আখলাক ও আত্মশুদ্ধিচিন্তার খোরাক​বিবিধ প্রবন্ধ

দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও স্বেচ্ছাচারি মনোভাব নিয়ে কাজ: কোন পথে চলছি আমরা?

কখনো আমাদের কোনো কাজের পূর্বে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, কখনো  বা পরে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে থাকা দ্বীন ও দুনিয়ার জন্য ক্ষতিকর। কাজের পূর্বে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হলে সুযোগ থাকে সংশোধন বা উত্তরণের। কাজের পরে হলে অনেক সময় ক্ষতি হয়েই যায়! প্রতিটি মুমিনের এ ব্যাপারে  সতর্ক থাকা উচিত।

আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সব ধরণের কাজেই মনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আসতে পারে। আবার জাগতিক ও পারলৌকিক যেকোনো বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। এর একটি মৌলিক কারণ হল, আমরা অধিকাংশ মুসলমান যথাযথভাবে দ্বীনের তালীম (ইসলামের শিক্ষা) গ্রহণ করিনি। অনেকে যদিও বা করেছি, আমাদের যথাযথ তরবিয়ত কোনো দ্বীনদারের ছায়াতলে হয়নি। তাই আমাদের মাঝে নানান বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েই যায়। এগুলোর কোনোটি আবার বিশ্বাসগত পর্যায়ের, কোনোটি বা আমলি বা কর্মগত পর্যায়ের। সবগুলোর গুরুত্ব একরকম নয় ঠিক, কিন্তু যেকোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে লালন করে রাখা ক্ষতির কারণ।

দ্বীনদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাদের নির্দেশনা নেওয়া ও তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা সৌভাগ্যের কাজ। পক্ষান্তরে নিজ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বাহ্যিকভাবে যেটা বুঝে আসে সেটা করতে থাকা আর নিজের ইচ্ছা-খেয়াল-রায় প্রাধান্য দেওয়া কখনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সেটা সৌভাগ্যের বিপরীত ইঙ্গিত বহন করে, তাই পরিত্যাজ্য।

দেখুন, শরিয়ত বিনয়কে কত গুরুত্ব দিয়েছে! কোন পথটি বিনয়ের? দ্বীনদার ও বুদ্ধিমানকে অনুসরণ (তাদের পরামর্শ ও নির্দেশনা গ্রহণ) নাকি নিজ বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে কাজ করা?

বুদ্ধিমান ও সতর্ক মুমিন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলে তা সমাধান না করে কাজ করে না। এই গুণটি একজন মুমিনের তাকওয়ার নিদর্শন। ফরয ও ওয়াজিব কাজে তো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রেখে কাজ করার প্রশ্নই আসে না! অন্যান্য কাজেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে নেক আমল করা বা প্রবৃত্ত হওয়া ঠিক নয়, অনুচিত।

দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এক অর্থ হল, আমি যে কাজটি করতে যাচ্ছি তা কি করা উচিত নাকি অনুচিত — এ প্রশ্নকে মনের মধ্যেই ঝুলিয়ে রাখা। শরিয়ত এ বিষয়ে কী বলে? অর্থাৎ, ইসলামের নির্দেশনা কী সেটি যথাশীঘ্রই জেনে নিতে হবে। না জেনে মনের মধ্যে তা রেখে দেওয়া যাবে না। এমনটা করা হলে হয়ত শরিয়তের বড় কোনো হুকুম-আহকাম নষ্ট হবে। শরিয়তের বিধান জেনে বিভ্রান্তি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করতে হবে।

দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আরেক অর্থ হল, (শরিয়তের বিধান জানার পর) কোনো কাজ আমি করব কি করব না, করলে আসলেই আমার লাভ হবে কি না, আমার জন্য পরিণতি কেমন হবে, অথবা এখনই করব না কি পরে — এ বিষয়ে দোদুল্যমান থাকা। কাজের পূর্বে এ জাতীয় প্রশ্ন আসা ও সেটির উত্তর সন্ধান মন্দ নয়। কারণ, অনেক কিছু স্থান, কাল, পাত্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। সমাধানের জন্য প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা আসবেই। মন্দ হল, দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে প্রশ্রয় দেওয়া, সমাধান না করা।

দ্বিধা-দ্বদ্ব রেখে নেক কাজ করলে নফস ও শয়তান নিয়ত, কর্মপন্থা ও ফলাফলে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়। নানান কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। তখন স্বাভাবিক মানসিকতার পদস্খলন ঘটতে পারে, বা কমপক্ষে সময় তো নষ্ট হয়ই। এমনকি না-শোকরি, বে-সবর অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়। নানান ওয়াসওয়াসা ও চিন্তায় ঐ সময়ের দায়-দায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কখনো এজন্যও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় যে, কাজটি আমার জন্য করার পথ ও পদ্ধতি নিয়ে আমি শঙ্কিত। এমন হয় যে, কাজটি ভালো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি কেন করছি, করলে আমার জন্য তাতে কল্যাণ আছে কি নেই — তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। এটাও স্বাভাবিক।

তা হলে করণীয় কী? 
সবচেয়ে উত্তম ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে জরুরি হল, যে কাজটি আমি করতে যাচ্ছি তার জন্য আমার ঘনিষ্ঠ দ্বীনি মুরুব্বির সঙ্গে পরামর্শ করা। ঘনিষ্ঠ এ অর্থে যে তিনি আমার অবস্থা জানেন। তার কাছে আমার অবস্থা অবগত করে পরামর্শ চাওয়া ও নেওয়া সহজ।

যথাসম্ভব কাজটি করার পূর্বেই ভাবা দরকার। ভেবেই পরামর্শ করা উচিত। তা হলে আরো স্বচ্ছভাবে নিজ অবস্থা সামনে চলে আসবে। আর সঙ্গে অবশ্যই দোআ করতে হবে।

যে কারণেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হোক তা নিয়ে কেবল নিজে বেশি চিন্তা ও গবেষণা নিরর্থক। যেটা করতে হবে কালক্ষেপণ না করে তা দূর করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাজটি আমি করব না কি করব না। আনুষঙ্গিক সবকিছু এক সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে — কেন করব, কী ফল হতে পারে ইত্যাদি। চিন্তা-ভাবনা,পরামর্শ, দোআ করার পর যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করা হবে তখন যেন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর প্রশ্রয় না পায়! তখন কোনো প্রতিকূল চিন্তা আসলে, এর মধ্যেই খায়ের আছে চিন্তা করতে হবে।

আমাদের মূল সমস্যা ও তার ফলাফল
আমরা সিদ্ধান্ত নিই, কিন্তু সঠিক না বেঠিক কোনো মাপকাঠি অবলম্বনে পিছপা থাকি। তার মানে সিদ্ধান্ত নিজে নিজে নিই আমরা। এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। করার সময় সব কাজই একটি পরিকল্পনা, স্বপ্ন নিয়ে করা হয়। কিন্তু তার পূর্ণ বাস্তবায়নে আরো নতুন অবস্থা আসে, আসতে থাকে। তখন আমরা হিমসিম খাই। সেই পর্যায়ে পরামর্শ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, পূর্বে তো পরামর্শ করিনি! এর নেতিবাচক প্রভাব দোআর মধ্যেও পড়ে। কারণ, বান্দা আল্লাহমুখী হতেও তখন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়! আমি কাজটি কেন করলাম, কোথায় ভুল ছিল, কার দোষ ছিল ইত্যাদি চিন্তা আমাদেরকে দোআ-ইস্তেগফার করায়ও বিরত রাখে। অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে, ওয়াসওয়াসা ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পায়।

বাস্তবিকই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজ বুদ্ধি-বিবেক খাঁটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা যে কাজে অগ্রসর হয়ে থাকি, তা আমাদের স্বেচ্ছাচারী পথ চলার স্পষ্ট প্রমাণ।

ঈমানদার কিভাবে স্বেচ্ছাচারী হবে?! ঈমানদার তো আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর অনুগত। আর কোনো ঈমানদার কত বেশি আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর অনুগত, সেটি বোঝা যাবে ঐ ব্যক্তির সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক কাদের সঙ্গে(?) সেটি পরখ করে দেখলে। কারো কাজ-কর্ম, হোক তা জাগতিক বা আখেরাত সংশ্লিষ্ট, কাদের অনুগামী(?), তাতেই বোঝা যাবে ঐ ব্যক্তি কত বেশি আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর অনুগত।

মৌখিক দাবি যে, আমি স্বেচ্ছাচারী নই — এটা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। কাজে আমরা কেমন, সেটা দেখার বিষয়। অধিকাংশের কাজে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সিদ্ধান্তের মাপকাঠি, উপায় অবলম্বন, সমস্যার সমাধানের মাধ্যম বানিয়েছি ও বেছে নিয়েছি স্বেচ্ছাচারি মনোভাব ও কর্মপন্থা। আর এর ফলাফল তো স্পষ্ট! দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সমস্যা, ক্ষতি, পদস্খলন, সর্বসম্মত পথ ও মত থেকে বিচ্ছিন্নতা।

স্বেচ্ছাচারী মানুষের সঠিক ও ভালো  কাজও অনেক সময় স্বাগত জানানো যায় না! এটার মূল কারণ হল, কেউ স্বেচ্ছাচারী হলে এ আশঙ্কা রয়েছে যে, আরও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যকে সে লালন করছে। তার কোনো সঠিক কাজের পেছনে উদ্দেশ্য কী থাকে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়! যে তার নিজ মত ও পথে চলে, তার তো কোনো নীতি নেই। সে নিজস্ব কোনো যুক্তিতেই আজকে ভালো কাজ করছে, কাল নিজস্ব কোনো যুক্তিতে মন্দ করতে কুন্ঠাবোধ করবে না! মানুষের নিজস্ব যুক্তি কতক্ষণ ভালো থাকে, বলুন?
একজন ঈমানদারের যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেক কুরবান যায় ইসলামের কাছে, সীরাতে মুস্তাকীমের পথে। তার কাছে সত্যের মানদণ্ড কুরআন-সুন্নাহ ও কুরআন-সুন্নাহর  অনুসারী ব্যক্তিবর্গ। সেখানে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেকের আবার কীসের স্থান?!

যখন সুযোগ থাকে তখনই সতর্ক হতে হয় 
সুযোগ সবসময় থাকে না। আবার সুযোগ সবসময় একরকমও থাকে না! আমরা জানি যে, নেক কাজে বিলম্ব করতে নেই। কোনো কাজে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলে অনেক সময় তা আমাদের ঈমান ও আমলকে সরাসরি প্রভাবিত করে! অতএব তখন, ঐ মুহূর্তে — পরামর্শ তলব করার থেকে উত্তম কাজ আর কী হতে পারে?! সাহাবীগণ কেন এত মর্যাদাপূর্ণ ছিলেন? উনারা বুদ্ধি-বিবেককে শরীয়তের সম্পূর্ণ অনুগত করেছেন। আমরা পারছি না কেন? সেই বুদ্ধি-বিবেককেই আমরা প্রাধান্য দিয়ে চলেছি! এতটাই যে, শরীয়তের বিধি-বিধান জানছি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবস্থা ও জটিলতা দেখছি কিন্তু সতর্ক হচ্ছি না। সুযোগ সবসময় থাকে না, থাকবেও না। তাই সতর্ক আগেই হতে হবে।

সবার অবস্থা অবশ্য একরকম নয়। সবার দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যও একরকম নয়। দুঃখ তাদের জন্য যারা কি না নিজেকে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মনে করছে কারণ তাদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা বাস্তবিকই অনেকের চেয়ে বেশি। কিন্তু যখনই মানুষের মেধা ও অভিজ্ঞতা বেশি হয় তখনই তো তার এ চিন্তা বেশি বিকশিত হওয়া উচিত যে, আমার সামনে তো অনেক পথ ও মত, আমার জন্য অধিক দরজা খোলা! আমার উচিত আমার থেকেও বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞগণের সঙ্গে কথা বলে সমাধানে উপনীত হওয়া!

শয়তান আগে, মাঝে ও পরে (অর্থাৎ সবসময়) আক্রমণ করতে সচেষ্ট থাকে
আমাদের দুর্বলতার সুযোগ খুঁজে শয়তান। সে কুমন্ত্রণা দেওয়ায় সবচেয়ে বড় সুযোগসন্ধানী! যেখানেই আমরা ছিদ্র রেখে দিব সেদিক দিয়েই হামলা করতে সে একটুও বিলম্ব করবে না। আমাদের গাফলত বা অসতর্কতাই আমাদের বিরুদ্ধে তার হামলাকে শক্তিশালী করে! অভিজ্ঞতা এটাই যে, যে পথেই আমরা অসতর্ক চলি সে পথেই সে হামলা করে বসে। আমাদের মধ্যে হতাশা, দুরাশা আর নানাবিধ প্রশ্নের উদ্রেক করে সে। তার এইসব কুমন্ত্রণা আর হামলা আমাদের কাজের শুরু, মাঝ ও শেষ — সবগুলো পর্যায়ে চলতে থাকে। অথচ তার এতকিছুর বিরুদ্ধে আমাদের সামান্য সতর্কতা কত সহজ ও বিরাট প্রতিরোধ হয়ে থাকে! আমরা যদি দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে প্রশ্রয় না দিয়ে শরীয়ত নির্দেশিত হুকুম জেনে নিই, যেখানে প্রয়োজন চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শ করে কাজ করি, তাহলে শয়তান অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু আমরা ক’জন এটি মূল্যায়ন করি?!

*******

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এত সুন্দর একটি দ্বীন দিয়েছেন! আলহামদুলিল্লাহ। তাও কি আমরা একাকী চলব? এতটা অসহায়ের মত চলব? যাদের কোনো পথ-মত ও মূলনীতি নেই, তাদের মতই চলব? দিশেহারা ও উদ্ভ্রান্তের মত চলে মূল্যবান জীবনটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিব?!

আমরা বুদ্ধিমান হলে এমনটা কখনো করব না!

Last Updated on September 26, 2023 @ 10:16 am by IslamInLife বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *