আওন বিন আব্দুল্লাহ্ ইবনে উতবা রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১১৫ হিজরী : ৭৩৩ খৃস্টাব্দ)

দুনিয়ায় থাকতে যিনি আখেরাতের নিগড় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। ইখলাস ও নিষ্ঠার তরবারি দিয়ে যিনি মনের কুমন্ত্রণার শিকড় কেটে দিয়েছিলেন। জান্নাতে প্রবেশের পথে মৃত্যু ব্যতীত অন্য কোন কিছু বাধা ছিল না যাঁর। আখেরাতের অবশিষ্টাংশ ছিল যাঁর দুনিয়া। যে কেউ তাঁকে নামাযের দোআরে কড়াঘাত করতে দেখবে সে বিস্ময়ে বিমোহিত হবে এবং নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তিনি আওন বিন আব্দুল্লাহ্ ইবনে উতবা ইবনে মাসঊদ রহ.। একাধারে খতীব, কবি, সুসাহিত্যিক, ইবাদতগুজার, বিখ্যাত ক্বারী ও জনকল্যাণকামী। তাসাওফ শাস্ত্রের কিংবদন্তী। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করে দুনিয়ার সংশয়-সন্দেহ দূরীভূত করতে পেরেছিলেন। মৃত্যুর জন্য যিনি লালায়িত ছিলেন। যিকির করে যিনি হৃদয়ের আরোগ্য লাভ করতে এবং প্রবৃত্তির শয়তানকে পরাস্ত করতে পেরেছিলেন।
তাঁর শ্রুতিমধুর বিজ্ঞবচন রয়েছে। তিনি বলতেন, কারো অহঙ্কারী হওয়ার জন্য অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করাই যথেষ্ট। এমন কোন মর্যাদা শুধু নিজের জন্য বিশেষিত ভাবা যে, সেই গুণ কেবল নিজের মধ্যে রয়েছে; এতটুকু জ্ঞান করলেই মুতাকাব্বির হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আগেকার মানুষ আখেরাতের অতিরিক্ত অংশ দুনিয়ার কাজে লাগাতো। আর বর্তমান মানুষ দুনিয়ার অবশিষ্টাংশটুকু আখেরাতের কাজে লাগায়। (আগেকার যুগের মানুষ ধর্মকর্ম করে বাকি সময়ে প্রয়োজনমাফিক দুনিয়াদারি (আয়-উপার্জন) করতো। বর্তমানে দুনিয়াদারি করে সময় পেলে কখনও কখনও ধর্মকর্ম করে)। তিনি যিকির পছন্দ করতেন। বলতেন, প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু সেরা আমল রয়েছে। আর আমার সেরা আমল হল যিকির। তিনি আরও বলতেন, যিকিরের মজলিস হৃদয়ের শেফা। যে আসরে আল্লাহ তাআলার যিকির হয় সেটা মানুষের অন্তরের আরোগ্য। তাঁর কথাগুলো হৃদয় জখমের জন্য মলমের কাজ করতো। মনের আয়নায় সেগুলো ভেসে ওঠামাত্রই চৈতন্যোদয় হতো। দুঃখ-কষ্ট লাঘব হতো।
একবার এক ব্যক্তি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আওন বিন আব্দুল্লাহ্ এর নিকট আসল। বলল, আমার আশঙ্কা আমি মুনাফিক, আমি কপট বিশ্বাসী। তিনি তাকে বললেন, তুমি মুনাফিক হলে তোমার মাঝে এই ভয় সৃষ্টি হতো না। হযরত আওন বিন আব্দুল্লাহ নির্জনে নিজের গুনাহের জন্য কাঁদতেন। চোখের পানিতে দু’চোখ ভাসাতেন। চোখের সেই পানি দিয়ে চেহারা ধুয়ে নিতেন।
কেউ জিজ্ঞাসা করলো, চোখের পানি চেহারায় কেন মুছে দেন? তিনি বললেন, জানতে পেরেছি যে, মানুষের চোখের পানি শরীরের যে অংশে লাগবে সেই অংশটুকু আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন।

মৃত্যু-স্মরণে যাঁর হৃদয় ছিল টইটম্বুর। স্বল্প আশায় যাঁর মন ছিল কানায় কানায় ভরা। নিজেকে ভর্ৎসনা দিতেন এই বলে, হায় আমার দুর্ভোগ! আমি কীভাবে নিজেকে নিয়ে আনমনা হয়ে আছি! অথচ আমাকে নিয়ে মৃত্যু-ফেরেশতা মালাকুল মওত তো গাফেল নন?! হায় কী সর্বনাশ! দীর্ঘ আশা নিয়ে কীভাবে কথা বলি! অথচ আয়ু আমার খোঁজে ঘুরে ফিরছে!?

একবার তাঁর বন্ধু-বান্ধব জড়ো হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মুমিনের কোন্ দিনটি সবচেয়ে বেশি উপকারী? তিনি বললেন, যে দিন সে জানতে পারবে যে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সন্তুষ্ট। তারা বলল, দুনিয়ার জীবনে কোন্ দিনটি বেশি উপকারী? বললেন, দুনিয়ার জীবনে ঐ দিনটি বেশি উপকারী যে দিনটির শেষ অংশের ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগে না।

মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে ওসিয়ত করলেন, আমার যাবতীয় জমিজিরাত বিক্রি করে সেগুলোর মূল্য দান করে দাও। জিজ্ঞাসা করা হল, জমি বিক্রি করে দান করবেন; ভালো কথা। পরিবার-পরিজনকে কিছু দিবেন না? ঈমান-নিকষিত হৃদয় নিয়ে বললেন, জমিজিরাত বিক্রি করছি নিজের আখেরাতের পাথেয়ের জন্য। আর পরিবার-পরিজনের জন্য মাওলায়ে পাক আল্লাহ তাআলার কাছে দোআ করে যাচ্ছি। পরবর্তীতে দেখা গেছে, তাঁর বংশধরের লোকেরা অর্থসম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি এবং মর্যাদা ও গৌরবে অতুলনীয় ছিলেন।

মহান এই মনীষী হিজরী ১১৫ সালে দুনিয়া ছেড়ে আখেরাতের পথে পাড়ি জমান।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it