরিণত হয়েছিল। যাঁর চোখের সামনে সুনামের অনুপ্রেরণা-সরোবর শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনি আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মুবারক ইবনে ওয়াযিহ তামীমী মারূযী রহ.। আবূ আব্দুল্লাহ্ উপনাম। মুত্তাকীদের প্রধান, প্রাচ্যের প-িতপ্রবর ব্যক্তি এবং ইমামুল মুসলিমীন।
যিনি একাধারে হাফিযে হাদীস, বীর মুজাহিদ ও ব্যবসায়ী। বিশ বছর বয়স থেকে ইলম তলব শুরু করেছিলেন। হজ্ব ও জিহাদের সফর করে জীবনকাল কাটিয়েছেন। ফিকহশাস্ত্র, ইলমুল হাদীস, আরবী ভাষা এবং লোকসাহিত্য ও লোককাহিনী বিষয়ে যিনি অনন্য সাধারণ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। ফোকাহা কেরামের আসরের প্রতি লালায়িত ছিলেন। জ্ঞান-সাগরে নিজেকে যিনি সঁপে দিয়েছিলেন। তাকওয়া-বাগানে যার বিচরণ ছিল অবাধ। নিজে রোযা রেখে লোকদেরকে খাওয়াতেন।
ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহ. বলেন, ইবনুল মুবারক মুসলিম নেতাদের একজন। ইবনুল মুবারকের মৃত্যু-সংবাদ শোনে হারূনুর রশীদ মন্তব্য করেছিলেন, উলামাদের নেতা মারা গেলেন। ফুযাইল ইবনে আয়ায ইবনুল মুবারককে জিজ্ঞেস করলেন, প্রকৃত মানুষ কারা? তিনি বললেন, উলামা কেরাম। ফুযাইল বললেন, রাজা-বাদশাহদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কারা? ইবনুল মুবারক রহ. বললেন, যাহিদ ও দুনিয়াত্যাগী।
আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মুবারক রহ. বলেছেন, আদব ও শিষ্টাচার দ্বীনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। ইবনুল মুবারক রহ. বহুত বড় মুত্তাকী ছিলেন। দীনদরিদ্র লোকদের মাঝে দান করতেন প্রচুর। বছরে এক লক্ষ দিরহাম দান করতেন। অভাবী লোকদের ঋণ পরিশোধ করতেন। তিনি বলতেন, এক লক্ষ, দুই লক্ষ….ছয় লক্ষ দিরহাম দান করার চেয়ে সন্দেহের মধ্যে এক দিরহাম নেওয়া উত্তম। (অর্থাৎ আর্থিক কোন বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে সামান্য এক দিরহাম না নেওয়া অতি উত্তম)।
একদিন হাসান বসরী রহ. আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুবারক রহ. এর নিকট গেলেন। গিয়ে দেখেন, বাড়ির চারপাশে কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে। ইবনুল মুবারক রহ. বললেন, এক সময় কবুতরের পালক কাজে লাগাতাম। এখন অবশ্যই সেগুলো আমরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করি না। হাসান বসরী রহ. বললেন, কেন? ইবনুল মুবারক রহ. বললেন, আমাদের কবুতরের সাথে অন্যদের কবুতর মিশ্রিত হয়ে গেছে। সেই কারণে সেগুলোর পালক নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে বড় বাধে। কাজে লাগাতে মন চায় না।
ইবনুল মুবারক রহ. তার সিরীয় এক বন্ধু থেকে একটি কলম ধার নিয়েছিলেন। সেটা বন্ধুকে ফেরত দিতে ভুলে গেলেন। মারওয়া শহরে এসে লক্ষ্য করে দেখেন, আসবাবপত্রে কলমটি রয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ চলে গেলেন সিরিয়া। কলমটি বন্ধুকে ফিরিয়ে দিলেন।
আযান শুরু হল। ইবনুল মুবারক রহ. রয়েছেন চলতি একটি বাহনে। বাহন থামিয়ে নেমে নামায পড়লেন। রাষ্ট্রীয় একটি চারণভূমির শস্য খেয়ে ফেলে তার বাহন। সতর্কবশত তিনি বাহনটি আর গ্রহণই করলেন না। রেখে চলে গেলেন। আরোহণ করলেন না সেই বাহনে।
বাদশাহ হারূনুর রশীদ রাক্কা শহরে আসলেন। কাকতালীয়ভাবে সেখানে ইবনুল মুবারক রহ. আসলেন। লোকজন ইবনুল মুবারক রহ.কে দেখতে, তাঁর ইলম হাসিল করার জন্য অস্বাভাবিকভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চারদিকে তাঁকে নিয়ে তোলপাড় ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রচ- শোরগোল। এমন সময় আমীরুল মুমিনীন হারূনুর রশীদের গর্ভদাসী কাষ্ঠপ্রাসাদের উপর তলা থেকে এই পরিস্থিতি দেখে থ বনে যায়। মানুষের এমন ঝুঁকে পড়া দেখে বলল, এটা কী? বলা হল, খুরাসানের এক আলেম। মক্কা শহরে এসেছেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুবারক নামে মানুষের মাঝে যিনি পরিচিত। মহিলা বলল, আল্লাহ কসম! প্রকৃত বাদশাহ তো হারূনুর রশীদ নয়। এই লোকটিই নেতৃত্ব দিচ্ছে। কারণ হারূনুর রশীদের নিকট লোক জড়ো করতে সৈন্যসামন্ত লাগে। পক্ষান্তরে তার কাছে লোকজন এমনি জড়ো হতে থাকে।
তার অনেক কারামাত রয়েছে। তিনি লোকাতীত ঘটনার জনক। দোআ করলে তার দোআ কবুল হয়। একদিন আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুবারক রহ. এক অন্ধ লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন। লোকটি বলল, হে ইবনুল মুবারক! আমি আপনার কাছে দরখাস্ত করছি আপনি আমার জন্য দোআ করুন। তিনি যেন আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। ইবনুল মুবারক রহ. দু’হাত তুলে দোআ করলেন। আল্লাহ তাআলার কাছে চাইলেন। আল্লাহ তাআলা তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন।
তিনি নির্জনে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। নিঃসঙ্গতার সাথে তার মিতালী ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবা কেরামের জীবনী ও সীরাতের কিতাবাদি রাত জেগে পড়তেন আসক্ত হয়ে। সীরাতের গ্রন্থকীট বলা যায়। কেউ প্রশ্ন করলেন, পড়তে পড়তে একঘেয়েমি লাগে না? তিনি বললেন, আমি আছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে। সাহাবা কেরাম নিয়ে থাকলে আর কেমন নিঃসঙ্গতা?
ফোরাত নদীর তীর ঘেঁষে বুহাইত নামক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেন। তখন তিনি জিহাদ শেষে গাজী বেশে দেশে ফিরছিলেন। রমাযানের চার তারিখ হিজরী ১৮১ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল তেষট্টি বছর।