আবূ সুলাইমান দারানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ২১৫ হিজরী : ৮৩০ খৃস্টাব্দ)

ঘুমের মজার চেয়ে মুনাজাতের মজা যাঁর অধিক পছন্দনীয়। মাবুদের কাছে রোনাজারি যাঁর নিকট অগ্রাধিকারভাবে সমাদৃত। উদর জ্বালায় নিজেকে রেখে যিনি হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করেছিলেন। যুহদের সিঁড়িতে তাকওয়া ছিল যাঁর প্রথম ধাপ। দিবসের ক্ষুধা আর রজনীর বিনিদ্রা হাতিয়ার দিয়ে যিনি দুনিয়ার ধোঁকা দূরীভূত করেছিলেন। হৃদয় মরিচা আর আত্মমল ধুয়ে-মুছে সাফসুতরা করেছিলেন ক্ষুধার অস্ত্র ব্যবহার করে। জাগতিক ক্ষতি সাধন করে আখেরাত লাভ করেছিলেন। তিনি আবূ সুলাইমান দারানী। আব্দুর রহমান ইবনে আহমাদ ইবনে আতিয়্যা আলআনাসী। দামেস্কের দারাইয়া এলাকার বিখ্যাত যাহিদ। কিছু দিন বাগদাদেও ছিলেন। পরবর্তীতে আবার সিরিয়ায় আসেন।
হিকমত ও প্রজ্ঞার তূণীরে যার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। যা দিয়ে তিনি দুনিয়া গরিমা ধূলিস্যাৎ করেছিলেন। তাঁর কথায় হৃদয়ের মরিচা দূর হতো। হযরত আবূ সুলাইমান বলেন, যা কিছু আল্লাহ তাআলা থেকে নির্লিপ্ত রাখে তার ত্যাগ করাই হল যুহদ। ছোট আশা পোষণ করে যুহদ অর্জন কর। জাগতিক মোহ দূর করার প্রতিষেধক হিসেবে তিনি বলতেন, সামান্য ক্ষুধা, সামান্য রাত জাগা এবং সামান্য শীতে দুনিয়া মোহ দূর হয়। তিনি আরও বলেছেন, তাকওয়া হল যুহদের প্রথম পদক্ষেপ।
আহার কমানোর জন্য তিনি উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, আখেরাতের চাবিকাঠি হল ক্ষুধা। দুনিয়ার মূল চালিকাশক্তি হল উদরপূর্তি। দুনিয়া ও আখেরাতে সকল কল্যাণের মূল নিয়মক হল খোদাভীতি। একদিন তিনি লোকদেরকে ওয়ায-উপদেশ দিতে বের হলেন। বললেন, হৃদয় ক্ষুধিত ও তৃষিত হলে স্বচ্ছ এবং পরিচ্ছন্ন হয়। পক্ষান্তরে পরিতৃপ্ত হলে এবং আশ মিটিয়ে পানাহার করলে তা ভোঁতা হয়ে পড়ে।
তিনি বলতেন, সকল কিছুতে মরিচা লাগে। পরিতৃপ্ত পানাহার হল আত্মার মরিচা। তিনি নিজের শিষ্যদেরকে দুনিয়াত্যাগে উৎসাহিত করতে বলতেন, আখেরাতের জন্য যে দুনিয়া ত্যাগ করবে সে উভয় জাহানে লাভবান হবে। পরন্তু যে ব্যক্তি দুনিয়ার জন্য আখেরাত ছাড়বে সে উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি সুনাম-সুখ্যাতি থেকে দূরে থাকতেন। নিঃসঙ্গতা পছন্দ করতেন। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি বলেছেন, তুমি যদি কোনভাবে অখ্যাত-অজ্ঞাত থাকতে পারো এবং (তোমার প্রতি) অঙ্গুলি নির্দেশিত না হয়ে থাকতে পারো তাহলে তুমি তা কর।
রাতের বেলায় তিনি অশ্বারোহী। যিকিরের নূরে নেককার লোকদের রাত আলোকিতকারীদের তিনি একজন। যারা তাসবীহ’র গুঞ্জনে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয় তিনি তাদের একজন। ভোর রাতে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে তিনি বসে আছেন। কিয়ামুল লাইলের আবেগ নিয়ে তাদের সাথে গল্প করছেন। রাত জেগে নামায ও ইবাদত-বন্দেগী না করলে কীভাবে পস্তাতে হবে তার চিত্রায়ণ করছেন। বললেন, রাতের নামায না থাকলে আমি দুনিয়ায় আর থাকতাম না। দুনিয়ায় টিকে থাকার উপকরণ একমাত্র রাতের নামায। কিয়ামুল লাইলের ফযীলতে আবূ সুলাইমান দারানীর অর্জিত কারামাত (লোকাতীত ঘটনা) সম্পর্কে বিবৃতি দিচ্ছেন। বলেছেন, এক রাতে সালাতুল লাইলের অযীফা শেষ করে ঘুমালাম। হঠাৎ দেখি, জান্নাতী রমণী। তিনি বলছেন, আবূ সুলাইমান! তুমি আমাদের বাদ দিয়ে ঘুমাও! অথচ আমি তোমার জন্য পাঁচশত বছর ধরে অন্দরমহলে লালিত হচ্ছি? তোমার দু’চোখ ঘুমাচ্ছে অথচ ফিরিশতা সজাগ? তিনি দেখছেন, কারা তাহাজ্জুদ পড়ছে!! সে চোখের কী দুর্ভোগ!! যে চোখ মাওলার মুনাজাতের মজা ছেড়ে সামান্য ঘুমের মজা নিতে তৎপর! আবূ সুলাইমান, ওঠো! আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি রহম করুন। কেন এই সমাদৃত ঘুম?
তিনি বললেন, আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জেগে ওঠলাম। তার ধমকে আমি লজ্জিত হলাম এবং ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম। তার কথার মাধুর্য ও রেশ এখনও আমার কানে ও হৃদয়ে বিরাজমান।
আবূ সুলাইমান দারানী রহ. ইহরামের কাপড় পরিধান করলেন। ইচ্ছে ছিল, উচ্চকণ্ঠে তালবিয়া (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…) পড়বেন। তালবিয়ার পবিত্র ধ্বনিতে দিগন্ত সুরভিত হবে। হঠাৎ তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। মাটিতে পড়ে গেলেন। লোকজন চিকিৎসা দিতে দৌড়িয়ে আসে। সম্বিত ফিরে পেলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, আবূ সুলাইমান কী ঘটেছে? তিনি ফেকাসে বদনে বললেন, জানতে পারলাম, যে ব্যক্তি যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে হজ্জ করার ইচ্ছা করে এবং তালবিয়া পড়ে, আল্লাহ তাআলা তাকে বলেন, না তোমার কোন লাব্বাইক নেই। তুমি যা কিছু বলছো এগুলো তোমার হাতে ফেরত। আমারও আশঙ্কা না জানি তিনি আমার ব্যাপারে এমন কথা বলেন!!
একদিন তিনি লোকদের সাথে বসে কথা বলছেন। তিনি বললেন, গুনাহের কথা মনে পড়লে মরতে মনে চায় না। তওবা যেন করতে পারি এজন্য বাঁচতে চাই। তিনি তার ছেলে সুলাইমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তাকে বলা হল, সে তো উপার্জন করতে, হালাল রুটি-রুজির সন্ধানে এবং জমি-জিরাত ক্রয়বিক্রয় করতে বের হয়েছে। পিতা মন্তব্য করলেন, সে আত্মা কখনও সফলকাম হবে না যে আত্মা অর্থকড়ি সঞ্চয়ে তৎপর। টাকাকড়ি ধান্দায় থাকলে হৃদয় ও মন পরিশীলিত হবে না।
মহান এই মনীষীর রূহ ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করে এবং সমাধিগোরে শরীর আত্মগোপন করে হিজরী ২১৫ সালে।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it